লজ্জাবতী গাছ আমরা প্রায় সবাই চিনি। শহুরে ছেলেমেয়েরা অবশ্য কম দেখতে পায় কিন্তু যারা গ্রামে থাকে তারা সবসময়ই দেখতে পায়। আমাদের বাড়ির আশপাশেই লজ্জাবতী গাছ দেখা যায়।
এই লজ্জাবতী গাছের রয়েছে অসংখ্য গুণাবলী। এই গুণাবলীগুলো সবাই জানে না। যার ফলে লজ্জাবতী গাছের ব্যবহার দিনের দিন কমে যাচ্ছে।
আজ আমরা জানবো, লজ্জাবতী গাছের গুণাবলী সম্পর্কে। তো চলুন, কথা না বাড়িয়ে মূল আলোচনায় ফিরে যাই।
লজ্জাবতী গাছের পরিচিতি: লজ্জাবতী (লাতিন: ”Mimosa”) হলো প্রায় ৪০০ প্রজাতির গুল্ম ও লতার একটি গণের নাম, যা লিগিউম জাতীয় ফ্যাবায়েসি পরিবার বা শাখাগোত্রের Mimosoideae উপপরিবার বা উপগোত্রের ও Mimosaceae গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।
এই গণটির নাম এসেছে গ্রিক ভাষার শব্দ μιμος (mimos) থেকে, যার অর্থ “নকল”, এবং মেয়েলি প্রত্যয়ে –osa, “অনুরূপ”, এর ‘সংবেদনশীল পাতাগুলি’র নির্দেশ করে যা ‘সচেতনভাবে প্রতিক্রিয়া জানানোর ভান করে’ বলে মনে করা হয়।
এর দ্বি-পক্ষল পাতা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত প্রজাতি হলো Mimosa pudica। এর পাতা ছোঁয়া মাত্র বন্ধ হয়ে যায়। তাপের প্রভাবে, বা সন্ধ্যা বেলাতেও পাতা বন্ধ হয়ে যায়।
মূলত সিসমোন্যাস্টিক চলন (Seismonastic Movement) – এর প্রভাবেই এর পাতা বন্ধ হয়ে যায়। থোকায় থোকায় ফুল ফোটে। এর ফলগুলো চ্যাপ্টা, বাঁকা-লম্বাটে। এর আদি নিবাস মধ্য আমেরিকার মেক্সিকোতে, তবে বর্তমানে বিশ্বের সব জায়গায় এটি ছড়িয়ে পরেছে। (উইকিপিডিয়া হতে)
এর ব্যবহার্য অংশ হলো পাতা, ফুল ও সমগ্র লতা পাতা। বছরের সবসময় রোপণ করা যায় । বছরের যে কোনো সময় সংগ্রহ করা যায়। বারো মাসই ফুল ও ফল হয়।
তবে সাধারনত জুলাই থেকে ডিসেম্বর মধ্যে ফুল ও ফল বেশী হয়। প্রত্যেক শুটিতে ৩/৪ টি বীজ থাকে। ফলের মধ্যে ধূসর বর্ণের ছোট ছোট কাঁটা আছে।
সাধারনত বনজ আবস্থায় জন্মে। তবে অনেকে চাষ করে থাকে। উপমহাদেশের সর্বত্র পাওয়া যায়, বাংলাদেশে ও অসমে এর প্রাচুর্য বেশী।
এই গাছটি গুল্ম জাতীয় গাছ। স্পর্ষকাতর গুল্ম লজ্জাবতী লতাটি গড়িয়ে গড়িয়ে বেড়ে যায়। এর গায়ে অসম্ভব বাঁকা কাঁটা নীচের দিকে থাকে।
প্রবাদ আছে এর ভিতর দিয়ে সাপ চালাচল করেনা।পাতার বোঁটা এক থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা। পাতা গুলি ঠিক বিপরীতভাবে সন্নিবেসিত। স্পর্শ করলেই পাতা বুঁজে যায়। পুষ্পদন্ড ২ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা। ফুল তুলার মত নরম ও ফিকে লাল বর্ণের বা কিছুটা বেগুনী বর্ণের হয়।
ঔষধি গুণাগুণ: এই উদ্ভিদটি প্রকৃতিতে একটু ভিন্ন প্রকারের। স্পর্শের সাথে সাথে এটি গুটিয়ে যায় বলে এর নাম লজ্জাবতী নাম হয়েছে। এ কারনে হয়তো এর প্রতি অনেকে আকৃষ্ট হয়।
এর মাঝে হয়ত অন্য কোনো রহস্যও থাকতে পারে। এ নিয়ে আরো গবেষণারও প্রয়োজন রয়েছে। এ উদ্ভিদের অনেক ঔষধী গুনাগুন রয়েছে।
হাত পা জ্বালায়, অর্শ রোগে, রক্তপিত্তে, যোনি ক্ষতে, নাড়ী সরে আসায়, আঁধারযোনি ক্ষতে, আমাশয়, দমকা ভেদ, মল কাঠিন্যে, বিসর্পে, দাঁতের মাড়ি ক্ষতে, বগলে দুর্গন্ধ, দুষ্ট ক্ষতে, পোড়া নারিঙ্গায়, হারিশে, কানের পুঁজে, রমনে অতৃপ্তি, মিথুন দন্ডের শৈথিল্যে, গ্রন্থিবাত, কুজ্জতায়, সংগ্রহ গ্রহণী রোগ ইত্যাদিতে এর ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে। নিচে ক্রমিক আকারে বিবরণ দেয়া হলো:
হাত পা জ্বালায়: হাত পা জ্বালার সাথে জ্বরও থাকে। এটা সাধারনত বর্ষা ও শরৎকালে পিত্ত বিকারে দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে লজ্জাবতীর সমগ্রাংশ (গাছ মূল পাতা) ১০গ্রাম ৪ কাপ পানিতে সিদ্ধ ক’রে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে এই ক্বাথটা খেলে ঋতুগত পিত্ত বিকারে ও তজ্জনিত উপসর্গের উপসম হয়।
অর্শ রোগ: অর্শের বলিতে জ্বালা বেশী। ঝাল না খেয়েও যেন সেই রকম জ্বালাবোধ। তার সঙ্গে রক্তস্রাবও বেশী হোতে থাকে। এক্ষেত্রে গাছে ও মূলে ১০ গ্রাম আন্দাজ ১ কাপ দুধ ও ৩ কাপ পানি এক সঙ্গে মিশিয়ে একত্রে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে নিয়ে এটা প্রত্যহ সকাল বিকাল ২ বার খেতে হবে। ছাগলের দুধ হলে ভাল হয়।
রক্তপিত্তে: গলাটায় মনে হয় কাঁটা ফুঁটেছে, এর সঙ্গে একটা কাশি আসে আর রক্ত পড়ে, বুকে পিঠে কোনো ব্যথা নেই, এমন কি অর্শ নেই, দাস্ত হওয়ার পর জ্বালা যন্ত্রনাও হয় না,অথচ টাটকা রক্ত পড়ে; এক্ষেত্রে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে মাত্রা মত তৈরী করে ঐ ক্বাথটা সকালে বিকালে দুইবার খেলে রক্তস্রুতি বন্ধ হয়ে যায়।
যোনি ক্ষতে: এটার প্রাথমিক স্তরে মাঝে মাঝে অথবা প্রায় রোজই অল্প অল্প স্রাব চলতে থাকে, একটা আঁশটে গন্ধ, কখনো বা একটু লালচে স্রাব; এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসক সাবধান করে থাকেন; এটার পরিনামে ক্যানসার হতে পারে।
এ ক্ষেত্রে দুধে পানিতে সিদ্ধ করা লজ্জাবতীর ক্বাথ খেলে এ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। তাছাড়া গাছের ক্বাথ দিয়ে ডুস্ দিয়ে ধোয়ালে তাড়াতাড়ি সেরে যায়। ক্বাথ তৈরী করার পদ্ধতি পূর্বে উল্লেখ আছে।
নাড়ী সরে আসায়: বহু সন্তানের জননী অথবা প্রসবের সময় ধাত্রীর অসাবধানতায় নাড়ী সরে এসেছে, উঁচু হয়ে বসতে গেলে অস্বস্তি বোধ, এক্ষেত্রে গাছে মূলে ১০ গ্রাম আন্দাজ গাছপাতা ৪ কাপ পানিতে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে নিয়ে এটা প্রত্যহ সকাল বিকাল ২ বার খেতে হবে। আর ঐভাবে ক্বাথ তৈরী করে ডুস্ দেওয়া, এর দ্বারা ঐটা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।
আমাশয়: অনেকদিনকার পুরনো, বেগ হলে আর দাঁড়ানো যায়না, গিয়ে প্রথমে যা হোলো তারপর আর হতে চায়না; তারপর আবার অনেকের শক্ত মলের গায়ে সাদা সাদা জড়ানো আম।
এ ক্ষেত্রে লজ্জাবতীর ডাঁটা পাতা মিলিয়ে ১০ গ্রাম সিদ্ধ করে ছেঁকে খেতে হবে। আর যাদের আমযুক্ত গাঁজলা দাস্ত হয় তাঁরা শুধু ৫/৬ গ্রাম সিদ্ধ করে ছেঁকে ঐ পানিটা খেতে হবে।
দমকা ভেদ: ২/৩ দিন পেট স্তব্ধ হয়ে থাকে আর্থাৎ পেট ধুম মেরে থাকে, হঠাৎ একদিন দম্কা ভেদ হয়। যা অগ্নিমান্দাজনিত অজীর্ণ। এ ক্ষেত্রে লজ্জাবতীর শিকড়ের ছাল ২/৩ গ্রামের সঙ্গে শুধু পাতা ৪ গ্রাম একসঙ্গে সিদ্ধ করে ছেঁকে পানিটা খেতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, লজ্জাবতী গাছের মাধ্যমে উপরিউক্ত রোগগুলো ছাড়াও আরও রোগের চিকিৎসা করা যায়। বর্তমান যুগে ভেষজ চিকিৎসা কমে আসায় লজ্জাবতীর কথাও মানুষ দিন দিন ভুলে যাচ্ছে।
কিন্তু যারা জানে তারা ঠিকই লজ্জাবতী দিয়ে নিজের চিকিৎসা করছেন। এ চিকিৎসা ব্যবস্থায় কোনরুপ জটিলতা নেই। নেই কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়। তাই নির্ভয়ে আপনি লজ্জাবতী গাছের মাধ্যমে উল্লেখিত রোগগুলোর চিকিৎসা করতে পারেন।
আরও পড়ুন: মধু ও রসুন এর যাদুকরি টিপস জেনে নিন – গোপনে কাজে লাগবে