মৃগী (ইংরেজি- Epilepsy) নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়ুবিক রোগ যাতে খিঁচুনি হয়। এই রোগের প্রকৃত কারণ জানা না গেলেও মস্তিষ্কে আঘাত,স্ট্রোক, মস্তিষ্কে টিউমার বা সংক্রমণ, জন্মগত ত্রুটি প্রভৃতিকে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
জিনগত মিউটেশন কিছুকিছু ক্ষেত্রে দায়ী বলে মনে করা হয়। মস্তিষ্কের সেরেব্রাল কর্টেক্সের স্নায়ু কোষসমূহের অতিরিক্ত ও অস্বাভাবিক ক্রিয়ার ফলে খিঁচুনি হয়।
বার বার স্নায়বিক কারণে ফিট অর্থাৎ হঠাৎ খিচুনি বা অজ্ঞান হয়ে যাবার রোগ। এটি একপ্রকার মস্তিষ্কের রোগ; চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় “নিউরোলোজিক্যাল ডিজিজ”।
মানব মস্তিষ্কের কার্যপ্রণালীতে বিঘ্ন সৃষ্টি হলে এই রোগ দেখা দেয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে গবেষকদের ধারণা ছিল মৃগী রোগ থাকলেই ব্যক্তির বুদ্ধি-বিচার-বিবেচনা বোধের উৎকর্ষ কমে যায়।
কিন্তু বর্তমানকালের গবেষকরা মনে করেন, মৃগী রোগে আক্রান্তদের খুব কম অংশে বিচার-বুদ্ধিমত্তার ঘাটতি দেখা যায়। (উইকিপিডিয়া হতে নেয়া)
তো আজ আমরা শিশুদের মৃগী রোগ নিয়ে জানবো। কেন হয়, করণীয় কি, কি কি বিষয়ের উপর সাবধানতা অবলম্বন করতে ইত্যাদি বিষয়ে জানবো। আর কথা নয় – সরাসরি মূল আলোচনায় যাচ্ছি।
শিশুকে রোগ সম্পর্কে জানান:
শিশুর কাছে তার রোগ সম্পর্কে লুকোছাপা করা বা মিথ্যা তথ্য দেয়া অনুচিত। এতে শিশু বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, স্বাভাবিক জীবনযাপনে উৎসাহ হারায়।
সন্তানের কাছে তার রোগের ব্যাপারে আপনার পক্ষে যতোটা সম্ভব খুলে বলুন। আপনি এ বিষয়ে অজ্ঞ হলে রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে উদ্যোগী হোন।
নিজে শিশুর কাছে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করতে না পারলে অভিজ্ঞ কারো সহায়তা নিন। এ ব্যাপারে কোনো লুকোছাপা না করে শিশুকে প্রকৃত অবস্থা বুঝিয়ে দিন। এ রোগে দীর্ঘমেয়াদে ওষুধ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তাকে বুঝিয়ে বলুন।
ইতিবাচক হোন:
যদিও মৃগী একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ, কিন্তু তা আপনার শিশুর স্বাভাবিক জীবন-যাপনকে যেন অচল করে না দেয়, সেদিকে লক্ষ রাখুন।
মৃগীতে আক্রান্ত বলে শিশু পড়াশোনা করতে পারবে না বা কোনো সৃজনশীল বা দৈনন্দিন কাজে সক্ষম বা পারদর্শী হবে না এমন নেতিবাচক ভাবনা ঝেড়ে ফেলুন।
আবার, রোগাক্রান্ত বলে শিশুর প্রতি মমত্ব দেখিয়ে সকল অন্যায় আব্দার মেনে নিতে হবে এমনটিও নয়। তাকে অন্যদের মতোই স্বাভাবিক শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন-যাপনে উৎসাহিত করুন।
নিয়মিত ওষুধ খাওয়ান, চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন:
মৃগীরোগীর ওষুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে অত্যন্ত মনোযোগী হতে হবে। নির্ধারিত সময়ে নিয়মিত ওষুধ খাওয়াতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করা যাবে না, এমনকি বেশ কয়েকদিন ধরে খিঁচুনি বন্ধ থাকলেও ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে।
চিকিৎসকের সঙ্গে শিশুর সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করুন এবং শিশুকেও তার সমস্যা সম্পর্কে চিকিৎসকের কাছে খোলামেলা হতে উদ্বুদ্ধ করুন।
ওষুধ কার্যকর ভূমিকা রাখতে সময় লাগতে পারে বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকের কাছে খোলামেলাভাবে সমস্যার ব্যাপারে জানালে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
ঘরে নিন বিশেষ ব্যবস্থা:
মৃগী রোগাক্রান্ত শিশুর নিরাপত্তার জন্য ঘরে নেয়া উচিত বিশেষ ব্যবস্থা। যেমন- ঘরের পাকা মেঝে নরম কার্পেটে ঢেকে দেয়া যেতে পারে।
কার্পেটের নিচে রাখা যেতে পারে প্যাড, যাতে শিশুর হঠাৎ খিঁচুনি উঠে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেও মারাত্মক কোনো আঘাত না পায়।
