মাংস আমাদের অতি প্রিয় একটি খাবার। শুধু আমাদের নয়, সারা দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষের পছন্দের খাবার মাংস।
নিমন্ত্রণ খেতে যেয়ে দু’পদের মাংস, রোস্ট, রেজালা না পেলে আমাদের অনেকেরই মন খারাপ হয়ে যায়। পূর্বে আমাদের দেশে মাংস এত সহজলভ্য ছিল না।
তুলনামূলক ভাবে দামও বেশি ছিল। গ্রাম অঞ্চলে বেড়াতে গেলে দেখা যেত লোকজন অতিথি আপ্যায়নের জন্য নিজেদের পালন করা অথবা পাড়া থেকে জোগাড় করে আনা দেশী জাতের মোরগ জবাই করতো।
কেননা হাঁটবার ছাড়া অন্যান্য মাংস যোগাড় করার সম্ভব ছিল না। বর্তমানে দেশে বিগত সময়ের মত অবস্থা নাই। দেশে সকল প্রকার মাংসের উৎপাদন যেমন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনই আমাদের মাংস খাওয়ার পরিমাণও অনেক বেড়েছে।
তাছাড়া মানুষ এখন আর শুধু মাংসের ঝোল বা রেজালা খায় না, বরং তারা মাংসের তৈরি নানা রকম খাবার যথা রোস্ট, ফ্রাই, কাবাব, নাগেট, সসেজ, চপ, বার্গার, পেটিস, মমো, শরমা, গ্রিল সহ আরও অনেক রকম খাবারের রস আস্বাদন করে।
বিশেষ ভাবে বর্তমান প্রজন্মের পছন্দের তালিকায় মাংসের অবস্থান সবার উপরে। তবে বেশিরভাগ মানুষই মাংস সম্পর্কে কিছু না জেনে-শুনে শুধুমাত্র রসনা তৃপ্তির জন্য মাংস খায়। এ জন্য মাংস সম্পর্কে আজকের এ অবতারণা। তো চলুন কথা না বাড়িয়ে মূল আলোচনায় যাই।
মাংসের প্রকারভেদ:
মাংস নানাভাবে ভাগ করা যেতে পারে। তবে মাংসের রং ও উৎপাদনকারী প্রাণীর প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে মাংস দুই প্রকার। যথা- রেড মিট ও হোয়াইট মিট। আসুন জেনে নিই রেড ও হোয়াইট মিট সম্পর্কে।
১. রেড মিট: সাধারণত গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, ঘোড়া ও শুকরের মাংসকে রেড মিট নামে অভিহিত করা হয়। আমরা যারা মুসলমান তারা অবশ্য শুকরের মাংস খাই না।
২. হোয়াইট মিট: মুরগি, হাঁস, টার্কি, খরগোশ প্রভৃতির মাংসকে হোয়াইট মাংস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
রেড ও হোয়াইট মিট সম্পর্কে কিছু কথা:
রেড মিটে হোয়াইট মিট অপেক্ষা বেশি মায়োগ্লোবিন থাকে। এই মায়োগ্লোবিন সংশ্লিষ্ট প্রাণীর দেহের কোষে কোষে অক্সিজেন সংবহন করে।
উল্লেখ্য যে, সকল প্রাণীর মাংশ পেশী বিভিন্ন কাজে বেশি ব্যবহৃত হয় কারণ তাদের শরীরে বেশি মায়োগ্লোবিন থাকে এবং মাংস লালচে হয়।
প্রকৃত পক্ষে মায়োগ্লোবিন হচ্ছে রঞ্জক সমৃদ্ধ আমিষ। এই মায়োগ্লোবিন কম থাকায় হোয়াইট মিট সাদা বর্ণের হয়ে থাকে।
রেড মিটে হোয়াইট মিট অপেক্ষা সম্পৃক্ত চর্বি বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকে যা মানুষের জন্য ক্ষতিকারক। সমপরিমাণ রেড মিট হতে হোয়াইট মিট অপেক্ষা তুলনামূলক বেশি পরিমাণে ক্যালরি পাওয়া যায়।
রেড মিটে এমন কিছু ভিটামিন ও খনিজ লবণ রয়েছে যা অন্য কোন খাবারে বেশি মাত্রায় পাওয়া যায় না। যেমন ভিটামিন বি১২ ও হিমি (আয়রন)।
রেড মিটে আছে শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আলফা লিপয়িক এসিড(ALA) যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
