সাপের কামড় ও করণীয়:
সাপ প্রায় সময়ই আমাদের চোখে পড়ে না। আমরা যখন বন-জঙ্গলে হাঁটা-চলা করি তখন হঠাৎ দেখতে পাই। অনেক সময় উন্মুক্ত কোনো স্থানে গাছের নিচেও এই প্রাণিটি দেখা যায়।
সচরাচর সাপ কামড়ায় না। যদি কোনো কারণে সাপের গাঁয়ে আঁচড় লাগে তবেই হঠাৎ করে সাপ কামড়াতে পারে। সব সাপ বিষধর নয়। তবে প্রতিটি সাপ থেকেই আমাদের সাবধান থাকা উচিত।
বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ রয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে বর্তমানে অনেক প্রজাতি প্রায় বিলুপ্তির পথে। উইকিপিডিয়াতে থাকা তথ্য অনুযায়ী – বাংলাদেশে প্রায় ৯০ প্রজাতির সাপ আছে। এবং এই সাপের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সাপ নির্বিষ।
তবে বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ, ২৫ তম খণ্ডে Reptilia শ্রেণিতে Squamata বর্গে ৭টি পরিবারে ৪৬টি গণে মোট ৯১টি প্রজাতির যেগুলোকে দেশবাসি সাপ বলে ডাকে সেই ৯১টি প্রজাতি এবং বাংলাদেশের সাপের তালিকায় পরবর্তীতে যুক্ত অন্য তিনটি প্রজাতির পরিবারসহ মোট ৯৪টি প্রজাতির নামের তালিকা বিদ্যমান।
উল্লেখ্য বাংলাদেশে প্রাপ্ত বিষহীন সাপের পরিবারের মধ্যে আছে টিফলোপিডি, বোইডি, অ্যাক্রোকোরিডি, পাইথনিডি ।
এছাড়াও কলুব্রিডি পরিবারেরর প্রাপ্ত অধিকাংশ সাপই নির্বিষ। এছাড়া বাংলাদেশের প্রাপ্ত বিষধর সাপসমূহ মূলত এলাপিডি পরিবারভুক্ত।
এছাড়াও কিছু ভাইপারিডি পরিবারভুক্ত, এবং সামুদ্রিক হাইড্রোফিডি পরিবারভুক্ত সাপও দেখা যায়।
অন্যদিকে, এক জরিপে দেখা গেছে যে, পৃথিবীর শনাক্তকৃত সাপের মধ্যে শতকরা ৮ ভাগ বিষধর। বাকি ৯২ ভাগ বিষধর সাপ নয়। সুতরাং সাপে কামড়ালেই মানুষ বা প্রাণী মারা যাবে তা ঠিক নয়। সাপ কামড়ালে সাধারণ প্রতিক্রিয়ায় মানুষ সাধারণত তিনভাবে মারা যেতে পারে। সেগুলো হলো:
- প্রথমত সাপের কামড় টের পেয়ে বা সাপ দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে তার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর হৃদযন্ত্র বন্ধ হলে মৃত্যু হওয়াটাই স্বাভাবিক।
- দ্বিতীয়ত সাপ বিষধর না হলেও এদের দাঁত বা মুখ গহ্বরে নানা ধরণের মারাত্মক জীবাণু (উদাহরণস্বরুপ টিটেনাস) থাকে তা থেকে ক্ষতের সৃষ্টি ও টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
- তৃতীয়ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা হয় তা হলো যখন কাউকে সাপ কামড় দেয় তখন সেই সাপের বিষক্রিয়াতেই ঐ ব্যক্তি মারা যায়।
আমরা জানি, সাপের বিষ প্রধানত স্নায়ুতন্ত্র ও রক্ত সংবহনতন্ত্রকে আক্রমণ করে থাকে। এই বিষের বিশেষ উপাদান হিমোলাইসিন রক্তের লোহিত কণিকাগুলোকে অল্প সময়ের মধ্যে ভেঙ্গে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
আমরা জানি, সাপের কামড়ের ফলে শরীরে বিষক্রিয়া সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায়। বিষক্রিয়ার কোনো লক্ষণ না দেখা দিলে বুঝতে হবে সাপটি বিষধর নয়।
হাত ও পায়ে সাপের কামড় মুখ ও শরীরের অন্য কোনো অংশের তুলনায় কম মারাত্মক। কিন্তু, শিশু ও বৃদ্ধদের বেলায় এই কামড় বেশি ভয়াবহ হয়ে থাকে।
