শরীরের দূর্বলতা:
মানব শরীর সবসময় একরকম থাকে না। যেকোন কারণবশতঃ শরীর দূর্বল হতেই পারে। যখন শরীর দূর্বল হয় তখন কোনো কিছু ভালো লাগে না। ক্লান্তি লাগে। কারও কথাও ভালো লাগে না।
কোনো কিছু খেতেও মন চায় না। দুনিয়া অসহ্য মনে হয়। কোনো কাজে মন বসে না। শরীর শুধু ম্যাজ-ম্যাজ করে। আজ আমরা জানবো শরীর কি কি কারণে দূর্বল হতে পারে এবং সেগুলো থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে।
বিভিন্ন কারণে শরীর দূর্বল হয়। কিছু গোপণ কারণও রয়েছে যেসব নিয়ে আমরা সচরাচর ভাবি না। কিন্তু হঠাৎ সাধারণ দূর্বলতা হতে পারে বিরাট অসুখের কারণ। যেসব কারণে শরীর দূর্বল হতে পারে তা নিচে উল্লেখ করা হলো:
হৃদপিণ্ডের সমস্যা: হঠাৎ শরীর অত্যাধিক দূর্বল হয়ে পড়লে কারণ হিসেবে হৃদপিণ্ডের সমস্যাকে দায়ী করা যায়। হৃদপিণ্ড সাধারণত রক্ত সঞ্চালনের জন্য কাজ করে।
যদি কখনো এই রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয় তাহলে শরীরের কোষগুলোতে ঠিকমতো রক্ত পৌছায় না। ফলশ্রুতিতে রক্তে থাকা কোষের জন্য দরকারী উপাদানগুলোও পৌছায় না।
আর তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনি দূর্বল হয়ে পড়ার কথা। তাই হঠাৎ খুব বেশি দূর্বলতা অনুভব করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
রক্তের ঘাটতি: বিভিন্ন কারণে শরীরে রক্তের পরিমাণ কমে যেতে পারে। কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- অর্শ্ব থেকে রক্তপাত, বিভিন্ন ক্রণিক রোগ, রক্তস্রাব, ভিটামিনের ঘাটতি ইত্যাদি।
কারও কারও জন্ম থেকে রক্তে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতির কারণেও এমনটা হয়ে থাকে। উপরের কারণগুলোর মধ্যে রক্তস্বল্পতা বিষয়টি অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহিৃত।
লিভারের অসুখ: যেকোন ব্যক্তি অতিরিক্ত মদ্যপান এবং ধুমপান করলে লিভার এর বিভিন্ন প্রকার অসুখে আক্রান্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, বার বার জন্ডিস হলেও লিভারের রোগ হয়।
লিভারের রোগ হলে চিন্তাশক্তি কমে যায়, রক্ত বমি হয়, অবসাদ বোধ পরিলক্ষিত হয়, পা ও পেট ফুলে যায়। এই সময় শরীর মারাত্মকভাবে দূর্বল হয়ে পড়তে পারে।
ডায়াবেটিস রোগ: আপনি যদি ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তবে আপনি অনেকটা দূর্বলতা অনুভব করবেন। ডায়াবেটিস হলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়।
প্রস্রাবের সাথে সুগার বের হয়ে যায়। শুধু দূর্বলতাই নয়, ডায়াবেটিস হলে আপনার হৃদপিণ্ড, কিডনী এবং চোখের দৃষ্টি শক্তির মারাত্মক সব সমস্যা দেখা দিতে পারে।
একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখবেন, ডায়াবেটিস নিজে কোনো রোগ নয় – ডায়াবেটিস কেবল বিভিন্ন রোগ সৃষ্টির মাধ্যমে শরীরে নানারকম জটিলতার সৃষ্টি করে।
কিডনী রোগ: কিডনী শরীরের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এটি মূলত ছাকনীর ন্যায় কাজ করে। কিডনীর প্রধান কাজ হলো প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বিষাক্ত ও বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়া।
