রোগ কি?
রোগ হচ্ছে কতকগুলো অস্বাভাবিক লক্ষণের প্রকাশিত অবস্থা। অন্যভাবে বলা যায় যে, আমাদের শরীরের মধ্যে যে জীবনীশক্তি অদৃশ্যভাবে কাজ করে তা কোনো অদৃশ্য শক্তি (ব্যাধি) দ্বারা আক্রান্ত হলে আমরা তখন অসুস্থ্য হয়ে পড়ি।
রোগের এরূপ সংজ্ঞা চিকিৎসা জগতে একটি নতুন সুত্ররূপে কাজ করে কেননা সবাই মনে করেন যে, শরীর ব্যাধির কেন্দ্রস্থল।
মহাত্মা ডাঃ হ্যানিম্যান বলেছেন যে, ব্যাধির সাথে শরীরের কোন প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ নেই। ব্যাধি কোন স্থুলবস্তু নয় বরং এটা অতি সুক্ষ্ম জীবনীশক্তিকে আক্রমণ করে।
কিন্তু জীবনী শক্তির সাথে দেহের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলেই তার আক্রমণের সকল লক্ষণ (Symptoms) দেহের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে।
হোমিওপ্যাথিক ওষুধ কিভাবে কাজ করে?
হোমিওপ্যাথিক ওষুধ শরীরে প্রবেশ করে প্রথমতঃ একটি রোগের সৃষ্টি করে।
যদি সেই সৃষ্টি রোগ শরীরস্থ রোগের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হয় তবে তা উক্ত রোগের স্থান অধিকার করে বসে ফলে শারিরীক পীড়া বা ব্যাধি সঙ্গে সঙ্গে নিজ অধিকৃত স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কেননা দুইটি বস্তু একই সময়ে একই স্থান দখল করতে পারে না।
শারিরীক পীড়া শরীর থেকে বের হওয়ার সময় ওষুধজনিত পীড়াকে নষ্ট করে বের হয়ে আসে। শারিরীক পীড়া যতই বলবান ও শক্তিশালী হোক না কেন যদি আমরা তার চেয়েও অধিক পাওয়ারের ওষুধ ব্যবহার করি তাহলেই উক্ত রোগ আরোগ্য করতে সক্ষম হবে।
হোমিওপ্যাথি ওষুধ যতই উচ্চ শক্তির হবে ততই তা অধিকতর ও দ্রুত কার্যকরী হয়। হোমিওপ্যাথি ওষুধের উচ্চ শক্তি বলতে বুঝায় ওষুধের পটেনটাইজেশন।
শততমিক পদ্ধতির হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শক্তি এক অর্থাৎ হোমিওপ্যাথিক ওষুধের মাদার টিংচার এক ফোটা + ৯৯ ফোটা রেকটিফাইড স্পিরিট।
আবার, হোমিও ওষুধের শক্তি দুই বলতে বুঝায় পূর্বের শক্তিকৃত ওষুধের এক ফোটা + ৯৯ ফোটা রেকটিফাইড স্পিরিট অর্থাৎ দুই শক্তিতে ওষুধের পরিমাণ দশ হাজার ভাগের মধ্যে দুই ভাগ (২ : ১০০০০)।
রেকটিফাইড স্পিরিটের মধ্যে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ অ্যাটোমিক (Atomic) শক্তিতে থাকে। ডায়লেশন/ডাইলিউশন শব্দটি হোমিওপ্যাথিকের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা ঠিক নয়। কারণ, ডায়লেশন/ডাইলিউশন (Dilution) শব্দটি দ্বারা শক্তি কমানো বুঝায়।
এ শব্দটি কেবল অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা চলে। কারণ, ডায়লেশন/ডাইলিউশন এর মাধ্যমে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের শক্তিকে কমানো হয়।
উদাহরনস্বরুপ, এক আউন্স সালফিউরিক অ্যাসিডের সাথে নয় আউন্স পানি মিশিয়ে সালফিউরিক অ্যাসিডের পাওয়ার/শক্তি কমানো হয়।
সালফিউরিক অ্যাসিডের সাথে পানি না মিশিয়ে গলদ্ধকরন করলে গলা জ্বলে যায় বলে তার তীব্রতা কমানোর জন্য পানির মিশ্রণ করা হয়, কাজেই এই প্রক্রিয়াকেই মূলত ডায়লেশন/ডাইলিউশন বলা হয়।
কিন্তু হোমিওপ্যাথিক ওষুধকে পটেনটাইজেশন প্রক্রিয়ায় ওষুধের পাওয়ার/শক্তি বাড়ানো হয়। এই বিষয়টি হোমিওপ্যাথিক শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া কেউ সহজে বিশ্বাস করতে চান না এবং অনেকেই সত্যিকার অর্থে বুঝতেই পারেন না।
