শান্তি আমরা সবাই খুঁজি। কিন্তু শান্তি পাওয়ার জন্য যা করা দরকার, যেটুকু করা দরকার তা আমরা করি না। অনেক বেশি করে ফেলি। অনেক বেশি চেয়ে ফেলি। নিজেকে তৃপ্ত রাখতে পারিনা।
এখানে একটি গল্পের মাধ্যমে বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মনোযোগ দিয়ে পুরো ঘটনাটি পড়ুন। তাহলে বাস্তব জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু বুঝতে পারবেন।
“আমার এক বন্ধু বিশাল শিল্পপতি। ১০ টার উপর ফ্যাক্টরি, শত কোটি টাকার উপর ব্যাংক লোন। এক মুহূর্তের জন্য শান্তি নেই। সারাদিন ব্যস্ত দুনিয়ার পেছনে। একদিন তাঁর অফিসে বসে গল্প করছিলাম, এমন সময় তাঁর এক কর্মচারী আসলো। তার কোন কারণে কিছু টাকার দরকার। সে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, সে অত্যন্ত অভাবী ব্যক্তি, তাঁকে সাহায্য করার জন্য।
আমার বন্ধু হেসে বলল ”যদি অভাবের কথাই বলতে হয়, এই পুরো অফিসে আমার চেয়ে অভাবি আর কেউ নেই। আমরা একটু থতমত হয়ে গেলাম। আমি বললাম ‘আমাদের সবার সব মিলিয়ে যত সম্পদ আছে তোর একারই তার বেশি আছে।’
সে বলল তোদের একটা গল্প শুনাই। তাহলেই আমার অভাবের রহস্য বুঝবি। এক বিশাল ব্যবসায়ী, তাঁর সবই আছে খালি শান্তি নেই। খালি হাহাকার আর টেনশন। চিন্তায় মাথার চুল একটাও বাকি নেই। সে একদিন দেখল তাঁর অফিসের পিয়ন টেবিল মুছছে আর গুনগুন করে গান গাচ্ছে।
সে পিয়নকে ডেকে বলল, এই যে- তুমি মনে মনে গান গাও, তোমার কি অনেক সুখ, তোমার মনে কি কোন দুঃখ নেই, কোন হতাশা নেই?
পিয়ন বলে না, হতাশা কেন থাকবে স্যার, আপনি যা বেতন দেন তা দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ আমার ভালই চলে যায়। আল্লাহর রহমতে কোন অভাব নেই।
ব্যবসায়ী তো আরও টেনশনে পড়ে গেলেন। ওনার ম্যানেজারকে ডেকে বললেন, আমার সব আছে কিন্তু শান্তি নেই, আর ওই লোককে আমি সামান্য কয় টাকা বেতন দেই, সে আছে মহা সুখে, এর রহস্যটা কি?
ম্যানেজার বলল, রহস্য বললে বুঝবেন না। সত্যিই যদি বুঝতে চান তাহলে ওই পিয়নকে প্রমোশন দিয়ে একটা বড় পোস্টে দিন। আর তাঁকে ১০ লক্ষ টাকা দিয়ে দিন। এরপর দেখুন কি হয়?
ব্যবসায়ী তাই করলো। এতোগুলো টাকা আর এতবড় চাকরি পেয়ে পিয়ন আনন্দে আত্মহারা। বাসায়ও সবাই খুশি। যেহেতু এখন অফিসার হয়ে গেছে, এখন তো আর টিনের ঘরে থাকা যায়না। কলিগরা কি মনে করবে!
