মাইগ্রেন রোগ:
মাইগ্রেন হলো এক ধরণের মাথা ব্যথা। মাইগ্রেন (Migraine) হলো মূলত একটি ইংরেজী শব্দ। মাইগ্রেন হলে মাথা ব্যথা সাধারণত একদিকে হয়। তবে মাথার দু’দিকেও ব্যথা হতে পারে।
সবার মাইগ্রেন হয় না। সাধারণত যাদের মাইগ্রেন হবার প্রবণতা আছে তাদের বিশেষ কিছু জিনিস এড়িয়ে চলতে হয়। তা নাহলে হতে পারে বিপদ।
আলো, গন্ধ, শব্দ, চকলেট, আঙুরের রস, পনির, বাতাসের চাপের তারতম্য ইত্যাদির প্রভাবে মাইগ্রেন হতে পারে এবং সাথে ভয়ংকর ব্যথা হতে পারে।
মাইগ্রেন এর বেশ কয়েকটি ধরণ আছে। সবার একরকম হয় না। মাইগ্রেন এর ধরণের তারতম্যের কারণে মাথা ব্যথা হওয়ার ক্ষেত্রেও তারতম্য দেখা যায়।
মাইগ্রেন কে বলা হয় স্নায়ুবিক রোগ। বাংলায় বলা হয় আধ কপালে মাথা ব্যথা। সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় ১০% এর অধিক মানুষ এ সমস্যায় ভোগেন। মাইগ্রেন হলো বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রোগ।
বিভিন্ন কারণে মাইগ্রেন হতে পারে। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো মস্তিষ্কের মধ্যে টিউমার হওয়া, নিয়াসিন এবং ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এর অভাব হওয়া। এগুলো হলে মাথা ব্যথা বেড়ে যায়।
তবে দৈনন্দিন চিকিৎসার মাধ্যমে মাইগ্রেন রোধ করা সম্ভব। অনেকেই বলে থাকেন যে, চোখের কারণে অনেক সময় মাইগ্রেন হয়ে থাকে। কিন্তু চোখের সাথে মাইগ্রেন এর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।
কিন্তু প্রচন্ড পরিমাণে দাঁত ব্যথা, চোখ ব্যথা কিংবা কানের ব্যথা থেকে মাথা ব্যথা হতে পারে। মনে রাখবেন, সব মাইগ্রেন-ই মাথা ব্যথা কিন্তু সব মাথা ব্যথা মাইগ্রেন নয়।
মাইগ্রেন হওয়ার কারণ:
মাইগ্রেন যেকোন বয়সে হতে পারে। সাধারণত ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে খুব বেশি হয়। বিভিন্ন গবেষণা অনুসারে, এটি বংশগত কারণেও হতে পারে। বংশের পূর্ব পুরুষের কারও যদি মাইগ্রেনজনিত সমস্যা থেকে থাকে তবে পরিবারে অন্যদের হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে, বেশিরভাগ নারীদের মাসিক চলাকালীন সময়ে কিংবা তার পূর্বে মাথা ব্যথা বাড়ে। কোমল পানীয়, কফি, চকলেট, জন্ম বিরতিকরণ ওষুধ, দুশ্চিন্তা, বেশি করে খাওয়া ইত্যাদি কারণে মাইগ্রেন হতে পারে।
আবার অতিরিক্ত সময় ধরে টিভি বা কম্পিউটার দেখলে, অতিরিক্ত ভ্রমণ করলে কিংবা মোবাইলে বেশিক্ষণ কথা বললেও মাইগ্রেন হতে পারে। আর আগে থেকে মাইগ্রেন হওয়া থাকলে এই কাজগুলো করার কারণে তা মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে বেড়ে যেতে পারে।
আপনি জানলে অবাক হবেন যে, মাইগ্রেন পুরুষের তুলনায় নারীদের বেশি হয়। পরিসংখ্যান তাই বলে। তাই নারীদের একটু সাবধান হওয়া উচিত। মাইগ্রেন সংক্রান্ত বিষয়ে নারীদের কাউন্সেলিং করানো উচিত।
মাইগ্রেন এর লক্ষণ:
মাইগ্রেন হলে আপনার শরীরে বিভিন্ন প্রকার লক্ষণ দেখা দিতে পারে যদিও প্রধান লক্ষণ মাথা ব্যথা। সব ধরণের মাথা ব্যথাকেই সাধারণ মনে করবেন না। তাই মাথা ব্যথা হলে সচেতন হোন আর নিম্নোক্ত লক্ষণগুলোর সাথে মিলিয়ে নিতে পারেন। মাইগ্রেন হলে যেসব লক্ষণ দেখা দেয়:
- আপনি যে পরিবেশে থাকেন না কেন হঠাৎ করে মাথার এক পাশে ব্যথা শুরু হতে পারে।