ওষুধ শরীরে প্রবেশ করে প্রথমতঃ একটি রোগের সৃষ্টি করে। যাদের বিশ্বাস হয় না তারা যদি সালফার ২০০ অথবা সোরিনাম ২০০ শক্তির ওষুধ এক ড্রাম দৈনিক ২-৩ বার এক ফোঁটা করে ১০-১৫ দিন পর্যন্ত সেবন করেন তাহলে দেখা যাবে যে, ১০-১৫ দিন পরে তাদের শরীর পাঁচড়ায় ভরে গেছে।
তখন অবশ্য বিশ্বাস না করে উপায় নেই। কিন্তু যদি কেউ একবারে এক ড্রাম সালফার ২০০ অথবা সোরিনাম ২০০ সেবন করে তখন তা এক ডোজেরই কাজ করবে।
কেননা একবারে কারো মস্তকে/মাথায় যদি কেউ এক বদনা পানি ঢেলে দেয় তাহলে তাতে তার একবার মস্তক ধুয়ে ফেলার কাজ ছাড়া আর কিছুই হয় না।
কিন্তু যদি তার মস্তকে/মাথায় ফোঁটা ফোঁটা করে এক বদনা পানি ঢালা হয় তাহলে অবশ্যই তার সর্দি, কাশি অথবা জ্বর হতে পারে। হোমিওপ্যাথিক এ পটেনটাইজেশন প্রক্রিয়ায় ওষুধের পাওয়ার বাড়ানো হয় এবং যার কোনো শক্তি নাই তারও শক্তি প্রকাশ পায়।
এটার উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লাইকোপোডিয়াম ওষুধটিই শক্তিকৃত হয়ে কত অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় যারা জড়িত তারা বিষয়টি হয়তো ভালো করেই জানেন।
সাইলিশিয়া অর্থাৎ বালি যে ওষুধ হিসেবে কাজ করবে এটা কেউ হয়তো কল্পনাও করেনি। অথচ এটারও উপকারিতা রয়েছে এবং ওষুধি গুণ রয়েছে যা মহাত্মা হ্যানিম্যান আবিষ্কার করে রেখে গেছেন।
সাইলিশিয়া ওষুধটিও অনেক অসাধ্যকে সাধন করেছে। এরুপ উদাহরণ আরও অসংখ্য দেয়া যাবে যেমন, সালফার, সোরিনাম ও টিউবারকুলিনাম ইত্যাদি ওষুধগুলো বহু অসাধ্য সাধন করেছে।
এটা জেনে রাখা উচিত যে, সকল ওষুধকেই আমরা পীড়া হতে অধিকতর শক্তিশালী করে তৈরী করতে পারি। কোন স্থানে ওষুধ প্রয়োগ করলে যদি তা কার্যকরী ফলাফল না দেয় তবে তখন আমরা শক্তির পরিবর্তন করে ওষুধ প্রয়োগ করি অর্থাৎ আরও উচ্চ শক্তির ওষুধ প্রয়োগ করি।
জানা প্রয়োজন, ৬, ৩০, ২০০ ও তদু্র্ধ্ব শক্তির ওষুধের মধ্যে কোথায় কোন শক্তির ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়।
যেমন, সর্দি, কাশি, জ্বর, পাতলা পায়খানা, আমাশয়, পেট বেদনা, রক্তস্রাব প্রভৃতি পীড়ায় ৬ ও ৩০ শক্তি ব্যবহার করতে হয়; মাথা ধরা, মস্তিষ্কের স্নায়ুশূল, অন্য কোনো অঙ্গের স্নায়ুশূল, জ্বর, মানসিক বিকার, আত্মহত্যার প্রবৃত্তি, কোনো কিছুর অলীক ভয়, অলীক সন্দেহ, উম্মাদগ্রস্থ ইত্যাদি, আবার- অস্বাভাবিক অনুভুতি, রোগী অনুভ করে যে তার মুখে মাকড়সার জাল লেগেই রয়েছে, গলার ভেতর কি যেন আটকিয়ে আছে ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাধারনত ৬, ৩০ ও ২০০ শক্তির ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
আবার পীড়ি দেহের রস ও রক্ত হতে প্রস্তুত নোসোড ওষুধ যেমন- ভ্যাকসিনিনাম, ভিরিওলিনাম, সোরিনাম, ডিফথেরিনাম, মেডোরিনাম, সিফিলিনাম ইত্যাদি ওষুধের শক্তি ২০০ বা তদুর্ধ্ব প্রয়োগ করতে হয়।
কলেরা ও এর মতো মারাত্মক রোগে ৬ ও ৩০ শক্তির ওষুধ ১০-১৫ মিনিট অন্তর প্রয়োগ করতে হয়। রোগের উপশম হতে আরম্ভ করলে অনেকক্ষণ পরপর পরিবর্তিত শক্তিতে ওষুধ সেবন করাতে হয়।
ডোজ পূর্ণ হওয়ার পরেও যদি উপকার না হতে দেখা যায় তবে অন্য ওষুধ নির্বাচন করতে হবে। আবার, তরুণ রোগে এক মাত্রা ওষুধ দিয়ে তিন ঘন্টার মধ্যে উপকার না দেখলে আর একমাত্রা ওষুধ দিয়ে কোনো ফলাফল আসে কিনা সেটা দেখা যেতে পারে।