কিডনীর কোনো সমস্যা হলে শরীর থেকে বিষাক্ত ও বর্জ্য পদার্থগুলো ঠিক মতো বের হয়ে যেতে পারে না। আর তখন প্রতিক্রিয়া স্বরূপ শরীরে দূর্বলতা সহ নানাবিধ রোগ লক্ষণ দেখা দেয়।
আমিষের অভাব: আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই তাদের প্রতিদিনের আমিষের চাহিদা কোনভাবেই পূরণ করতে পারে না। সাধারণত ছানা, ডিম, সবুজ শাকসবজি, পনির, মাছ-মাংস ইত্যাদিতে আমিষ রয়েছে।
শরীরে যখন আমিষের ঘাটতি হয় তখন সাধারণত হাত-পা ও মুখ ফুলে যাওয়া, পেটে পানি আসা ও শরীর দূর্বলতার মতো লক্ষণ দেখা দেয়।
থাইরয়েড হরমোনের অভাবজনিত রোগ: এটি মূলত একটি গ্ল্যান্ড। সাধারণত খাবার ও আয়োডিন থেকে থাইরয়েড হরমোন তৈরী হয়। যখন এই হরমোনের অভাব হয় তখন থাইরয়েড রোগ হতে পারে।
এ রোগ হলে শরীর ফুলে যাওয়ার সাথে সাথে প্রচুর দূর্বলতা দেখা দেয়। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে হরমোন সংক্রান্ত এ রোগ সম্পর্কে জানা যায়।
ঘুমের ঘাটতি: পরিমিত ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারি। প্রতিদিন দেরিতে ঘুমালেও সেটা ঘুমের ঘাটতি হিসেবে দেখা দেয়। ঘুম কম হলে শরীর অনেক দূর্বল হয়ে যায়। শরীর নির্জীব লাগে।
কোনো কাজ ঠিক মতো করা যায় না। শরীর ও ত্বকের জন্য ঘুমের ঘাটতি খুবই ক্ষতিকর। প্রতিদিন অন্তত ৮ ঘন্টা ঘুমানোর অভ্যাস করলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
পানির ঘাটতি: প্রতিদিন একজন মানুষের অন্তত ৮ গ্লাস পানি পান করা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা অনেকেই সেটা করি না। খাবার ঠিক মতো খাই কিন্তু পানি ঠিক মতো পান করি না।
শরীরে পানি স্বল্পতা দেখা দিলে শরীর ব্যথা হয়, মাথা ব্যথা হয় এবং অবসাদ ও দূর্বলতা দেখা দেয়। শরীরের মূল অংশই পানির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। দূর্বলতা রোধে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা প্রয়োজন।
অতিরিক্ত ব্যায়াম করা: আমরা ঘুম থেকে উঠার পর যখন থেকে কাজ শুরু করি তখন থেকেই আমাদের শরীরে এক প্রকার ব্যায়াম হয়। কারণ, আমরা হাঁটা-চলা করি, হাত দিয়ে কাজ-কর্ম করি, নড়াচড়া করি ইত্যাদি।
কিন্তু এর বাইরেও কেউ যদি অতিরিক্ত পরিমাণে ব্যায়াম করে তবে তার শরীর দূর্বল হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ, শরীরের পেশিগুলো তখন আর শক্তি ধরে রাখতে পারে না।
শরীর দূর্বল হলে করণীয়:
শারিরীক দূর্বলতা দূর করার অনেক উপায় রয়েছে। আপনাকে সব কিছু একটু হলেও মেনে চলতে হবে। শারিরীক দূর্বলতা কেন হতে পারে তা নিয়ে উপরের কথাগুলো নিশ্চয়ই পড়েছেন।
কিন্তু উপরের কারণগুলো ছাড়াও আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। কোনো ব্যক্তি যদি মানসিকভাবে খুব আঘাত পায় তবুও তার শরীর দূর্বল হয়ে যেতে পারে।
আবার শরীরে ধীরে ধীরে যদি গোপণ কোনো অসুখ (যা আপনি জানেন না) বাঁসা বাধে তবুও আপনি দূর্বলতা অনুভব করতে পারেন।
আবার খুব ছোট ছোট কারণেও শারিরীক দূর্বলতা দেখা দিতে পারে। যাইহোক, এতো চিন্তায় পড়ার কিছু নেই। শুধু আপনাকে বের করতে হবে – কেন আপনি দিনের দিন শারিরীক দূর্বলতা অনুভব করছেন? যদি এই কারণটিকে চিহিৃত করতে পারেন তবে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
