সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে বহুদিন ধরেই আলোচনা চলছিল। সবশেষে অবশ্য তা বাস্তবে রূপ পেতে যাচ্ছে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে বিগত ৭ বছর ধরেই আলোচনা চলছিল।
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর থেকে প্রতিবারই সর্বজনীন পেনশনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামালও প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু সময় অনুযায়ী তা হচ্ছিল না বরং শুধু পিছিয়ে যাচ্ছিল।
বর্তমানে নিশ্চিত হয়েছে যে, ১৮ বছরের বেশি বয়স যাদের তাঁরা সবাই এই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আসবেন। দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে এমন আইন করা হয়েছে। গত রবিবার কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে।
অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ঠিক এক বছর আগে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার ওপর একটি কৌশলপত্র তৈরী করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করেছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিল তা করার জন্য। কিন্তু বাকি কাজটুুকু করতে প্রায় ১ বছর অতিরিক্ত সময় লেগে যায়।
অর্থমন্ত্রী এর আগে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, “সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তন হলো জাতির জন্য প্রধানমন্ত্রীর একটি উপহার”।
গতকাল সোমবার অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “এটা আমার প্রথম প্রতিশ্রুতি ছিল। রক্ষা করতে পারছি বলে ভালো লাগছে।” আগামী বছরের জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে তা কার্যকর হবে বলেও জানান তিনি।
অর্থবিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ছয় কোটির বেশি কর্মজীবীর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি কাজ করেন বেসরকারি খাতে।
নতুন ব্যবস্থায় পেনশনভোগীদের স্মার্টকার্ড দেয়া হবে এবং ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থা রাখা হবে। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সাড়ে ১১ লাখের বেশি সরকারি চাকরিজীবি পেনশন সুবিধার আওতায় রয়েছেন।
১৯৭৪ সালে সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি বিভিন্ন করপোরেশনের কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত করে গণকর্মচারী (অবসর) আইন প্রণয়ন করা হয়।
এই আইনের মাধ্যমে গণকর্মচারীদের চাকরি জীবনের সর্বশেষ উত্তোলনকৃত বেতনের একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণ (সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ) পেনশন দেয়ার ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
সর্বজনীন পেনশন:
২০৩০ সালের মধ্যে সরকার সারা দেশে এ পেনশন ব্যবস্থা চালুর কথা ভাবছে, অর্থবিভাগ এমনটিই জানিয়েছে। আইন বিশ্লেষণ করে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য কিছু দিক জানা গেছে। সেগুলো দেখে নিতে পারেন।
- ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সব কর্মক্ষম নাগরিক সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
- পেনশনধারীরা আজীবন, অর্থাৎ মৃত্যুর আগপর্যন্ত পেনশনসুবিধা ভোগ করবেন।
- বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন এতে।
- সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীরা আপাতত সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার বাইরে থাকবেন। ভবিষ্যতে তাঁদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
- জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে নাগরিকেরা পেনশন হিসাব খুলতে পারবেন।
- প্রাথমিকভাবে এ পদ্ধতি স্বেচ্ছাধীন থাকবে, তবে পরবর্তী সময়ে বাধ্যতামূলক করা হবে।
- ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়া সাপেক্ষে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবেন নাগরিকেরা।
- প্রতিটি নাগরিকের জন্য আলাদা পেনশন হিসাব থাকবে, চাকরি পরিবর্তন করলেও অপরিবর্তিত থাকবে এ হিসাব।
- সর্বজনীন পেনশনপদ্ধতিতে ব্যক্তির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানেরও অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে কর্মী বা প্রতিষ্ঠানের চাঁদা নির্ধারণ করে দেবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।
- মাসিক সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারিত থাকবে। তবে প্রবাসী কর্মীরা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতেও চাঁদা জমা দিতে পারবেন।
- সুবিধাভোগীরা বছরে ন্যূনতম বার্ষিক জমা নিশ্চিত করবেন। অন্যথায় তাঁর হিসাব সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যাবে এবং পরবর্তী সময়ে বিলম্ব ফিসহ বকেয়া চাঁদা দেওয়ার মাধ্যমে হিসাব সচল করার সুযোগ থাকবে।
- সুবিধাভোগীরা আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে চাঁদা হিসেবে বাড়তি অর্থ (সর্বনিম্ন ধাপের অতিরিক্ত যেকোনো অঙ্ক) জমা করতে পারবেন।
- ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভূত লভ্যাংশসহ জমার বিপরীতে নির্ধারিত হারে পেনশন পাবেন গ্রাহকেরা।
- নিবন্ধিত চাঁদা জমাকারী পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে জমাকারীর নমিনি বাকি সময়কালের (মূল জমাকারীর বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) জন্য মাসিক পেনশন পাবেন।
- পেনশন কর্মসূচিতে জমা করা অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। তবে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমা করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে উত্তোলন করা যাবে, যা সুদসহ পরে পরিশোধ করতে হবে।
- কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে নিবন্ধিত চাঁদাদানকারী মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তাঁর নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে।
- পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে।
- এ ব্যবস্থা স্থানান্তরযোগ্য ও সহজগম্য, অর্থাৎ কর্মী চাকরি পরিবর্তন বা স্থান পরিবর্তন করলেও তার অবসর হিসাবের স্থিতি, চাঁদা প্রদান ও অবসরসুবিধা অব্যাহত থাকবে।
- নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন কর্মসূচিতে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে।
- তহবিলে জমা করা টাকা নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী বিনিয়োগ করবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আর্থিক রিটার্ন নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা করবে।
- পেনশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ করবে সরকার।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। পেনশন ব্যবস্থা চালু হলে সর্বস্তরের মানুষ উপকৃত হবে। পেনশন ব্যবস্থায় মানুষ যাতে টাকা রাখতে এবং টাকা তুলতে গিয়ে হয়রানির স্বীকার না হয় সেদিকটায় নজর রাখতে হবে সরকারকে।
উৎস: প্রথম আলো (সামান্য পরিমার্জিত)
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে – সবাইকে সাবধান থাকার আহবান