যদি কোনোরুপ উপকার না হয় তবে ওষুধ পরিবর্তন করার বিষয় বিবেচনা করতে হবে। অপরদিকে, ওষুধ প্রয়োগের ফলে কোনোরুপ উপকার হচ্ছে বুঝতে পারা গেলে তবে যতক্ষণ উপকার হতে থাকে ততক্ষণ আর কোন ওষুধ পরিবর্তন করতে হবে না।
যখন দেখতে পাওয়া যায় যে, আর কোনো উপকার হচ্ছে না তখন ঐ একই ওষুধের উচ্চ শক্তির একমাত্রা প্রয়োগ করা যেতে পারে।
প্রথম একমাত্রার উচ্চশক্তির ওষুধ প্রয়োগ করেই যদি বুঝা যায় রোগের প্রকোপ বেড়ে গেছে এবং রোগীর পক্ষে তা অসহ্য হয়ে যায় তাহলে এই একই ওষুধের উচ্চশক্তির আরও একমাত্রা প্রয়োগ করলে যন্ত্রণা কমে যাবে।
যারা এ বিষয়ে অনভিজ্ঞ সে ক্ষেত্রে তারা ঐ ওষুধের ক্রিয়ানাশক ওষুধটিই ব্যবহার করে থাকেন আর ফলাফলস্বরুপ ওষুধজনিত প্রতিক্রিয়াটি কমে যায় কিন্তু শারিরীক পূর্ব রোগের আর কোনো ক্রিয়া হওয়ার আশা থাকে না।
তারা যদি সেক্ষেত্রে ওষুধের ক্রিয়ানাশক ওষুধ ব্যবহার না করে ঐ ওষুধেরই (যেটা দিয়ে রোগের বৃদ্ধি হয়েছে) আরও এক মাত্রা প্রয়োগ করেন তাহলে সব দিক থেকেই রক্ষা হয় অর্থাৎ ওষুধের প্রতিক্রিয়াও কমে যায় এবং একই সাথে মূল রোগটাও কমে যেতে আরম্ভ করে।
সেজন্য এক ডোজ ওষুধ দিয়ে ২-৩ ঘন্টা অন্তর অন্তর এক মাত্রা করে সুগার অব মিল্ক দিতে হয়। কেননা, অ্যালোপ্যাথি, হেকেমি ও কবিরাজী ওষুধ ক্রমানুক্রমিক ব্যবহার করে লোকে এরুপ অভ্যস্থ হয়ে গেছে যে, ২-৩ ঘন্টা অন্তর ওষুধ না দিলে তাদের মনে তৃপ্তি আসে না।
সুতরাং হোমিওপ্যাথিক শাস্ত্রমতে সমস্ত রোগীকেই এরুপভাবে সুগার অব মিল্ক খাওয়ানো হয়। এমনকি নিজের বাবা মায়ের চিকিৎসা করতে হলেও এ নিয়ম পালন করতে হবে।
কেউ যদি এটা না করেন তবে তার হাতের রোগী হয়তো অন্যত্র চলে যেতে পারে। উল্লেখ্য, অনেক চিকিৎসক একই ওষুধ একই শক্তিতে বারবার প্রয়োগ করেন।
এটা কিন্তু মোটেই ঠিক নয়; তবে সাক্কাসন পদ্ধতিতে দেওয়া যেতে পারে কারণ পরিবর্তিত পরিবেশে বা খাদ্য অভ্যাসের ফলে অনেক সময় ওষুধের শক্তি নষ্ট হয়।
আরও পড়ুন: লিভার ভালো রাখতে করণীয় কি?
পুরাতন পীড়ায় এক মাত্রা ওষুধ দিয়ে ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে তাতে কোনো উপকার না হলে ওষুধ পরিবর্তন করে দিতে হবে। সামান্য উপকার বোধ করলে আর ওষুধ পরিবর্তন করতে হবে না এবং যতক্ষণ উপকার হতে থাকবে ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
কোনো প্রকার উপকার হওয়া বন্ধ না হলে ওষুধ পরিবর্তন করতে হবে, নানা প্রকার ওষুধ সেবনের পর রোগী বিফল মন নিয়ে শেষবারের মতো হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করতে আসে, তখন একমাত্রা ওষুধ দিয়ে তিন ঘন্টা পর পরিবর্তিত শক্তিতে পুণরায় এক মাত্রা দিয়ে পূর্ব নিয়মে ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে।
পুরাতন পীড়ার জন্য দীর্ঘকাল কাজ করে যে সকল ওষুধ সেগুলো লক্ষণানুযায়ী ব্যবহার করতে হবে। হোমিওপ্যাথি ওষুধ শরীরের উপর দুই তিন ঘন্টা থেকে দুই তিন মাস ধরে কাজ করতে পারে।
দুই তিন ঘন্টা যে সকল ওষুধ শরীরের উপর কাজ করে তা স্বল্পকালীনক্রীয় ওষুধ আর যে সকল ওষুধ শরীরের গভীরে প্রবেশ করে দীর্ঘকাল ধরে কাজ করে তা গভীরক্রীয় ওষুধ। সাধারণতঃ পুরাতন পীড়ায় গভীর ও দীর্ঘক্রীয় ওষুধগুলোই ব্যবহার করতে হয়।