সাপ কামড়ালে রোগীকে বাড়িতে নিয়ে বসে থাকা যাবে না। আধুনিক যুগে সব ধরণের রোগের অত্যাধুনিক সব চিকিৎসা পদ্ধতি বের হয়েছে। সুতরাং রোগীকে নিকটস্থ মেডিকেলে দ্রুত নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
তবে মেডিকেল যদি দূরে হয় সেক্ষেত্রে রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সামান্য অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়ে যেতে পারে।
সাপ কামড় দিলে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে যা করবেন:
১। সাপ কামড়ালে রোগী সাধারণত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ, এটি সবার কাছেই ভয়াবহ একটি ব্যাপার। সাপ বিষাক্ত হোক কিংবা না হোক। তাই রোগীকে প্রথমে জোর গলায় সাহস দিতে হবে। প্রয়োজনে ডায়াজিপাম জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো যেতে পারে।
২। প্রজাতিটি যদি বিষাক্ত হয় বলে ধারণা করেন তবে সাপ কামড়ানোর সাথে সাথে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে সাপে কাঁটার সামান্য উপরে একটি গিঁট বা বান দিয়ে রাখবেন। গিঁট বা বান অবশ্যই শক্ত করে দিবেন। কাপড় যতোটুকু সম্ভব একটু চওড়া করে নেবেন।
৩। রোগীর যদি পায়ে কামড়ায় তবে উরুতে বান বা গিঁট দিবেন। আর হাতে কামড় দিলে কনুইয়ের উপর বাঁধতে হবে। গিঁট বা বান কিংবা বাঁধন যাতে খুব নরম না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। আর প্রতি আধা ঘন্টা পরপর ৩০ সেকেন্ডের জন্য বাঁধন খুলে দিয়ে আবার বাঁধন বা গিঁট দিয়ে রাখবেন।
৪। রোগীর শরীরের যে স্থানে কামড় দিয়েছে সেই স্থান যেকোন অ্যান্টিসেপটিক কিংবা ভেজা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে দিবেন।
৫। সাপ কামড়ালে খুব বেশি নড়াচড়া করা উচিত নয় বিশেষ করে হাত-পা। কারণ, এতে করে বিষ শরীরের বিভিন্ন স্থানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে ক্রপ ব্যান্ডেজ থাকলে তা ব্যবহার করা যেতে পারে।
৬। রোগীর শরীরে যদি ব্যথা হয় তবে ওটিসি ড্রাগ হিসেবে প্যারাসিটামল খাওয়াতে পারেন। এছাড়া অন্য কোনো পেইনকিলার ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ভুলেও খাওয়াবেন না।
৭। কবিরাজি চিকিৎসার ওপর নির্ভর করে সময়ক্ষেপণ করবেন না। রোগীকে দ্রুত নিকটস্থ মেডিকেলে নেয়ার ব্যবস্থা করবেন। তবে রোগীকে হাঁটানো যাবে না। যেকোন যানবাহনে কিংবা কাঁধে অথবা খাঁটিয়ায় করে নিয়ে যেতে হবে।
আরও পড়ুন: বমি থেকে রক্ষার জন্য যা করবেন।
পরিশেষে বলতে চাই, সাপ একটি বিষধর প্রাণী যদিও সবগুলো প্রজাতি নয়। তবে এই ধরণের বিষাক্ত প্রাণী থেকে আমাদের অবশ্যই সাবধান থাকা উচিত। বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখা উচিত। কোনো জঙ্গলে কিংবা বনে সাবধানে হাঁটা-চলা করা উচিত।
সাপের কামড় আমাদের কারোর-ই কাম্য নয়। যদিও দূর্ঘটনাবশতঃ এরকমটা হয়ে যায় তবে উপরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে দ্রুত মেডিকেলে রোগীকে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ রইলো। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।