ত্বকের যত্নে প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহার সবচেয়ে নিরাপদ। তার মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বেসন ও লেবু। সৌন্দর্য চর্চায় এই দুইটা উপাদানের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই।
রূপচর্চার জন্য বেসন ও লেবু শ্রেষ্ঠতম উপাদান। লেবুর কার্যকরী ও অ্যান্টি টক্সিন গুণাবলী ত্বকের অতিরিক্ত তেল দূর করে, ত্বককে মসৃণ ও উজ্জ্বল করে।
বেসন ত্বককে উজ্জ্বল করতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আজ আমাদের আয়োজন তাই ত্বকের যত্নে বেসন ও লেবুর গুনাগুন নিয়ে এসেছি।
পোস্টটি’তে থাকছে বেসন ও লেবুর নানা উপকারী দিক। এই উপাদানগুলো যেমন সহজলভ্য তেমনি রূপ চর্চার জন্য অনেক উপকারী। তো আর কথা নয় – চলুন জেনে নেই এদের উপকারী দিকগুলো।
ত্বকের যত্নে বেসনের ফেস মাস্ক ও ব্রনের সমস্যা থেকে রক্ষায় বেসনের প্যাক:
ব্রনের সমস্যা থেকে রক্ষায়:
১. ব্রণের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ব্যবহার করতে হবে অ্যান্টি পিম্পল বেসন মাস্ক। ২ চা চামচ বেসন, ২ চা চামচ স্যানডালউড পাউডার (চন্দন পাউডার), এক চা চামচ দুধ মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে মুখে লাগিয়ে রাখতে হবে ২০ মিনিট। আর তারপর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
২. এছাড়া ব্রন থেকে মুক্তি পেতে এই প্যাকটিও ব্যবহার করতে পারেন। বেসন এবং কুসুম গরম মধু দিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করে নিতে হবে এবং ১০-১৫ মিনিট ত্বকে ব্যবহার করে ধুয়ে ফেলতে হবে। এতে ত্বক ব্রণ মুক্ত থাকবে। এটি নিয়মিত ব্যবহার করলে ভাল উপকার পাবেন।
ঘাড় এবং আন্ডার আর্মের কালো দাগ দূর করনে বেসনের প্যাক:
ঘাড় এবং আন্ডার আর্মের কালো দাগ নিয়ে বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয় অনেক’কেই। এসব জায়গার কালো দাগ দূর করতে বেসনের একটি প্যাক খুব কার্যকর।
বেসন, টক দই এবং কাঁচা হলুদ পরিমাণ মতো নিয়ে ঘাড়ে এবং আন্ডার আর্মের কালো জায়গায় লাগিয়ে নিন। এরপর ৩০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলতে হবে। সপ্তাহে কমপক্ষে ৩ বার ব্যবহার করলে ভাল উপকার পাওয়া যাবে।
মুখের কালচে ভাব দূর করণে বেসনের প্যাক:
মুখের কালচে ভাব দূর করতে ৪ চা চামচ বেসন, ১ চা চামচ লেবুর রস, ১ চা চামচ টক দই মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করতে হবে। মুখে এবং ঘাড়ে লাগিয়ে শুকান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
শুকালে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এটি ত্বক’কে নরম এবং উজ্জ্বল করে। ভালো ফলাফলের জন্য সপ্তাহে ৪-৫ বার ব্যবহার করতে হবে।
ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতে বেসনের প্যাক:
ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে লেবু এবং বেসনের ফেইস প্যাক খুব উপকারি। ৪ চা চামচ বেসন, ১ চা চামচ লেবুর রস এবং এক চামচ কাঁচা দুধ ভালো মতো মিশিয়ে পেস্ট তৈরী করে নিতে হবে।
আর তারপর মুখে সারকুলার মোশনে স্ক্রাবের মতো রেখে দিতে হবে। না শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এরপর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে।
তৈলাক্ত ত্বকের ক্ষেত্রে বেসনের প্যাক:
১. যাদের ত্বক তৈলাক্ত তারা ৩ চা চামচ বেসন এর সাথে ২ চা চামচ কাঁচা দুধ অথবা ২ চা চামচ টক দই মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে রাখুন। ২০ মিনিট পর মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। এই প্যাকটি ত্বকের অতিরিক্ত তেল কমানোর সাথে সাথে ত্বকের ময়লা দূর করবে।
