১. মিথ্যা মামলা হলে প্রাথমিক করণীয়:
যদি আপনার বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়, তাহলে এজাহারের কপিটি সংগ্রহের চেষ্টা করুন। আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করুন। মামলার এজাহারে দেখতে হবে, অভিযোগগুলো জামিনযোগ্য বা অযোগ্য কি না।
যদি এমন হয় যে আপনি জানতে পারলেন না, আপনার বিরুদ্ধে থানায় এজাহার হয়েছে। পুলিশ এসে আপনাকে গ্রেপ্তার করল। আপনাকে থানায় নিয়ে গেল। গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে আদালতে প্রেরণ করা হবে।
তখন আপনার আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করতে হবে। যদি রিমান্ড চায় পুলিশ, তাহলে আপনার আইনজীবীর উচিত হবে রিমান্ড বাতিলের জন্য আবেদন করা।
যদি জামিন দেন আদালত, তাহলে একজন পরিচিত জামিনদারের জিম্মায় আপনার জামিননামা সম্পাদন করতে হবে। যদি জামিন না হয়, তাহলে পর্যায়ক্রমে উচ্চ আদালতে আবেদন করতে হবে।
২. জামিন কখন এবং কোথায় চাইবেন:
অভিযোগ তেমন গুরুতর না হলে এবং জামিনযোগ্য হলে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে পারেন। অনেক সময় অভিযোগ জামিন অযোগ্য হলে অনেককে হাইকোর্ট বিভাগে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে আগাম জামিন চাইতে দেখা যায়।
হাইকোর্ট বিভাগ আগাম জামিন সাধারণত নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত দিয়ে থাকেন। এ মেয়াদের মধ্যেই নিম্ন আদালতে গিয়ে জামিননামা সম্পাদনের জন্য আবেদন করতে হবে।
আদালতে প্রতি তারিখে হাজিরা দেওয়া বাধ্যতামূলক। কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া অনুপস্থিত থাকলে আপনার জামিন বাতিল করে দিতে পারেন আদালত।
জামিন সাধারণত পুলিশ প্রতিবেদন হওয়ার আগেই চাইতে হয়। তবে পুলিশঅভিযোগপত্র দাখিল করার আগে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণদিয়ে আপনার বিরুদ্ধে যে মিথ্যা অভিযোগটি দায়ের করা হয়েছে, তা প্রমাণের চেষ্টা করুন।
তদন্তকারী কর্মকর্তা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগটির সত্যতা না পেলে আপনাকে নির্দোষ দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করবেন।
৩. চার্জশিট দাখিলের পর কি হবে:
চার্জশিট বা অভিযোগপত্র হয়ে গেলে আপনার মামলাটি বিচারিক আদালতে বদলি হবে। অভিযোগ গঠনের দিন আপনাকে হাজির হয়ে নতুন করে পূর্বশর্তে জামিন চাইতে হবে এবং জামিননামা সম্পাদন করতে হবে।
তখন আপনি মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করতে পারেন। অব্যাহতির আবেদন নাকচ হলে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন।
৪. আদালতে মামলা হলে করণীয়:
যদি থানায় মামলা না হয়ে আদালতে মামলা (সিআর মামলা) হয়, তাহলে আদালত সমন দিতে পারেন কিংবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করতে পারেন।
এ ক্ষেত্রেও আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে হাইকোর্ট বিভাগে আগাম জামিন চাইতে পারেন। মনে রাখতে হবে, সিআর মামলায় অভিযুক্ত সব আসামি হাজির হলেই বিচারের জন্য মামলাটি বদলি করা হয়।
আপনি কোনো কারণে হাজির না হলে আপনার জামিন বাতিল হতে পারে। পর্যায়ক্রমে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি হতে পারে। এতে হাজির না হলে আপনার মালামাল ক্রোকের আদেশ হতে পারে এবং আপনার অনুপস্থিতিতেই বিচার হতে পারে।
তবে সাক্ষ্য প্রমাণে আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে মিথ্যা অভিযোগকারী বা মামলা দায়ের কারীর বিরুদ্ধে আপনি প্রচলিত আইনেই মামলা দায়ের করতে পারেন।
৫. দেওয়ানী মামলায় করণীয়:
যদি আপনার বিরুদ্ধে দেওয়ানি মোকদ্দমা হয়, তাহলে জবাব দাখিলের জন্য আদালত আপনাকে সমন পাঠাবেন। নির্ধারিত তারিখে হাজির হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে জবাব দাখিল করতে হবে। পরবর্তী সময়ে মোকদ্দমা ধারাবাহিকভাবে এগোবে।
৬. মিথ্যা মামলাকারীর বিরুদ্ধে আপনি কি পদক্ষেপ নিতে পারেন?