যে সকল গরু, ছাগল, ভেড়া প্রচুর ঘাস খায় এবং দানাদার খাদ্য গ্রহণ করে না বা খুব কম দানাদার খাদ্য খায়, তাদের থেকে প্রাপ্ত রেড মিটে তুলনামূলক কম পরিমাণ সম্পৃক্ত চর্বি বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে।
পক্ষান্তরে ঐ প্রাণীগুলোর মাংসে অত্যন্ত উপকারী ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন এ, ই ও বেটা ক্যারোটিন বেশি মাত্রায় থাকে।
দেখা গেছে, ১০০ গ্রাম বীফ বা গো মাংসে গড়ে ১৩৬ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে ১০০ গ্রাম হোয়াইট মিটে ১০৬ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়।
হোয়াইট মিটে পলি-স্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড থাকে। এছাড়া হোয়াইট মিটে রেড মিট অপেক্ষা ছয় গুণ বেশি ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড থাকে। এছাড়াও প্রচুর প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও পটাসিয়াম থাকে।
রেড মিট প্রাণীর দেহ “স্লো টুইচ” যুক্ত মাংশপেশী দিয়ে তৈরি যার অর্থ ঐ মাংশপেশীগুলো নিয়মিত কাজ করে যেমন- হাঁটা-চলায়, দৌড়াদৌড়ি সহ বিভিন্ন নিয়মিত কাজে ব্যবহৃত হয়।
পক্ষান্তরে হোয়াইট মিট প্রাণীর দেহ “ফাস্ট টুইচ” যুক্ত মাংশপেশী দিয়ে তৈরি যার অর্থ প্রাণীর ঐ মাংশপেশীগুলো স্বল্প মাত্রায় কাজ করে বা স্বল্প শক্তি ব্যয় করে কাজ করে।
মাংসের খাদ্য গুণ:
যে কোন খাদ্য গ্রহণের উদ্দেশ্য হল তার থেকে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগাড় করা। মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্য শুধু রসনা বিলাস নয়, পুষ্টিও আহরণ।
মাংসে এমন কিছু পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। মাংশে রয়েছে শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও ফ্যাট।
১০০ গ্রাম মাংশ থেকে আমরা ৪২১ মিগ্রা পটাসিয়াম, ৪ মিগ্রা জিংক, ১০-২০ মিগ্রা সেলিনিয়াম, ৭৩ মিগ্রা কোলেসটেরল, ৩.৫ গ্রাম চর্বি, ৫৭ মিগ্রা সোডিয়াম, ২৬ গ্রাম আমিষ, ফাইবার, আয়রন, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, আয়রন, ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি-৬ এবং ম্যাগনেসিয়াম পাই।
মাংস খাওয়ার উপকারিতা:
১. নিদ্রাহীনতা (ইনসমনিয়া) দূর করে: অনেক মানুষ রাত্রিতে নিদ্রাহীনতায় ভোগে। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চললে তাকে ইনসমনিয়া বলে। গবেষণায় দেখা গেছে, শরীরে উচ্চ মাত্রায় আয়রন বিদ্যমান থাকলে ভাল ঘুম হয়।
যেহেতু মাংস শরীরে প্রচুর আয়রন যোগায় তাই মাংস খাওয়া দরকার। মাংসে বিদ্যমান আয়রন রক্তচাপ ওঠানামার ভারসাম্য রক্ষা করে।
২. সমরন শক্তি বৃদ্ধি: মাংসে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড আছে যা মস্তিষ্কের মেমোরী সেলের মেমব্রেন তৈরিতে সহায়তা করে। এছাড়া স্নায়ুর সাড়া প্রদানের পথ তৈরিতেও ভূমিকা রাখে।