- মাথা ব্যথা হওয়ার সাথে সাথে বমি হতে পারে কিংবা বমি-বমি ভাব হতে পারে।
- মাথা ব্যথা শুরু হওয়ার আগে কোনো কাজে মনোযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত হাই তোলা, বিরক্তিবোধ করা ইত্যাদি উপসর্গগুলো দেখা দেয়।
- একবার যদি মাথা ব্যথা শুরু হয় তাহলে তা কয়েক ঘন্টা থেকে শুরু করে কয়েকদিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
- ব্যথা মাথার একপাশে শুরু হয়ে পুরো মাথায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। বলা বাহুল্য, ব্যথা কপালেও চলে আসতে পারে।
- অতি উজ্জল আলোতে গেলে ব্যথা বেড়ে যায়।
- চোখের পেছন দিকেও ব্যথার অনুভূতি হতে পারে।
- খাবারে অরুচি দেখা দিতে পারে। ব্যথায় কাতরাতে থাকে। সাধারণত ওষুধে কাজ হলে তা স্থায়ী হয় না।
- বাক শক্তি লোপ পেতে শুরু করে।
- শারিরীক দূর্বলতা প্রকাশ পায়।
- হাতে-পায়ে সূচ ফোঁটানোর মতো ব্যথা হতে পারে।
যেসব খাবারে মাইগ্রেন বাড়ে:
এ রোগের ক্ষেত্রে কিছু খাবার আসলে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এমন কিছু খাবার আছে যেগুলো খেলে মাইগ্রেন এর ব্যথা হঠাৎ শুরু হতে পারে আবার এমন কিছু খাবার আছে যেগুলো খেলে ব্যথা বেড়ে যায়।
আপনি নিজেই এই কাজটি করতে পারেন। যখন কোনো খাবার খাচ্ছেন তখন একটু খেয়াল রাখবেন যে, খাবার খাওয়ার পরে আপনার কেমন মনে হচ্ছে? হঠাৎ কি ব্যথা শুরু হচ্ছে নাকি শুরু হওয়া ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে প্রভাবক হিসেবে কাজ করা খাবারগুলো সম্পর্কে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন।
সাধারণত বিশেষ কিছু খাবার আপনি এড়িয়ে চলতে পারেন তথা কম খেতে পারেন। বিভিন্ন গবেষণায় এই খাবারগুলো যে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সাধারণত চা, কফি, কোমলপানীয়, বিভিন্ন প্রকার চকলেট, আইসক্রিম, দুধ, দই, মাখন, টমেটো, পেয়াজ, আপেল, কলা, চিনাবাদাম, টক জাতীয় ফল এবং গম এগুলো আপনি পরিহার করতে পারেন বা কম খেতে পারেন।
প্রকৃত অর্থে উপরে উল্লিখিত খাবারগুলো একেবারেই যে খাবেন না তা নয়। তাহলে আপনি খাবেন কি? আপনি অবশ্যই এই খাবারগুলো খাবেন। যে খাবারে মাইগ্রেন খুব বেশি প্রভাবিত হয় সেগুলো খাবেন না।
যেসব খাবার রোগটি কমাতে সাহায্য করে:
এটি এমন একটি রোগ যা কখনো একেবারে নির্মূল হয় না। সোরিয়াসিস নামক চর্মরোগ এর মতোই। কিন্তু আপনি সুস্থ্য ও সুন্দর জীবনযাপন করতে পারবেন। আপনাকে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে।
আপনি প্রতিদিন তিনবার না খেয়ে পাঁচ বার খাবেন। যখন খাবেন তখন অল্প অল্প করে খাবেন। পেট একদম ভরে খাবেন না। তাহলে আপনার প্রেসার অর্থাৎ রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকবে।
চর্বি জাতীয় খাবার যেমন- গরুর মাংস, ভুড়ি, পাঙ্গাস মাছ এগুলো কম খাবেন। কিন্তু শর্করাজাতীয় খাবার খানিকটা বেশিই খাওয়ার চেষ্টা করবেন। শর্করা জাতীয় খাবার যেমন- হলুদ ও সবুজ শাকসবজি, ঢেঁকি ছাটা চাল এবং আলু। এগুলো ছাড়াও আরো অনেক শর্করাজাতীয় খাবার রয়েছে।
নিয়মিত বিভিন্ন প্রকার ফলমুল খেতে পারেন। সাধারণত খেজুর, ডুমুর, আদার টুকরো, তিল সহ ইত্যাদি মাইগ্রেন এর ব্যথা কমাতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