বাথরুম ও রান্নাঘরে ভিনাইল কুশন, কর্ক বা রাবার ব্যবহার করা ভালো। সিঁড়ি শুকনো ও পরিষ্কার রাখুন। অতিরিক্ত নিরাপত্তার খাতিরে সিঁড়ির গোড়ায় কার্পেট রাখা যেতে পারে।
যদি, লিফট ব্যবহার করা হয়, সে ক্ষেত্রে লিফটের ভেতর প্যাড ব্যবহার করে ঝুঁকি কমানো যেতে পারে।
ধারালো কিনারাযুক্ত আসবাবপত্র প্যাড, রাবার, ফোম বা কাপড় দিয়ে মুড়ে দিন, যাতে খিঁচুনির সময় শিশু ঐ ধারালো কিনারার আঘাতে আহত না হয়।
অথবা গোল কর্নারযুক্ত আসবাবপত্র ব্যবহার করুন। হাতলযুক্ত চেয়ার ব্যবহার করুন। চেয়ার-টেবিল ও অন্যান্য আসবাব বিছানা থেকে দূরে রাখুন।
শিশুর শোয়ার বিছানার চারপাশে কুশন বা লেপ-তোশকজাতীয় কিছু রাখুন যাতে ঘুমের ভেতর খিঁচুনি উঠলেও শিশু গড়িয়ে বিছানা থেকে পড়ে না যায়। লক্ষ রাখুন, আক্রান্ত শিশুর বিছানা যেন বেশি উঁচু না হয়।
শিশুকে বাথটাব বা সুইমিংপুলে গোসল না করিয়ে বসে থাকা অবস্থায় শাওয়ারের নিচে গোসল করানো ভালো।
কিছুটা বয়সী শিশু যারা নিজে নিজে গোসল করে, তাদের ক্ষেত্রে গোসলের সময় যেন বাথরুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ না করা হয়।
বাথরুমে ছিটকিনি বা লক না থাকাই ভালো। দরজা এমন হবে যেন তা বাথরুমের বাইরের দিকে খোলে।
শিশু যেন ক্লান্ত অবস্থায়, ঘুম বাদ দিয়ে টেলিভিশন না দেখে বা কম্পিউটার গেম না খেলে সেদিকে লক্ষ রাখুন। যে রুমে টিভি বা কম্পিউটার সেখানে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকা উচিত। মনিটরের উজ্জ্বলতা কমিয়ে দিন।
খেলাধুলায় সতর্কতা:
মৃগী রোগে আক্রান্ত হওয়া মানেই জীবনের সকল আনন্দ থেকে ছুটি নেয়া নয়। সতর্কতা বজায় রেখে মৃগী-আক্রান্ত শিশুও অন্য শিশুদের মতো সাধারণ যে কোনো খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে পারে।
তবে, প্রয়োজনে নিরাপত্তা হেলমেট ব্যবহার করা ভালো। সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, নৌকা চালনা বা পানির কাছে খেলাধুলা করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
কারণ, এ সময় খিঁচুনি উঠে পানিতে ডুবে গেলে জীবনাশঙ্কা দেখা দেয়। তাই, এসব ক্ষেত্রে সঙ্গে একজন তত্ত্বাবধায়ক থাকা ভালো যিনি শিশুর মৃগী রোগ সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল।
ঝুঁকিপূর্ণ খেলাধুলা, যেমন: পাহাড়ে ওঠা, প্যারাসুট জাম্প প্রভৃতি থেকে শিশুকে বিরত রাখুন। খিঁচুনিমুক্ত হওয়ার পরও কমপক্ষে ছয় মাস সাইকেল চালাতে না দেয়াই উচিত।
স্কুলগামী শিশুদের ক্ষেত্রে:
স্কুল-কর্তৃপক্ষের কাছে আপনার সন্তানের মৃগীরোগের কথা গোপন করবেন না। রোগী কি ওষুধ পাচ্ছে, রোগীর চিকিৎসকের ঠিকানা-ফোন নম্বর, আপনার ফোন নম্বর প্রভৃতি স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রাখুন।
প্রয়োজনে স্কুল-কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের মৃগীরোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান দান করুন। তাহলে, স্কুল-চলাকালীন ওষুধ খাওয়ার সময় হলে বা খিঁচুনি দেখা দিলে স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
অনেক মৃগীরোগাক্রান্ত শিশুর ক্লাসে পড়া বুঝতে সমস্যা হতে পারে। স্কুল-শিক্ষকের রোগের ব্যাপারটি জানা থাকলে তিনি আপনার শিশুর পড়ালেখাজনিত সমস্যায় আরো বেশি সহযোগিতা করতে পারবেন।
স্কুলের অন্য শিশুদের সঙ্গে আপনার রোগাক্রান্ত শিশুকে মিশতে উদ্বুদ্ধ করুন। সহপাঠী ও তার অভিভাবকদের বুঝতে দিন বা বোঝান যে, মৃগী কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়।
সহপাঠীদের বাসায় দাওয়াত করুন যাতে মৃগীরোগীর সুস্থ থাকাকালীন পারিবারিক পরিবেশের স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটে।
পরিশেষে বলা যায়, মৃগী রোগীর প্রতি সবসময় আলাদা রকমের যত্ন নিতে হয়। তাকে একা একা কোথাও পাঠানো ঠিক না। কাউকে কাউকে সাথে রাখা উচিত। আর সর্বোপরি এসব সমস্যার ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রোগীকে রাখা উচিত।
আরও পড়ুন: যেসব খাবার খেলে মস্তিষ্ক খুব শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং স্মৃতিশক্তি প্রখর হয়।