৩. রক্তের ঘনত্ব বজায় রাখে: মাংস খেলে তা শরীরে রক্ত চলাচল বা প্রবাহ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এর ফলে রক্তের ঘনত্ব সঠিক থাকে। এতে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় যা মনোযোগ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
৪. মাংশপেশীর গঠন ত্বরান্বিত করে: মাংসে বিদ্যমান আমিষ শরীরের পেশী গঠনে ভূমিকা পালন করে।
৫. হৃদরোগ হ্রাস: যদিও অনেকেই বলেন, মাংস শরীরে কোলেস্টেরলের বৃদ্ধি করে ও হৃদ রোগের সম্ভাবনা বাড়ায়, তবে পরিমিত মাত্রায় মাংস খেলে বরং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।
মাংসে বিদ্যমান ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড ধমনীর স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে যা রোগ প্রতিরোধ করে। এছাড়া মাংস খেলে ব্লাড পেইন ও অ্যারেথমিয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
৬. বয়স্কের ছাপ পড়া রোধ: মাংসে বিদ্যমান সেলেনিয়াম বুড়িয়ে যাওয়ার লক্ষণ দূর করে অর্থাৎ বয়স হলেও শরীরের সৌন্দর্য ও গঠন ঠিক থাকে।
৭. রিকেট রোগ প্রতিরোধ: ভিটামিন ডি এর অভাবে রিকেট রোগ হয় যা শিশুদের হাঁড় দুর্বল ও ভংগুর করে। মাংসে বিদ্যমান ভিটামিন ডি এই রিকেট প্রতিরোধ করে।
৮. অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ: শরীরে আয়রনের ঘাটতি থাকলে রক্তে লোহিত রক্ত কণিকা কমে যায় যা অ্যানিমিয়া সৃষ্টি করে।
অ্যানিমিয়া হলে শরীরে দুর্বলতা ও ক্লান্তি সৃষ্টি হয়। মাংসে বিদ্যমান আয়রন এ সমস্যা দূর করে। এছাড়া মাংসের আয়রন রক্তের হিমোগ্লোবিন গঠন করে যা শরীরে অক্সিজেন সংবহন করে।
৯. ডিপ্রেশন বা অবসাদ দূর করে: মাংসে বিদ্যমান ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড অবসাদ দূরীকরণে কাজ করে।
১০. ত্বক ও চুলের যত্ন: গবেষণায় দেখা গেছে, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড ত্বকের সৌন্দর্য রক্ষায় অতি প্রয়োজনীয়। মাংসে বিদ্যমান এই ফ্যাটি এসিড ত্বক, হাঁড়, চুল ও দাঁতের সমস্যা নিরসনে ভূমিকা রাখে।
১১. চোখের ছানি প্রতিরোধ করে: বয়স পঞ্চাশ বছরের বেশি হলে অনেক সময় চোখে ছানি পড়ে যার চিকিৎসা ঠিক মতো না হলে অনেক সময় দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে যায়। পরিমিত মাত্রায় মাংস খেলে তা চোখের ছানি পড়া প্রতিরোধ করে।
১২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শরীরে রোগ ব্যাধির ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এ কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরী।
মাংসে বিদ্যমান জিংক অ্যান্টিবড়ি সৃষ্টির মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়া এতে বিদ্যমান প্রোটিনও অ্যান্টিবডি তৈরিতে সহায়তা করে।
প্রতিদিন কতটুকু মাংস খাওয়া নিরাপদ:
মাংস শরীরে নানা রকম উপকার করে। আবার মাংসের কিছু অপকারিতাও রয়েছে। তাহলে কি মাংস খাওয়া ঠিক নয়? অবশ্যই ঠিক, তবে পরিমাণমতো খেতে হবে।
মাংস অবশ্যই খাওয়া যাবে তবে পরিমাণমতো ও ভাল গুণাগুণ সম্পন্ন মাংস খেতে হবে। সাধারণত সপ্তাহে এক বা দুবার রেড মিট খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত।