শারিরীক দূর্বলতা দূর করার কিছু উপায় নিচে উল্লেখ করা হলো। আপনি এগুলো প্রয়োগ করলে হয়তো অনেকটা উপকৃত হবেন। তো চলুন, দূর্বলতা দূর করার উপায়গুলো জানি:
- প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠার চেষ্টা করুন। তারপর সকালের রোদ পোহান। সূর্যের আলোতে রয়েছে ভিটামিন ডি তৈরীর উপাদান। আর ভিটামিন ডি শরীরের হাড় গঠনে খুব ভূমিকা রাখে। আর ভিটামিন ডি শারিরীক দূর্বলতা কাটাতে অনেকটা সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
- যদিও চা, কফি শারিরীক অনেক উপকার করে কিন্তু আপনি যদি বেশি পরিমাণে খাওয়ার অভ্যাস করে ফেলেন তাহলে আপনি মাঝে-মধ্যেই শারিরীক দূর্বলতা অনুভব করবেন। তাই যথাসম্ভব চা, কফি কম পরিমাণে গ্রহণ করুন।
- প্রতিদিন বাদাম, কলা এবং মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। তাহলে আপনার শারিরীক দূর্বলতা কমে যাবে।
- প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণে পানি পান করুন। আর অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানোর অভ্যাস করুন। পানি শুন্যতা এবং ঘুমের ঘাটতি দুটোই শারিরীক দূর্বলতা তৈরী করতে অনেকটা দায়ী।
- তিন মাস অন্তর আপনি সিনকারা সিরাপ অথবা ভিনসিনা সিরাপ খেতে পারেন। বাজারে আরো নানারকম ভেষজ উপাদানে তৈরী নানা প্রকার সিরাপ পাওয়া যায়। অহেতুক খেতে যাবেন না। আজেবাজে কোম্পানীর ওষুধ খেলে ক্ষতি হতে পারে। তাই এসব খাওয়ার আগে প্রয়োজনে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।
- নিয়মিত বিভিন্ন প্রকার ফলমুল খাওয়ার অভ্যাস করুন। শরীরের নানাবিধ দূর্বলতা রোধে ফলমুলের ভূমিকা অনেক বেশি।
- পাকা কলার সাথে মধু মিশিয়ে পেস্ট এর মতো করে খেতে পারেন। এতেও শরীরের অনেক উপকার হয়।
- কাজু বাদামে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই। নিয়মিত কাজু বাদাম খেলে আপনার শরীরে ভিটামিন ই এর ঘাটতি পূরণ হয়। দূর্বলতা রোধে নিয়মিত কাজু বাদাম খাওয়ার চেষ্টা করুন।
- দুধ এমন একটি তরল যা নানা স্বাস্থ্যকর উপাদানে ভরপুর। নিয়মিত দুধ খেলে চেহারার সৌন্দর্য বাড়ে। শরীর শক্তিশালী হয়। যাদের এলার্জি সংক্রান্ত সমস্যা আছে তারা একটু ভেবে-চিন্তে খাবেন।
- দিনে ১ টি ডিম খাওয়ার চেষ্টা করুন। সকালে খালি পেটে খেতে পারেন কিংবা রাতে ঘুমানোর পূর্বে খেলেও হয়। ডিমের মধ্যে রয়েছে প্রোটিন, ফলিক এসিড, আয়রন সহ নানাবিধ উপাদান।
পরিশেষে বলা যায়, শারিরীক দূর্বলতাকে সব সময় সহজ করে নিতে নেই। বড় কোনো রোগের সাধারন উপসর্গ হতে পারে শারিরীক দূর্বলতা।
আরও পড়ুন: কিডনী ভালো রাখার কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
তাই আপনি যদি সত্যিই কয়েকদিন ধরে এ ধরণের অসুস্থ্যতা অনুভব করেন তবে অনুগ্রহ করে নিজের প্রতি অবহেলা করবেন না।
শারিরীক দূর্বলতা দূর করার যেসব উপায় উপরে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো প্রথমে চেষ্টা করুন। যদি কোনো কাজ না হয় তাহলে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।