পৃথিবীতে যতো সুখ আছে সব সুখই যেন সন্তানহীন মা-বাবার কাছে কেবল আগাছা মাত্র। এই কথাটা যাদের সন্তান নেই তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করুন তাহলে এর চেয়ে কঠিন উত্তর পাবেন হয়তো।
আমরা যারা অবিবাহিত তাদের কাছে বিষয়টি অতোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে নাও হতে পারে। কিন্তু যারা বিয়ে করেছে তাদের কাছে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিয়ের পরে প্রতিটি দম্পতিই চায় তাদের অন্তত একটা সন্তান থাকুক। কিন্তু কয়েক বছর ট্রাই করার পরেও যদি সন্তান না হয় তখন তাদের মাথায় চিন্তা প্রবেশ করে। স্বামী মনে মনে স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ চাপাতে থাকে আবার স্ত্রী মনে মনে স্বামীর প্রতি সন্দেহ চাপাতে থাকে।
খুব সুখের সংসার হয়তো ভেঙে যায় কিংবা থেকে যায় অগোছালোর মতো। স্বামী স্ত্রী একই সাথে থাকে কিন্তু থাকে না কোন সুখ কিংবা ভালোবাসা।
সবার কথা বলছি না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটে। সন্তান না হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। স্বামী অথবা স্ত্রীর মধ্যে একজন-তো দায়ী হবেন-ই কিংবা উভয়েরই সমস্যা থাকতে পারে।
নিজেদের এমন পরিস্থিতি মেনে নিয়ে অনেক দম্পতিই সংসার করে কিন্তু সংখ্যাটা আসলে নগন্য। আর যারা সবকিছু জেনেও সংসার করে তারা পৃথিবীতে আসলে এক প্রকার ভিন্ন রকমের মানুষ। তাদের ভালোবাসাটা আবার সবার সাথে মেলানো যাবে না।
আজ আমি কয়েকজনের কথা বলবো যাদের জীবনে আসলে ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ঘটেছে। জানলে আপনার অভিজ্ঞতা হবে এবং অনেক অজানা তথ্যও জানতে পারবেন।
আমার এলাকার ইউনুজ আলী। উনি যখন বিয়ে করেছেন তখন কয়েক বছর তাদের সন্তান হয়নি। সবাই বলাবলি করেছে যে, ইউনুজ আলীর স্ত্রী বন্ধ্যা। ইউনুজ আলীকেও মানুষে অনেক কথা বলেছে। আগে আসলে কোন দম্পতির যদি সন্তান না হতো তাহলে কোন প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কেবল স্ত্রীর দোষ দেওয়া হতো।
কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানের কাছে সব ধরণের ভাওতাবাজি ধরা খেয়েছে। এখন কোন দম্পতির সন্তান না হলে প্রাথমিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ (স্বামী অথবা স্ত্রীর বা উভয়ের) খুঁজে বের করা যায়। তখন বোঝা যায় আসলে কার জন্য সন্তান হচ্ছে না।
যখন ইউনুজ আলীর কয়েক বছর সন্তান হলো না – তখন নিজেদের সন্তান আর হবে না মনে করে পাশের গ্রামের একজনের কাছ থেকে একটি ছেলে সন্তান দত্তক নেয়। গ্রামের ভাষায় বলা হয় পুইনা নেয়া (পঞ্চগড়ের আঞ্চলিক ভাষা)।
আর সেই সন্তান দত্তক নেয়ার ২ বছরের মাথায় ইউনুজ আলীর ছেলে সন্তান হলো। তারপর এক বছর পরে আবার হলো। এভাবে ইউনুজ আলীর মোট চারটি ছেলে সন্তান হলো। দত্তক নেয়া সন্তানসহ মোট ৫ সন্তান।
