লিভার সুস্থ্য রাখার উপায়:
শরীরের মধ্যে যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো লিভার বা বাংলায় বলা হয় যকৃত। শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গের প্রতিই আমাদের খেয়াল রাখা উচিত। জানা দরকার, কোন অঙ্গের যত্ন কিভাবে নিতে হয়।
করতোয়ার আজকের আলোচনা মূলত এরকম একটি বিষয় নিয়ে। আমরা আজ জানবো, লিভার কিভাবে সুস্থ্য রাখা যায়। সেটা খাবারের মাধ্যমে হোক কিংবা অন্য কোন উপায়ে হোক। আর কথা বাড়াবো না। চলুন, মূল আলোচনায় চলে যাই।
১। প্রথমেই বলবো কিছু ওষুধের কথা। এমন কিছু ওষুধ রয়েছে যা আমাদের লিভারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ওষুধগুলো থেকে দূরে থাকুন সবসময়।
বিশেষ করে, বিভিন্ন ধরণের পেইন কিলার বা ব্যথার ওষুধ, টাইলেনল বা কোলেস্টেরল ওষুধ লিভারের খুবই ক্ষতি করে। প্রয়োজনে, ওষুধ অবশ্যই সেবন করতে হবে। কিন্তু, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া এই টাইপের ওষুধগুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
২। যেসব খাবারে অতিরিক্ত চিনি ব্যবহার করা হয় সেগুলো বর্জন করুন। যেমন- বাজারে অনেক সময় ফাস্টফুডের দোকানগুলোতে ‘লো ফ্যাট ফুড’ নামে খাবার পাওয়া যায়।
এগুলোতে মূলত ফ্যাটি অ্যাসিড কম থাকে। কিন্তু, খাবারের স্বাদ ধরে রাখতে এতে প্রচুর পরিমাণ চিনি যোগ করা হয়। আর এর ফলে এই খাবার নিয়মিত খেলে আপনার লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হবে অবশ্যই।
আর অতিরিক্ত তেল ও মশলাযুক্ত খাবার পরিহার করুন। মদ্যপান কখনোই করবেন না। অতিরিক্ত তেল ও মশলা যতটুকু ক্ষতি করে লিভারের সেই তুলনায় মদ্যপান কোন অংশেই কম না।
আর, এই অতিরিক্ত তেল,মশলা ও মদ্যপান শুধু লিভারের-ই ক্ষতি করে না বরং এগুলো শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরও যথেষ্ট ক্ষতি করে।
৩। আমাদের প্রকৃতিতে কতই না গাছ রয়েছে যা বিভিন্নভাবে উপকার করে। কোনো গাছের মূল, কোনো গাছের শিকর, কোনো গাছের ছাল আবার কোনো গাছের পাতা আমাদের কাজে লাগে।
আর সত্যিই এমন কিছু গাছ রয়েছে যেগুলোর মূল আপনার লিভারকে সুস্থ্য রাখতে সাহায্য করে। এগুলোকে আমরা হার্বাল কেয়ার বলতে পারি। যেমন- হলুদ গাছের মূল (মিল্ক থিসল), ড্যানডেলিওন ইত্যাদি।
৪। এবার আপনাদের বলবো সাপ্লিমেন্টের কথা। যখন কোনো ধরণের ভিটামিন বা সাপ্লিমেন্ট খাবেন তখন সাবধানে সেটা বাছাই করুন। কারণ, অসংখ্য ভিটামিন এবং সাপ্লিমেন্ট বাজারের দোকানে বা ডাক্তারের কাছে পাওয়া যায়।
যে সাপ্লিমেন্টগুলো লিভারকে ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করে সেগুলো আপনার পছন্দের তালিকায় রাখুন এবং প্রয়োজনে খান। আমরা জানি, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ও ভিটামিন সি লিভার পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে।
আবার, প্রোটিনে যথেষ্ট পরিমাণ অ্যামাইনো অ্যাসিড পাওয়া যায় যা লিভারকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডও লিভারের উপকার করে।
৫। আমরা যারা গ্রামে থাকি এবং কৃষিকাজ করি তারা প্রায় সময়ই ফসলের ক্ষেতে পোকা-মাকড় দমনের জন্য বিষ স্প্রে করি। অনেক সময় গাছের পুষ্টিখাদ্য ভিটামিন জাতীয় অনেক কিছু স্প্রে করি।
আমরা অনেকেই নিয়ম মেনে স্প্রে করিনা। আর তাই অনেক সময় আমাদের শরীরে এই বিষ বা টক্সিন লেগে যায়। কোনোভাবে এটা যদি রক্তের সাথে মিশতে পারে তবে আমাদের রক্ত দূষিত হয়।
ত্বক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হলে রক্ত দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর দূষিত রক্ত লিভারের উপর খুবই বিরূপ প্রভাব ফেলে।
যদিও ত্বকে বিষক্রিয়াই হচ্ছে মূল কারণ। সো, এ বিষয়টিও আমাদের মাথায় রাখা উচিত এবং এসব স্প্রে ও টক্সিন থেকে সাবধান থাকা উচিত।