তবে চিকেন ও টার্কি কয়েক বার খাওয়া যেতে পারে। প্রতিদিন ৯০ গ্রামের বেশি রেড মিট বা প্রক্রিয়া জাত মাংস খাওয়া উচিত নয়।
এর বেশি খেলে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি হয়। বিশেষ করে প্রক্রিয়া জাত মাংস ৫০ গ্রামের বেশি খাওয়া উচিত নয়।
প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়ার ঝুঁকি:
লবণ দিয়ে কিংবা প্রিজারভেটিভ দিয়ে অথবা তাপে বা ধোঁয়া ব্যবহার করে দীর্ঘ দিন মাংস সংরক্ষণ করলে তাকে প্রক্রিয়া জাত মাংস বলে।
যেমন সসেজ, স্যাম, বেকন, সালামী, পেটে ইত্যাদি। প্রক্রিয়া জাত মাংসে উচ্চ মাত্রায় সম্পৃক্ত চর্বি ও লবণ থাকে।
তবে ভিটামিন ও খনিজ লবণ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পরিমাণে সেগুলো কম থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক গবেষণা মোতাবেক প্রক্রিয়া জাত মাংস খেলে বিভিন্ন ধরণের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।
মাংস রান্নার করার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়:
মাংস রান্নার পদ্ধতি স্বাস্থ্য ঝুঁকির ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। বেশি তাপমাত্রায় মাংস কড়াই বা তাওয়ায় ভাজলে বা ফ্রাই করলে অথবা কয়লা, কাঠ বা চুলার আগুনের শিখায় মাংস গ্রিল করলে রেড মিটে বিদ্যমান অ্যামাইনো এসিড, ক্রিয়েটিন ও সুগার পরিবর্তিত হয়ে হেটেরোসাই ক্লিক অ্যামিনস এ পরিণত হয় যা শরীরে জিনের মিউটেশন ঘটাতে ভূমিকা রাখে।
এছাড়া মাংস গ্রিল করার সময় মাংসের ফ্যাট ও জলীয় অংশ তাপের প্রভাবে মাংস থেকে বের হয়ে অগ্নি শিখায় পড়লে তা পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন তৈরি করে যা পুনরায় ঐ মাংসের সারফেসে ফিরে এসে জমা হয়।
উভয় যৌগই শরীরে ডি.এন.এ (DNA) এর গঠন পরিবর্তন করে যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। এক্ষেত্রে অল্প তাপে মাংস রান্না করলে এবং গ্রিল না খেলে ঝুঁকি এড়ানো যায়।
হোয়াইট মিট কি রেড মিট থেকে স্বাস্থ্যকর?
অনেকেই মনে করেন যে, হোয়াইট মিট রেড মিট অপেক্ষা স্বাস্থ্যকর। এ ধারণা মানুষের গড়ে উঠেছে নানা পর্যবেক্ষণ থেকে।
বিশেষ করে রেড মিট খাওয়ার সাথে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের সম্পর্ক থাকায় এ ধরণের চিন্তা-ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
তবে সাম্প্রতিক গবেষণা মোতাবেক হোয়াইট মিট খেলেও রেড মিটের মতোই ক্ষতিকর কোলেসটেরল তৈরি হয়।
অর্থাৎ রেড ও হোয়াইট উভয় ধরনের মাংসই কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে। দুই ধরনের মাংসই লোডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন তৈরি করে যা অত্যন্ত ক্ষতিকর।
মাংস খাওয়ার সমস্যা বা ক্ষতিকর দিক:
১. ডিহাইড্রেশন সৃষ্টি: কানেকটিকাট ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা মোতাবেক মাংসের মত উচ্চ আমিষ সমৃদ্ধ খাবার খেলে কিডনী অধিকতর ঘনত্ব বিশিষ্ট ইউরিন তৈরি করে যা শরীরে ডিহাইড্রেশন ঘটাতে পারে।