তাহলে দেখুন, আল্লাহ কি না পারে। অবশ্যই আমাদের আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন। কিন্তু যা করেন সব মানুষের মঙ্গলের জন্যই।
ইউনুজ আলীর ৬ ছেলের মধ্যে (দত্তকীয় সন্তান বাদে) এক ছেলে মারা যায়। বাকি সবাই এখনও জীবিত আছে এবং সংসার করছে। কিন্তু ইউনুজ আলী কয়েক বছর আগে মারা যায়। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তিনি দত্তকীয় সন্তানকে তেমন কোনো সম্পত্তি দিয়ে যাননি যতোদূর জানি।
দত্তক নেয়ার পরে তাদের মুখে হাসি ফুটেছিল অন্তত এই ভেবে যে, আমরা একটি সন্তানকে আমাদের পরিচয়ে বড় করতে পারবো। কিন্তু নিজের সন্তান হওয়ার পরে অপরের কাছ থেকে নেওয়া সন্তানের প্রতি আসলে মায়া অটোম্যাটিক কমে যায়।
অন্যদিকে, হাইদালী নামক এক ব্যক্তি ছিল আমাদের এলাকায়। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। সাধারনভাবে খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন। তিনি বিয়ে করার পর থেকে তার কোনো সন্তান হয়নি।
এরপর ইউনুজ আলীর মতো তিনিও পাশের এলাকা থেকে একটি ছেলে সন্তানকে দত্তক নেন। তাকে লালন পালন করে মানুষ করতে থাকেন। সেই ছেলে বড় হয়, সেই ছেলে বিয়েও করে এবং তার ঘরে সন্তানও হয়।
তখন শেষ বয়সে হাইদালী সাহেব এর স্ত্রী হঠাৎ মারা যায়। মারা যাওয়ার সময় উনার স্ত্রীর বয়স হয়েছিল অন্তত ৬০ বছর। তাহলে হাইহালী সাহেব এর বয়স কতো হয়েছে ভাবলেই উত্তর পাবেন।
স্ত্রী মারা যাওয়ার যতোদূর জানি তিন মাসের মাথায় হাইদালী সাহেব আরেকটি বিয়ে করেন। আর বিয়ের ১ বছরের মাথায় তার ঘরে একটি ছেলে সন্তান হয়। তিনি পরের বছর আবার সন্তান নেন। তখনও তার একটি ছেলে সন্তান হয় অর্থাৎ সন্তানহীন অভিশাপ/যন্ত্রণা থেকে তিনি মুক্তি পেলেন।
তাহলে দেখুন, যে ব্যক্তিটি তার বন্ধ্যা স্ত্রীকে নিয়ে সারাটা জীবন পার করলো অথচ কোনদিন স্ত্রীর প্রতি এতটুকু অসন্তুষ্ট ছিলো না। নিশ্চয়ই প্রকৃত ভালোবাসা ছিলো। স্ত্রী মারা গেলে বিয়ে করার মাধ্যমে প্রকৃত ভালোবাসা কখনো শেষ হয়ে যায় না। এটা যারা বলে তারা ভুল বলে। ইসলামে এটার পূর্ণ অনুমোদন আছে। বরং একা থেকে গোনাহ করা সবচেয়ে খারাপ বিষয়।
আবার আরেকটি দম্পতি আমি দেখেছি যারা আজ ৫ বছর হলো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তাদের কোনো সন্তান হয়না অর্থাৎ তারা সন্তানহীন। যে যা বলেছে তাই করেছে, যেখানে যাওয়ার কথা বলেছে তাই গিয়েছে কিন্তু সন্তান হয়না।
স্বামী-স্ত্রী দুজনই ডাক্তারী সব ধরণের পরীক্ষা করেছে অথচ সেখানেও কোনো সমস্যা নেই কারোরী। তাহলে ভাবুন তো – এই দম্পতি আসলে কেমন আছে।
আমি তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি। তারা দুজনই খুব ভালো মানুষ। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে না তারা অসুখী। কিন্তু সন্তান না থাকার বিষয়টি তাদের সবসময়ই কাঁদায়।