প্রথমেই বাসা পরিবর্তন করে আরেকটু অভিজাত এলাকায় এপার্টমেন্টে উঠলো। দেখল, বিল্ডিং এর সবাই সন্তানকে বড় স্কুলে পাঠায়, তাই বাচ্চার স্কুলও চেঞ্জ করতে হল।
কিছুদিন পড় বউ ঘ্যান ঘ্যান শুরু করলো সবার বাসায় কত দামি আসবাব, ফ্রিজ, টিভি, আর আমাদের বাসায় কিচ্ছু নেই। ওগুলোও কিনতে হোল। এরপর শুরু হলো বাচ্চার প্রাইভেট টিউশান, নানা রকম দাবি দাবা। আগে ঈদে এক জোড়া জুতা পেয়েই সবাই কত খুশি হতো আর এখন প্রতি মাসে এক জোড়া দিলেও তৃপ্তি নেই।
যেহেতু সে এখন বড় চাকরি করে পরিবারের সবার তাঁর কাছে প্রত্যশাও অনেক। সাধ্যমত চেষ্টা করে, তাও সবার চাহিদা মেটাতে পারেনা। আত্মীয় স্বজন বন্ধু-গন তাঁকে অহংকারী ভেবে দুরে সরে গেলো।
এদিকে অফিসের সবাই ফ্লাট/প্লট এ বুকিং দিচ্ছে। বৌ সারাদিন বাসায় খোটা দেয়, তোমাকে দিয়ে কিছুই হবেনা। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সে চাকরির ফাঁকে একটা দুইটা টিউশনি করা শুরু করলো।
তাতেও কিছু হয়না। নানাবিধ টেনশন আর দুশ্চিন্তায় তারো মাথার চুল আসতে আসতে কমতে লাগলো। ব্যবসায়ী লক্ষ্য করলেন ব্যাপারটা। উনি বললেন- কি ব্যপার, তোমাকে এতো বড় প্রমোশন দিলাম, এতো টাকা দিলাম, আর এখন দেখি তুমি আগের মত আর প্রাণবন্ত নেই। ঘটনা কি?
সে বলল স্যার , কিছু দুনিয়াবি সম্পদ দিয়েছেন কিন্তু তাঁর সাথে যে এতো চাহিদা আর অভাব আসবে সেটাতো আর বুঝিনি। আগে আমার কিছুই ছিলনা, অভাবও ছিলনা। আর এখন যেদিকেই তাকাই খালি নাই আর নাই। আগে আমার অভাব পড়লেও সেটা ছিল এক দুই হাজারের ব্যাপার। কোনভাবে মেটান যেত। আর এখন আমার অভাব লক্ষ কোটি টাকার। এটা কিভাবে মেটাবো সে চিন্তায় আমার এখন আর রাতে ঘুম আসেনা স্যার।
ব্যবসায়ি বলল, এতদিনে বুঝলাম, আমার মুল অসুখ। এক টাকার সম্পদের সাথে ২ টাকার অভাব আসে। যতই দুনিয়ার পিছনে ছুটি কবরের মাটি ছাড়া এই অভাব আর অন্য কিছু দিয়েই পূর্ণ হবেনা।
আদম সন্তানের যদি স্বর্ণে পরিপূর্ণ একটি উপত্যকা থাকে, তবে সে (তাতে সন্তুষ্ট হবে না, বরং) আরেকটি উপত্যকা কামনা করবে । তার মুখ তো (কবরের) মাটি ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা ভর্তি করা সম্ভব নয় । যে আল্লাহর দিকে রুজু করে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন (বুখারী)।
আশা করি, গল্পটি থেকে অনেক কিছু বুঝতে পারছেন। শান্তি কোথায় আছে নিশ্চয়ই তা বুঝতে পারছেন। অতিরিক্ত চাহিদার মধ্যে শান্তি নেই।
নিজেকে যতোটা কম কিছুতে পরিপূর্ণ রাখতে পারবেন, তৃপ্ত রাখতে পারবেন ততোই ভালো থাকবেন। সুখটা আসলে এখানেই। সবাই ভালো থাকবেন।
আরও পড়ুন: আমরা মানুষ’রা উন্নত হওয়ার সাথে সাথে অসভ্যও হয়ে যাচ্ছি – কেন ও কিভাবে?