বর্তমান সমাজে তাকালেই বোঝা যায় শিক্ষিতের হার বাড়ছে কিন্তু মান বাড়ছে না। এক কথায় বিশ্লেষণ করে বলা সম্ভব নয়। তাই বিস্তারিত বলতে হবে।
শিক্ষিত হওয়া এবং বিবেকবান হওয়া এক জিনিষ নয়। একজন ব্যক্তি শিক্ষিত না হয়েও বিবেকবান হতে পারে। অনেকেই অনেক অনেক পড়াশোনা করেও বিবেকবান হতে পারে না।
আসলে এটা হলো মনস্তাত্বিক ব্যাপার। আমরা সমাজে শিক্ষিতের হার দিয়ে আসলে কি করবো যদি তাদের মধ্যে বিবেক না থাকে। সমাজের কোনো উন্নয়ন, মানুষের জন্য উন্নয়ন তাদের দিয়ে যদি না হয় তবে এত এত শিক্ষিত দিয়ে কি হবে?
হেডলাইনে বলা হয়েছে, শিক্ষিতের হার বাড়ছে কিন্তু মান বাড়ছে না কেন? হ্যা, এটাই ঠিক যে, শিক্ষিতের হার বাড়ছে কিন্তু মান বাড়ছে না।
অর্থাৎ শিক্ষার মান বাড়ছে না। কয়েক বছর আগে কেউ যদি ম্যাট্রিক পাশ করতো তাহলে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে তাদের দেখে যেতো। তখন শিক্ষার মান ঐ পর্যায়েই ছিলো।
কিন্তু এখন ভুরি ভুরি এ প্লাস, গোল্ডেন এ প্লাস পাচ্ছে প্রতি বছর। অথচ এদের মেধা যাচাই এবং শিক্ষার মান যাচাই যদি করা হয় তবে দেখবেন দুই একজন বাদে বাকিরা ফেইল করবে সুনিশ্চিত।
ছোটরা এখন বড়দের সম্মান করতে ভুলে যাচ্ছে। তাহলে একটা বাচ্চা স্কুলে গিয়ে আসলে কি শিখছে? ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেনে পড়া বাচ্চারা বড়দের সামনে সিগারেট টানছে।
তাহলে এই বাচ্চাটা ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত আসলে কি শিখলো? শিক্ষার মান আজ কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন।
বর্তমানে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকরা ছাত্রদের হাতে লাঞ্চিত হচ্ছেন। বিষয়টি বর্তমান সমাজের জন্য লজ্জাজনক। যাদেরকে দেশের ভবিষ্যত মেরুদন্ড বলা হচ্ছে তারা আসলে চারিত্রিক দিক থেকে কোথায় গিয়ে পৌছেছে ভাবার বিষয়।
শিক্ষার হার দিয়ে আমাদের তেমন কিছু আসে যায় না। এটা শুধুমাত্র একটি পরিসংখ্যানগত তথ্য। শিক্ষার হার দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে একথা অস্বীকার করা যায় না।
কিন্তু শিক্ষার মান নিয়ে যদি প্রশ্ন থাকে তবে শিক্ষার হার নিয়ে সত্যিই ভাবার বিষয়। গোয়াল ভরা বন্ধ্যা গরু দিয়ে আপনি কতোটা লাভবান হতে পারবেন নিজেই একটু ভাবুন।
একটি ছেলে বা মেয়ে জীবনের শুরু থেকেই বিদ্যালয়ে যায়। বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সাথে নৈতিকতা শেখানো হয়। মানুষকে সম্মান করা শেখানো হয়। ভদ্র ব্যবহার শেখাতে হয়।
এখন যদি ঐ ছেলে বা মেয়ের মধ্যে এসব গুণের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না তবে তাকে আপনি শিক্ষার হার এর অন্তর্ভুক্ত কি করবেন?
আধুনিক যুগে মোবাইল ফোনের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা নানা দিক থেকে কলুষিত হচ্ছে। অথচ যে পরিবার থেকে তাকে মোবাইল ফোনটি দেয়া হলো সেই পরিবারটি কখনো ভেবেছে কি যে, আদৌ তার মোবাইল ফোনটি প্রয়োজন আছে কিনা কিংবা এটি দিয়ে সে কি করছে?
