রক্তশুন্যতা:
সাধারণ ভাষায় রক্তশুন্যতা হলো রক্তের লোহিত রক্তকণিকা কমে যাওয়া। রক্তের লোহিত রক্তকণিকাকে ইংরেজীতে বলা হয় Red Blood Cell (RBC) আর বাংলায় বলা হয় হিমোগ্লোবিন।
রক্তশুন্যতা হলে রক্তের অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা কমে যায়। শরীরে একক সময়ে যতোটুকু অক্সিজেনযুক্ত রক্ত বহন করার দরকার রক্ত তা করতে ব্যর্থ হয়।
এটি ধীরগতিতে কিংবা দ্রুতগতিতে এই দুইভাবেই হতে পারে। যখন রক্তশুন্যতা ধীরগতিতে হতে থাকে তখন একজন মানুষের মধ্যে ক্লান্তি লাগা, দূর্বলতা অনুভব করা, মাথা ব্যথা এবং শ্বাস-কষ্টের মতো লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে।
আবার যখন দ্রুতগতিতে রক্তশুন্যতা দেখা দিতে থাকে তখন একজন মানুষের বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, চেতনা হ্রাস পাওয়া এবং প্রচুর তৃষ্ণা লাগার মতো লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, রক্তশুন্যতা হলে হিমোগ্লোবিন নামক রঞ্জক পদার্থের পরিমাণ কমে যায় যা রক্তের মধ্যে থাকে। যখন বয়স ও লিঙ্গ ভেদে হিমোগ্লোবিন কাঙ্খিত মাত্রার চেয়ে কম পরিমাণে থাকে তখনই রোগ হিসেবে অ্যানিমিয়া বা রক্তশুন্যতা বলা হয়।
শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি উপাদান হলো হিমোগ্লোবিন। কোষে অক্সিজেন সরবরাহ করার মতো গুরুদায়িত্ব কাজটি করে এই হিমোগ্লোবিন।
তাহলে বুঝতেই পারছেন, যখন হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি হয় তখন শরীরের কোষগুলোতে ঠিকমতো অক্সিজেন সরবরাহ হয় না। তখন শরীর খুব সহজেই দূর্বল হয়ে যায় এবং নানাবিধ রোগ লক্ষণ দেখা দেয়।
মূলত রক্তশুন্যতা কোনো রোগ নয়, রোগের লক্ষণ মাত্র। জানলে অবাক হবেন, পৃথিবীর প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ এই সমস্যায় ভোগেন। আবার সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৬০ কোটির বেশি মানুষ আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তশুন্যতায় ভুগছে। সুতরাং এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে অভিহিত।
রক্তশুন্যতা কেন হয়?
রক্তশুন্যতা হওয়ার পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। মহিলারা যখন ঘন ঘন সন্তান নেয় তখন রক্তের ঘাটতি তথা হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি স্বাভাবিকভাবেই হতে পারে।
আর আয়রনের ঘাটতি হলো রক্তশুন্যতার প্রধান ও বড় একটি কারণ। সারাবিশ্বে যতো মানুষ এই সমস্যায় ভোগে তাদের বেশিরভাগই মূলত আয়রনের ঘাটতির কারণে।
যদি কারও শরীরের লোহিত রক্তকণিকা সময়ের আগেই ভেঙে যায় তবুও রক্তশুন্যতা হতে পারে। কিছু দীর্ঘস্থায়ী রোগ হলেও এমন সমস্যা হয়।
দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন- কিডনী সংক্রান্ত সমস্যা, লিভার এর সমস্যা, থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা, যক্ষ্মা ও আর্থাইটিস এর মতো রোগগুলোর কারণে রক্তশুন্যতা হতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া (হিমোগ্লোবিনের জিনগত রোগ) রোগের কারণেও এমন সমস্যা দেখা যায়। পুষ্টির অভাব, পেপটিক আলসার, বেশি পরিমাণে ব্যথার ওষুধ সেবনের ফলেও রক্তশুন্যতা দেখা দেয়।
মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, পাইলস রোগ ও কৃমির সংক্রমণও কিছুটা দায়ী এই রোগ হওয়ার জন্য। অন্যদিকে, ভিটামিন সি এবং ফলিক অ্যাসিডের অভাবেও রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে।
রক্তশুন্যতার প্রকারভেদ:
রক্তশুন্যতাকে বিভিন্নভাগে বিভক্ত করা যায়। নিম্নে প্রধান কিছু প্রকারভেদ উল্লেখ করা হলো:
- অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানেমিয়া
- হিমোলাইটিক অ্যানেমিয়া
- থ্যালাসেমিয়া
- সিকেল সেল অ্যানেমিয়া
- পারসিনিয়াল অ্যানেমিয়া এবং
- ফ্যানকনি অ্যানেমিয়া
উপরে উল্লিখিত রক্তশুন্যতার প্রকারভেদগুলোর বিস্তারিত বিবরণ এই পোস্ট যখন আপডেট করা হবে তখন সংযুক্ত করা হবে।
রক্তশুন্যতার লক্ষণ:
রক্তশুন্যতা হলে শরীরে নানারকম লক্ষণ দেখা দেয়। তন্মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
- শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। বাইরে থেকে এটা বোঝার কোনো উপায় নেই। রোগী যেকোন কাজে খুব সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
- ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যায়। চোখের ভেতরের মাংস পেশিগুলোর লাল রং কমে যেতে শুরু করে।
- মাথার চুল পড়ে যায়। কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠলে চারপাশ অন্ধকার মনে হয়।
- বেশিরভাগ রোগীই বিষন্নতায় ভোগেন। প্রচুর পরিমাণে মাথা ব্যথা হতে পারে। কিছু রোগী মানসিক অবসাদে ভোগে।
- দিনে কিংবা রাতে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। গরমকালেও শরীরে ঠাণ্ডা লাগে।
- খাবারে অরুচি চলে আসে। খাবার খেতে পারে না। রাতে পানি তৃষ্ণা পেতে পারে। মনে রাখার ক্ষমতা কমতে থাকে।
চিকিৎসা ও করণীয়:
প্রথমে দেখতে হবে আয়রনের ঘাটতি কতোটা হয়েছে? তারপর কিছু পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে রক্তে হিমোগ্লোবিনের কি অবস্থা তা জানতে হবে।
সাধারণত আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তাল্পতার ক্ষেত্রে আয়রণ জাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে খেতে হবে। অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মতো আয়রণ জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
রক্তের লোহিত রক্তকণিকার মাত্রা জানার জন্য সি,বি,সি নামক পরীক্ষা করতে হয়। আর এই পরীক্ষার মাধ্যমেই জানা যায় রক্তশুন্যতা কতোটা হয়েছে নাকি হয়নি।
অন্যদিকে, আয়রণের মাত্রা পরীক্ষা করার জন্য সিরাম আয়রণ এবং সিরাম ফেরিটিন নামক পরীক্ষা করতে হয়। এটাকে সংক্ষেপে টি,আই,সি,বি বলে।
কারও যদি অপুষ্টিজনিত কারণে রক্তাল্পতা দেখা দেয় তবে তাকে চিকিৎসকগণ সাধারণত আয়রন সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় লাল মাংস, গিলা, কলিজা, লাল শাক, কচু শাক, ছোট মাছ, আনাজ এবং বিভিন্ন সবুজ শাক-সবজির পরিমাণ বাড়াতে হবে।
আরও পড়ুন: আর্সেনিকযুক্ত পানি খেলে কিডনী শেষ | বিস্তারিত পড়ুন।
প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আয়রণ সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার পাশাপাশি ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ও ফলিক অ্যাসিড খাওয়া যেতে পারে।
প্রতিদিন দুধ, ডাল, মধু, ভিটামিন সি জাতীয় ফল, ডিমের কুসুম এবং সয়াবিন যথেষ্ট পরিমাণে খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, রক্তশুন্যতা কোনো ছোট সমস্যা নয়। রক্তশুন্যতা নিজে কোনো রোগ নয় কিন্তু বহু রোগ সৃষ্টি করতে এর জুড়ি নেই।
তাই রক্তশুন্যতার লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই উপরে বর্ণিত করণীয়গুলো সম্পর্কে সচেতন হোন। সমস্যার শুরুতেই সমাধান করার চেষ্টা করতে হয়। রোগ বড় হয়ে গেলে তখন অর্থের সাথে সাথে অনেক কষ্টও স্বীকার করতে হয়।
আপনি যদি উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রেক্ষিতে নিশ্চিত হতে পারেন যে, আপনার রক্তশুন্যতার মতো সমস্যা বোধ হয় আছে তবে জরুরী পরীক্ষা করুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।