২. তৈলাক্ত ত্বকের ক্ষেত্রে এটাও করা যাবে যথা- বেসন এবং গোলাপ জল ভালভাবে মিশিয়ে একটি প্যাক তৈরি করতে হবে। এরপর মুখে লাগিয়ে না শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে এবং শুকানোর পর কুসুম গরম পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে।
শুষ্ক ত্বকের ক্ষেত্রে বেসনের প্যাক:
শুষ্ক ত্বকের ক্ষেত্রে এই প্যাকটি উপকারি। বেসন, দুধের সর বা ফুলক্রিম মিল্ক, মধু এবং এক চিমটি হলুদের সংমিশ্রনে একটি প্যাক তৈরি করে নিতে হবে।
এরপর ১৫- ২০ মিনিট ত্বকে রেখে ধুয়ে ফেলতে হবে। এ মিশ্রণ ব্যবহারে শুষ্ক ত্বকে ময়েশ্চার বজায় থাকে এবং ত্বক মসৃণ ও সজীব থাকে।
অবাঞ্ছিত লোম দূর করনে বেসনের প্যাক:
মুখের অবাঞ্ছিত লোম দূর করতে অনেক আগে থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে বেসন। মেথি গুঁড়ো এবং বেসনের সাথে পানি মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করতে হবে।
মুখের যেসব জায়গায় লোম রয়েছে সেখানে এই মিশ্রণটি লাগাতে হবে। ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলতে হবে। ভালো ফলাফলের জন্য প্রতিদিন এই ফেইস প্যাকটি ব্যবহার করতে হবে।
ব্রণের কালো দাগ দূর করনে বেসনের প্যাক:
ব্রনের কালো দাগ দূর করতে বেসনের সাথে শশা এবং লেবুর রস মিশিয়ে মুখে লাগাতে হবে। এরপর ২০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলতে হবে। নিয়মিত ব্যবহারে ব্রণের দাগ হালকা হয়ে যাবে।
ত্বকে তাৎক্ষনিক উজ্জ্বলতা আনতে বেসনের প্যাক:
১. চেহারায় মুহূর্তের মধ্যে উজ্জ্বলতা আনতে ২ চা চামচ বেসন, ১ চা চামচ শুকনো কমলার খোসার গুঁড়ো এবং আধা চা চামচ দুধ মিশিয়ে মুখে এবং ঘাড়ে লাগিয়ে রাখতে হবে।
লাগানোর সময় মুখে হালকা ভাবে সারকুলার মোশনে ম্যাসাজ করতে হবে। ১৫ মিনিট রেখে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এই প্যাকটি ত্বকের জন্য অনেক উপকারি।
২. সাধারন ত্বকের উজ্জলতা প্রাকৃতিকভাবে বাড়াতে ৪ টি আমন্ড বাদাম গুঁড়ো করে নিতে হবে। এবার আধা চা চামচ বেসন, আধা চা চামচ দুধ এবং সামান্য লেবুর রস একসাথে মিশিয়ে একটি প্যাক তৈরি করে মুখে লাগাতে হবে।
ত্বকে ৩০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলতে হবে। উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতে এই প্যাকটি অনেক কার্যকর। তাছাড়া, বিভিন্ন ভাবে এই প্যাকটি অনেকটাই পরীক্ষিত। নিশ্চিন্তে ভালো ফলাফলের জন্য এটা করতে পারেন।
সবধরনের ত্বকের ক্ষেত্রে বেসনের প্যাক:
বেসন, শুকনো কমলার খোসার পাউডার, এবং গুঁড়ো দুধের মিশ্রন সবধরনের ত্বকের জন্যই উপকারী। এই প্যাকটি মুখে দিয়ে ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলতে হবে। এই প্যাক নিয়মিত ব্যবহারে ত্বক মসৃণ এবং উজ্জ্বল হবে।
ত্বকের যত্নে লেবুর ফেসপ্যাক:
প্রথমে লেবুর কিছু গুণাগুন জেনে নিই:
লেবুর অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ভাইরাল উপাদান ত্বকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। রোদে পোড়া ত্বকে নিয়মিত লেবু ব্যবহার করলে ত্বকের ছোপ ছোপ কালো দাগ দূর হয়।
লেবুতে বিদ্যমান অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ত্বকের ভাঁজ ও দাগ দূর করে। লেবুতে থাকা ভিটামিন-সি ত্বকের ব্রণ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া দূর করে এবং ব্রণের দাগ দূর করে।
বয়সজনিত ত্বকের দাগ সারাতে লেবুর রস বেশ উপকারী। হাতের কনুই, পায়ের হাঁটু, পায়ের গোড়ালি, নখের কোণায় জমে থাকা ময়লা দূর করতে লেবুর রসের জুড়ি নেই।
এছাড়া হাত ও পায়ের রুক্ষভাব দূর করতে লেবুর রসের সঙ্গে চালের গুড়ো মিশিয়ে হাত পায়ে ১০ মিনিট ম্যাসাজ করুন। ত্বকের তৈলাক্ত ভাব দূর করতে সমপরিমাণ শসার রস ও লেবুর রস মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে তুলার সাহায্যে ত্বকে লাগিয়ে ১০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।