তাহলে ঐ পরিবারটাও আসলে অসচেতন। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তেমন কিছু চিন্তা করে না। হয়তো ঐ পরিবারটি আর্থিক দিক থেকে অনেক ভালো পর্যায়ে রয়েছে।
আপনি এমনও ছাত্রছাত্রী পাবেন যারা ডিগ্রী বা অনার্স পাশ করেছে কিন্তু ইংরেজীতে নিজের সম্বন্ধে কিছু বলতে পারে না। কারও সাথে শুদ্ধভাবে কথাও বলতে পারে না। পাঁচ তারকা একটি হোটেলে ছেড়ে দিলে তারা এটাও বুঝবে না যে, কিভাবে খাবার খেতে হয়।
তাহলে শিক্ষার হার তো বাড়লো। কিন্তু মান কোথায় হারিয়ে গেলো। প্রতি বছর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী ডিগ্রী বা অনার্স পাশ করে বের হচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষায় অসংখ্য ছাত্রছাত্রী এ প্লাস বা গোল্ডেন এ প্লাস পাচ্ছে। অথচ তারা “আমি পরীক্ষায় এ প্লাস পেয়েছি” এই লাইনটির সঠিক ইংরেজী বলতে পারে না।
সবার কথা বলছি না। এরকম অনেকেই আছে। এই বিষয় নিয়ে বহু সংবাদপত্র সংবাদ প্রচার করেছে। আপনি ইউটিউবে সার্চ করলে বহু ভিডিও পেয়ে যাবেন।
তাহলে একটু চিন্তা করুন যে, এরকম শিক্ষার হার দিয়ে আমরা কি করবো? ভবিষ্যত প্রজন্ম কোথায় গিয়ে দাড়াবে?
আপনারা যদি বিভিন্ন জায়গার সাইনবোর্ড বা বিলবোর্ড বা প্লে কার্ডগুলো লক্ষ্য করেন দেখবেন যে, কোথাও না কোথাও ভুল আছেই। সেদিন দেখলাম, একটি ফার্মেসী দোকান উদ্বোধন হলো। সেখানে বড় করে উদ্বোধন বানাটি লিখেছে “উদ্ভোধন” এরকম করে।
এরকম আজগুবি সব বানান চোখে পড়লেই বোঝা যায়, প্রতিটি সেক্টরে যারা শিক্ষিত হয়ে কাজ করছে তারা আসলে কতোটা শিক্ষিত।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনি যদি লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন যে, যতো রকমের আজগুবি কথা-বার্তা রয়েছে তা সেখানে পাওয়া যায়।
২০ লাইনের একটি প্যারার মধ্যে অন্তত ৫ থেকে ৭ টি বানান ভুল পাবেন। বাক্যগুলোও ভুল আছে। পোস্টকারী যদি সচেতন হতেন এবং সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতেন তবে এরকম করে নিশ্চয়ই পোস্ট করতেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় বানান ভুল ধরা পড়ে তাদের দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে। তাহলে দেশ দিনের দিন কোথায় যাচ্ছে। আমরা শুধু স্বার্থ আর টাকার পিছনে ছুটছি।
এখনকার বাচ্চারা পড়াশোনা করেই কোনো চাকরি করার উদ্দেশে। তারা তো মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষা গ্রহণ করে না। স্কুলের শিক্ষকদের ব্যবহারেও আসলে এমনটা প্রকাশ পায়। সব শিক্ষক নয় – কিছু কিছু শিক্ষক।
তো যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম যে, শিক্ষিতের হার বাড়ছে কিন্তু শিক্ষার মান বাড়ছে না। এর পেছনের কিছু কারণ নিয়ে উপরে কথা বলেছি।
আরও অনেক কারণ রয়েছে। একজন ছাত্র যখন সামান্য বেতনের একটি সরকারি চাকরির জন্য সর্বস্ব বিক্রি করে কয়েক লক্ষ টাকা ঘুষ দেয় তখন চাকরি পাওয়ার পরে সে সৎ থাকবে এটা আসলে অসম্ভব।
কারণ, যে টাকা বেতন দেয়া হয় এটা দিয়ে ভালো করে সংসার চালানোই মুশকিল। সংসার বাদে তো আরও অনেক খরচ থাকে।
প্রযুক্তিগত কারণে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা কমে যাচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা যতো সহজ হচ্ছে মানুষের সাথে মানুষের মনের যোগাযোগ ততোই কঠিন হচ্ছে। সব কিছু হয়ে যাচ্ছে ভার্চুয়াল।
তবে প্রতিটি বিদ্যালয়ে যদি শিক্ষকরা মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করান, মোবাইল ফোনের অপব্যবহার বন্ধ করা হয়, শাসন ব্যবস্থা যদি চালু করা হয় তবে হয়তো কিছু সংখ্যক মেধাবীরা সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠবে।
মানুষ হয়ে মানুষের জন্য নিশ্চয়ই তারা কিছু করবে। পরিবারগুলোকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। যে পরিবারগুলো কঠোর খোঁজ নিয়ে দেখুন সেই পরিবারের ছেলেমেয়েরা একটু হলেও ভালো করছে সব ক্ষেত্রে।
শিক্ষিতের হার না বাড়িয়ে শিক্ষার মান বাড়াতে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে শুধু নয়, সবক্ষেত্রে দূর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
আরও পড়ুন: সরকারি হাসপাতাল – চিকিৎসা, মৃত্যু, অভিজ্ঞতা ও মতামত।
ভার্চুয়াল জগত ব্যবহারে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের সাবধান করতে হবে। তাহলেই হয়তো আমরা সুন্দর একটি দেশ পাবো যেখানে শিক্ষার হার কম থাকলেও বিবেক ও মনুষত্ব সম্পন্ন মানুষের হার সবচেয়ে বেশি থাকবে।