৬। খুব সাধারণ খাবারের কথা বলবো এবার। এগুলো এক প্রকার পানীয়। আর সকল পানীয়কে খাবার বললে মোটেও ভুল হবে না, কারণ – এগুলো তো আসলে এক প্রকার খাবার।
যাইহোক, চা-কফি খাওয়ার অপকারিতার কথা কেউ শুনেছেন কিনা জানিনা তবে উপকারিতার কথা হয়তো অনেকেই শুনেছেন। হ্যা, চা-কফি খাওয়ার অনেক উপকারিতা রয়েছে বিশেষ করে কফি।
বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, আপনি যদি নিয়মিত কফি খান তবে লিভারের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাব্যতা বা ঝুঁকি ১৪ শতাংশ কমে যাবে।
৭। শরীরের যেকোন অঙ্গকে সুস্থ্য রাখার জন্য যে বিষয়টির দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন তা হলো – খাবার। কারণ, খাবার আমরা প্রতিনিয়ত খাই। এগুলো থেকেই নানা রকম ভিটামিন তৈরী হয়।
শরীরের শক্তি যোগায়। আমরা বেঁচে থাকি। আমরা মূলত দুই ধরণের প্রোটিন খাই। অ্যানিম্যাল প্রোটিন আর প্লান্ট প্রোটিন। অ্যানিম্যাল প্রোটিন বলতে বুঝায় মাছ, মাংস ইত্যাদি।
আর প্লান্ট প্রোটিন বলতে বুঝায় নানা রকম সবুজ শাকসব্জি, ডাল, বাদাম ইত্যাদি। কিন্তু, আমাদের লিভারের সুস্থ্যতার ক্ষেত্রে অ্যানিম্যাল প্রোটিনের তুলনায় প্লান্ট প্রোটিন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বলছি না, অ্যানিম্যাল প্রোটিন খাবেন না। অবশ্যই খাবেন। তবে সব সময় প্লান্ট প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারগুলো বেশি খাওয়ার চেষ্টা করবেন।
৮। অ্যালকোহল শরীরের জন্য ক্ষতিকারক। কারণ, অ্যালকোহল লিভারের মধ্যে টক্সিন জমা করতে পারে। এ কারণে অতিরিক্ত মদ্যপান বরাবরই লিভারের জন্য খারাপ বার্তা বয়ে আনে।
তবে জেনে অবাক হবেন যে, সামান্য বা হালকা অ্যালকোহল লিভার তথা শরীরের জন্য ভালো। আর হোমিওপ্যাথিক ওষুধগুলোতে যে পরিমাণ অ্যালকোহল দেয়া থাকে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয় যদি না কেউ অযাচিতভাবে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ সেবন না করে।
৯। এবার আলাদাভাবে কিছু খাদ্যের কথা বলবো। এগুলো শরীরের জন্য ভালো সুতরাং লিভারের জন্যও ভালো। তবে, সবকিছুই পরিমাণ মতো খাবেন। কারণ, অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো না।
খাদ্য তালিকার মধ্যে রয়েছে – মুসাম্বি লেবু, ব্লুবেরি ও ক্র্যানবেরি, আঙুর, অলিভ ওয়েল, বাদাম/কড়াই, পাতাওয়ালা সবজি, চা, কফি, তেলতেলে মাছ, নাগফনি ফল ও বিটের রস। এই খাবারগুলো চেষ্টা করবেন আপনার খাদ্য তালিকায় রাখার জন্য। সপ্তাহে অন্তত একবার নচেৎ মাসে অন্তত একবার তো খেতে পারবেন।
১০। রসুন আমাদের খুবই পরিচিত। প্রায় প্রতিদিনই আমরা তরকারি সহ বিভিন্ন রান্না-বান্নায় রসুন ব্যবহার করি। কিন্তু কয়জনই বা জানি এর গুণাগুন।
অনেকেই জানে, রসুন সেক্স পাওয়ার বাড়ায়। কথাটি অনেকাংশেই সঠিক। শুধু তাই নয়, হৃদরোগের ঝুঁকিও কমায়। অপরদিকে, লিভার পরিষ্কার রাখতে রসুনের জুড়ি নেই।
প্রতিদিন অন্তত ৩-৪ টি কোয়া রসুন দিন-রাতের যেকোন সময় খেয়ে নিন। খুব কাজে লাগবে। বাজারে রসুন দিয়ে তৈরী নানারকম ভিটামিনও পাওয়া যায়। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সেগুলোও খেতে পারেন।
১১। হাতের কাছে বিভিন্ন ফলমুল থাকে। বিশেষ করে, পেয়ারা, পেপে, আমলকি, জাম, আম, কালোজাম ইত্যাদি। এগুলোও বিভিন্নভাবে লিভারের উপকার করে।
লিভারকে সুস্থ্য রাখতে সাহায্য করে। তবে, যে ফলটি হাতের কাছে থাকে না বিশেষতঃ আপেল, কমলা, আঙুর ইত্যাদি সেগুলোও হাতের কাছে রাখার চেষ্টা করবেন।
আরও পড়ুন: হেপাটাইটিস রোগ কি এবং কেন হয়? জেনে নিই বিস্তারিত।
মাঝে-মধ্যে শখ করে হলেও খাবেন। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের কথা আমি বলছিনা। আমি বলছি, অস্বচ্ছল ব্যক্তিদের কথা। আপেলের মধ্যে থাকে ম্যালিক অ্যাসিড যা প্রাকৃতিকভাবেই রক্ত থেকে ক্ষতিকর টক্সিনগুলো দূর করে দেয়। সো, প্রতিদিন অন্তত ১টি করে আপেল খাওয়ার চেষ্টা করবেন।