ত্বকের তৈলাক্ত ভাব দূর হয়ে ত্বক সতেজ হবে। শুষ্ক ত্বকে এই মিশ্রণটি ব্যবহারের ফলে ত্বকে জ্বালাপোড়াভাব হতে পারে, এবং অতিরিক্ত শুষ্ক হয়ে যেতে পারে।
সপ্তাহে তিনদিন একটি ডিমের সাদা অংশের সঙ্গে ১ টেবিল চামচ লেবুর রস মিশিয়ে পুরো মুখে লাগিয়ে ১০ মিনিট পর কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
এটি ত্বকের তৈলাক্ত ভাব দূর করার পাশাপাশি উজ্জ্বলতা বাড়াবে। সপ্তাহে দুইদিন ১ টেবিল চামচ লেবুর রসের সঙ্গে ২ টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে মুখে লাগিয়ে রাখুন ১৫ মিনিট। ত্বকে টান টান ভাব হলে ঠাণ্ডা পানিতে ধুয়ে ফেলুন। লেবুর প্রাকৃতিক ব্লিচিং গুণ ত্বককে উজ্জ্বল করবে।
এবার লেবুর কিছু ফেইসপ্যাক দেওয়া হলো:
১. লেবুর রস ও শশার রসের ফেইসপ্যাক:
সাধারণভাবে ত্বকের তৈলাক্ত ভাব দূর করতে একটি পাত্রে সমপরিমাণ শশার রস ও লেবুর রস মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরী করে নিতে হবে। এবার একটি কটন বলের সাহায্যে পুরো মুখে লাগাতে হবে।
মিশ্রণটি মুখে লাগানোর সাথে সাথে যদি জ্বালা করে, তবে দ্রুত ধুয়ে ফেলতে হবে। লেবু ত্বককে অতিরিক্ত শুষ্ক করে ফেলতে পারে, সেক্ষেত্রে ত্বকের উপযোগী একটি ময়েশ্চারাইজার মুখে লাগিয়ে নিতে হবে। লেবুর রসে থাকে সাইট্রিক এসিড, যা ত্বকের তেল সম্পূর্ণ রুপে দূর করে এবং ত্বককে শুষ্ক ও উজ্জ্বল করে।
২. লেবুর রস ও দুধের ফেইসপ্যাক:
একটি বড় লেবুর অর্ধেক অংশ কেটে তার রস বের করে নিতে হবে। এবার তার সাথে ১০ টেবিল চামচ তরল দুধ ভালো ভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। ধীরে ধীরে পুরো মুখে ম্যাসাজ করে, যতক্ষন না পর্যন্ত পুরো মিশ্রণটা ত্বক না শোষণ করে।
১৫-২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলতে হবে। এই ফেইসপ্যাকের উপকারিতা হলো, লেবু ত্বকের তেল দূর করে আর দুধ ত্বকের ময়েশ্চারাইজার ধরে রাখে। শুধু একটি জিনিস মনে রাখতে হবে, আর তা হলো – এই মিশ্রণটি চোখের চারপাশে সাবধানে লাগাতে হবে।
৩. ডিম ও লেবুর রসের ফেইসপ্যাক:
একটি ডিমের সাদা অংশের সাথে অর্ধেকটা লেবুর রস ও এক টেবিল চামচ কমলালেবুর রস, কুসুম গরম পানি দিয়ে পেস্টের মতো করে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর এই প্রলেপটি আস্তে আস্তে ত্বকে মাখতে হবে।
এরপর ২০ মিনিট মতো রেখে। শুকিয়ে যাবার পর ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে ফেলতে হবে। এই প্যাকটি ত্বকের তৈলাক্ত ভাব দূর করার পাশাপাশি ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে।
৪. লেবুর রস ও মধুর ফেইসপ্যাক:
একটি বড় লেবুর অর্ধেক অংশ কেটে তার রস বের করে নিয়ে। তাতে ২ টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরী করতে হবে। ১৫ মিনিট মুখে লাগিয়ে রাখতে হবে।
ত্বক টেনে ধরলে ঠান্ডা পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। মধু যখন আপনার ত্বক উজ্জ্বল করবে, লেবুর প্রাকৃতিক ব্লিচিং গুন ত্বককে করবে আরও ফর্সা।
অনেকের ত্বকে ঘন ঘন ব্রণ উঠে, অল্প বয়সে ত্বক বুড়িয়ে যায়, ত্বকে কালো কালো ছোপ দাগ পড়ে। কিন্তু আপনার হাতের কাছে থাকা একটি লেবু দিতে পারে ত্বকের সব সমস্যার সমাধান।
পরিশেষে বলা যায়, ফেইস প্যাকগুলো বর্তমানে মেয়েদের কাছে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কারণ, অল্প সময়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। ত্বকের কোন ক্ষতিও হয় না।
বাজারে পাওয়া যায় এমন বিভিন্ন ধরণের কেমিক্যাল ব্যবহারে আপনার ত্বক পুড়ে যেতে পারে। সেদিকটা চিন্তা করে যেকোন বয়সের মেয়ে মুখের সৌন্দর্যের জন্য ফেইস প্যাকগুলো নিশ্চিন্তে ব্যবহার করতে পারে।
আরও পড়ুন: ব্রণ ও ব্রণের দাগ চিরতরে দূর করার ঘরোয়া টিপস – ৭ দিনও লাগবে না ব্রণ সারাতে।