প্রকৃত অর্থে তারা আসলে সুখী নয়। কিন্তু দুজন-দুজনার প্রতি কেবল ভালোবাসার টানে সংসারটা টিকিয়ে রেখেছে। স্বামীর মনে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, আমি হয়তো অন্য কাউকে বিয়ে করলে আমার সন্তান হতো। স্ত্রীর মনেও এরকম আকাঙ্খা আসতে পারে যে, আমি হয়তো অন্য কোন পুরুষকে বিয়ে করলে হয়তো মা হতে পারতাম।
আসলে এই জগতে কেউ পরিপূর্ণ না। সবারই কোনো না কোনো অভাব রয়েছে। কিন্তু অভাবের মধ্যে কেবল ভাগ রয়েছে। বড় বড় অট্টালিকার মালিক হলেই সুখী হওয়া যায় না। গাছ তলায় থেকেও সুখে থাকা যায় যদি সংসারে সন্তান না থাকার মতো অভাব না থাকে।
সন্তানহীন মা-বাবার মনের কষ্টটা কেবল তারাই অনুভব করে। হয়তো রাতের আধারে তারা অনেক কাঁদে। আমরা কেউ সেটা দেখিও না এবং বুঝিও না। শুধু সময়ে সময়ে নানারকম মন্তব্য করতে পারি।
যাদের সন্তান হয় না (সন্তানহীন) তাদের স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ের জন্যই কিছু পরামর্শ থাকবে। প্রথমত, বিয়ের পরে ২ বছরের মাথায় সন্তান নেয়ার ট্রাই করুন। সর্বোচ্চ তিন বছর কিন্তু তিন বছর পার করাটা বোকামি।
আবার বিয়ের পরপরই অনেক মেয়ে জন্ম নিরোধক পিল খাওয়া শুরু করে। মাসের পর মাস খেতেই থাকে। দেখা যায় যে, একটানা কয়েক বছর খেয়ে ফেলে।
তখন তাদের সন্তান হয় না। হলেও অনেক দেরি হয় সেটা কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। সব ওষুধেরই সাইড ইফেক্ট রয়েছে মনে রাখবেন।
আরেকটা ব্যাপার হলো যে, সব ওষুধ সবার শরীরে সমানভাবে শুট করে না অর্থাৎ কাজ করে না। সুতরাং জন্মনিরোধক পিলগুলোও এমন। কারও শরীরে শুট করে আবার কারও ক্ষেত্রে নানারকম উপসর্গ দেখা দেয়।
প্রয়োজনে কনডম ব্যবহার করুন কিংবা বীর্য বাইরে পতিত করুন। কিন্তু কনডম ব্যবহার করাটাই উত্তম। আরো অনেক পদ্ধতি রয়েছে। নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে এ ব্যাপারে পরামর্শ নিতে পারেন।
আর সন্তান না হলে আজেবাজে জায়গায় বেশি ঘুরোঘুরি করবেন না। এখন বিজ্ঞানের যুগ। এখন আর কুসংস্কার নিয়ে পড়ে থাকার সময় নেই। সন্তানহীন দম্পতির কোনো না কোনো কারন বের হবেই।
তাই এমন সমস্যার মুখোমুখি হলে সবার আগে স্বামী স্ত্রী উভয়ই ডাক্তারের কাছে যান এবং ভালো মতো সব কিছু পরীক্ষা করুন। কার সমস্যা এবং কি সমস্যা আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা করুন।
দুজনের সমস্যা হলে তো কথাই নেই। কিন্তু একজনের সমস্যা হলে প্রয়োজনে সেটা মেনে নিতে হবে অথবা সুদূরপ্রসারী কোনো পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। তবে সংসার ভেঙে যাক এ কথা আমি বোঝাতে চাইনি।
আরও পড়ুন: ফার্মেসী থেকে ভেজালমুক্ত ওষুধ কেনার উপায়।
সবাই ভালো থাকবেন। হয়তো সন্তানহীন মা-বাবা নিয়ে এই পোস্টটি আপডেট হতে পারে। আপনারা আপডেট চাইলে দয়া করে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানান। তাহলে আমি উৎসাহিত হবো এবং নতুন নতুন লেখা আপনাদের উপহার দিতে পারবো।
লেখক: মো. আজগর আলী (করতোয়া.কম এর সম্পাদক ও প্রকাশক)