ফৌজদারী কার্যবিধির ২৫০ ধারা উপধারা (১) অনুসারে কোন মামলা যদি নালিশের মাধ্যমে অথবা পুলিশের বা ম্যাজিষ্ট্রেট কাছে তথ্য প্রদান করার মাধ্যমে করা হয় এবং পরবর্তীতে যদি ম্যাজিষ্ট্রেট অভিযুক্ত বা একাধিক অভিযুক্তের কাউকে খালাস দেন।
এছাড়াও ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে প্রতীয়মান হয় যে , অভিযোগগুলো মিথ্যা ও হয়রানিমূলক তাহলে কেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না এই মর্মে উক্ত অভিযোগকারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে পারেন। অভিযোগকারী আদালতে অনুপস্থিত থাকলে আদালত হাজির হয়ে কারণ দর্শানোর জন্য সমন জারী করতে পারেন ।
উপধারা (২) অনুসারে, অভিযোগকারী কারণ দর্শানোর পর ম্যাজিষ্ট্রেট যদি মনে করেন আনীত অভিযোগগুলো মিথ্যা ও হয়রানিমূলক তাহলে সর্বোচ্চ ১০০০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারেন।
এক্ষেত্রে তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট হলে জরিমানার পরিমাণ হবে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। জরিমানার অর্থটি মামলায় বিবাদীকে পরিশোধ করতে হবে। জরিমানা অনাদায়ে ম্যাজিষ্ট্রেট সর্বোচ্চ ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করতে পারেন।
মিথ্যা নালিশ আনয়নকারী সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ করা যায়।
কোনো পুলিশ কর্মকর্তা আমলযোগ্য নয়, এ রকম কোনো মামলায় মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে তাঁর বিরুদ্ধেও এ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ প্রদান করা যায়।
দণ্ডবিধির ১৯৩ ধারা অনুসারে বিচারিক প্রক্রিয়ার কোন পর্যায়ে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে বা সাক্ষ্য বিকৃত করলে ঐ ব্যক্তি সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে বা সাক্ষ্য বিকৃত করলে তিন বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধিরি ১৯৪ ধারা অনুসারে যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য বা সাক্ষ্য বিকৃত করে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য কোন অপরাধে কাউকে দণ্ডিত করায়, সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন ।
এক্ষেত্রে মিথ্যা সাক্ষ্য বা সাক্ষ্য বিকৃত করার ফলে যদি নির্দোষ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়, তাহলে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানকারী মৃত্যুদণ্ড বা ১৯৪ ধারায় বর্ণিত অন্যান্য দণ্ডে দণ্ডিত হবেন ।
দণ্ডবিধির ১৯৫ ধারায় উল্লেখ আছে, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য বা সাক্ষ্য বিকৃত করে কাউকে এমন কোন অপরাধে দণ্ডিত করায় যার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সাত বছরের কারাদণ্ড, তাহলে উক্ত ব্যক্তিও সমদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এছাড়াও তথ্য প্রমাণ গোপন করা, অপরাধ সংগঠনের মিথ্যা সংবাদ প্রদান করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ আদায়ের মামলাও করতে পারেন।
পরিশেষে বলা যায়, মিথ্যা মামলা কারও জন্যই কাম্য নয়। মিথ্যা মামলা করে মানুষকে হয়রানি করা যায় ঠিকই কিন্তু কখনো জেতা যায় না। তারপরেও আপনার যদি আশপাশে বেশি শত্রু থাকে তবে একটু সতর্ক থাকা উচিত।
আরও পড়ুন: সময় এর সাথে বয়সের গুরুত্ব – সময় গেলে সাধন হবে না।