এছাড়াও প্রতিদিন অন্তত কয়েকটি করে বাদাম খাওয়ার চেষ্টা করুন। শরীরের ম্যাগনেসিয়াম এর ঘাটতি পূরণের জন্য আলু এবং লাল আটা খেতে পারেন। যেহেতু মানুষের হাড় এবং দাঁত ব্যথার সাথে মাথা ব্যথার সম্পর্ক আছে সুতরাং প্রতিদিন ভিটামিন ডি আছে এমন খাবার খাওয়া বাড়িয়ে দিন।
ভিটামিন ডি রয়েছে এমন খাবারগুলো হলো- ডিমের কুসুম, মাশরুম, পনির, দই, গরুর কলিজা সহ ইত্যাদি। তবে বাজারে বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যায়। প্রয়োজনে সেগুলোও খেতে পারেন।
এ রোগ থেকে রক্ষা পেতে করণীয়:
মাইগ্রেন এমন একটি অসুখ যার হয় সেই জানে এর জ্বালা কেমন। আসলে মানুষের সকল চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হলো মাথা। আর এই মাথা-ই যদি সারাক্ষণ ব্যথা করে তাহলে কি আর ভালো লাগে? সব কিছু তখন অস্বস্তিকর মনে হয়। যাইহোক, মাইগ্রেন রোগ থেকে মুক্তি পেতে কিংবা প্রতিরোধ হিসেবে নিম্নোক্ত কাজগুলো করতে পারেন:
- যেখানে মানুষের উচ্চ কোলাহল এবং যানজট পূর্ণ পরিবেশ সেখানে বেশিক্ষণ অবস্থান করবেন না।
- যেখানে কাজ করবেন সেখানে যাতে যথেষ্ট পরিমাণে আলো থাকে। খুব কমও যাতে না হয় আবার খুব বেশিও যাতে না হয়।
- কম্পিউটারে কাজ করার সময় ৩০ মিনিট অন্তর উঠে ৫ মিনিট হেঁটে আসুন। তারপর আবার কাজ করুন।
- একটানা অনেক্ষণ টিভি দেখবেন না। তাহলে আপনার ঘুমও কমে যেতে পারে।
- প্রতিদিন সকাল সকাল ঘুমানোর চেষ্টা করবেন।
আরও পড়ুন: হেপাটাইটিস রোগ কেন হয়? চিকিৎসা সহ বিস্তারিত জেনে নিন।
- হেডফোন ব্যবহার করে কথা বলবেন না কিংবা গান শুনবেন না।
- দিনের বেশিরভাগ সময় নীরব পরিবেশে থাকার চেষ্টা করুন।
- মানুষের সাথে প্রয়োজন ছাড়া বেশি কথা বলতে যাবেন না।
- মাইগ্রেন এর ব্যথা কমাতে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ Adel 1 (Apo Dolor) সেবন করতে পারেন। অবশ্যই জার্মানী ওষুধ সেবন করবেন।
- সিনারন নামক ট্যাবলেট (অ্যালোপ্যাথি ওষুধ) খেয়ে দেখতে পারেন।
- উত্তেজক পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকুন।
- এমন পরিবেশে থাকুন যেখানে বেশি তাপ কিংবা ঠাণ্ডা কোনোটাই নেই।
- অন্তত দিনে ৮ গ্লাস কিংবা তার চেয়ে বেশি বিশুদ্ধ পানি পান করুন।
- অতিরিক্ত ব্যথা হলে মাথায় ১০ মিনিট অন্তর ঠাণ্ডা কাপড় জড়িয়ে রাখুন।
পরিশেষে বলা যায়, রোগটি যদিও সাধারণ কিন্তু যারা এই রোগের ভুক্তভোগী তাদের খুব কষ্ট হয়। রোগ যার হয় এটা কেবল সেই-ই জানে। রোগ যাতে না হয় সেই জন্য যা করা দরকার তা সবসময় আগে করবেন।
আর আপনি যদি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন কিংবা ধীরে ধীরে লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে এমন মনে হয় তাহলে অবশ্যই একজন ভালো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। আপনি এক্ষেত্রে একজন নিউরো সার্জারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এর কাছে যেতে পারেন।
উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো মেনে চলার চেষ্টা করুন। তাহলে রোগ হলেও আপনি একটু ভালো থাকতে পারবেন। এ রোগটাকে যদি কেবল নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তবেই আপনি পুরোপুরি সুস্থ্য।