আর ডিহাইড্রেশনের কারণে শরীরের শক্তি হ্রাস পেতে পারে, মাংসপেশীতে ক্রাম্প দেখা দিতে পারে ও ত্বকের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
২. শরীরে দুর্গন্ধ সৃষ্টি: জার্নাল মেডিকেল সাইনসের এক গবেষণা মোতাবেক যারা মাংস খায় তাদের শরীরে যারা খায় না তাদের থেকে বেশী দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়।
৩. কোষ্ঠকাঠিন্য সৃষ্টি: শর্করা জাতীয় খাদ্য বাদ দিয়ে অতিরিক্ত মাংস খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য হয় কেননা মাংসে ফাইবার থাকে না।
৪. মাথা ব্যথা: অতিরিক্ত মাংস খেলে ডিহাইড্রেশন হয় যা মাথা ব্যথা ঘটায়। এছাড়া শর্করা জাতীয় খাবার হলো মস্তিষ্কের জ্বালানি। পর্যাপ্ত শর্করা জাতীয় খাবার না খেয়ে বেশি মাংস খেলে মাথা ব্যথা হয় ও মানসিক কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়।
৫. দৃষ্টি শক্তি হারানোর ঝুঁকি: অতিরিক্ত রেড মিট খেলে ম্যাকুলার ডিজেনারেশন ঘটে যা বয়স্কদের অন্ধত্বের অন্যতম কারণ।
ধারণা করা হয়, মাংসের সম্পৃক্ত চর্বি চোখের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রক্তনালীর জন্য ক্ষতিকারক। এছাড়া প্রক্রিয়াজাত মাংসে বিদ্যমান রাসায়নিক যৌগ নাইট্রোসোঅ্যামিন চোখের জন্য ক্ষতিকারক।
৬. হাড় দুর্বল করে: অতিরিক্ত মাংস খেলে শরীরে অতিরিক্ত আমিষ গৃহীত হয় যা মূত্রের মাধ্যমে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম বের করে দিতে পারে। এতে শরীরের হাড় দূর্বল হয়।
৭. ক্লান্তি আনে: অতিরিক্ত মাংস খাওয়ার পর তা হজম না হলে ক্লান্তি আসে। কেননা মাংস হজম করা কষ্টসাধ্য এবং হজমের জন্য পৌষ্টিকতন্ত্রকে বেশি কাজ করতে হয় যা ক্লান্তি আনে।
৮. শ্বাস প্রশ্বাসে দুর্গন্ধ সৃষ্টি: মাংসের মত অতিরিক্ত আমিষ ও চর্বি যুক্ত খাবার খেলে এবং যথাযথ পরিমাণ শর্করা না খেলে শরীরে কিটোন তৈরি হয়। ঐ কিটোন নিশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে বের হয়ে আসে যা এসিটোনের মত গন্ধ তৈরি করে।
৯. পৌষ্টিক নালী ঘটিত সমস্যা: আমাদের পৌষ্টিক নালীতে বিদ্যমান ব্যাকটেরিয়ার স্বাস্থ্য রক্ষায় ভূমিকা রয়েছে। মাংস বেশি খেলে পৌষ্টিক নালীতে উপকারী ব্যাকটেরিয়া বেশি তৈরি হতে পারে না। ফলে খাদ্য শোষনে ব্যাঘাত ঘটে।
১০. কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা হৃদরোগ সৃষ্টি: মাংস বিশেষ করে রেড মিটে বিদ্যমান ফ্যাট হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
রেড মিটে সম্পৃক্ত চর্বি ও কোলেসটেরল থাকে যা ধমনীর গাত্রে চর্বির প্লেক জমা করে। এ অবস্থাকে অ্যাথেরোসক্লোরেসিস বলে।
ধমনীতে প্লেক জমা হওয়ার কারণে রক্ত চলাচলের পথ খুব সরু হয়ে পড়ে। ফলে রক্ত প্রবাহ চালু রাখার জন্য হৃদপিন্ডকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয় যা হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।
১১. ওজন বৃদ্ধি: মাংস বিশেষ করে রেড মিটে বিদ্যমান চর্বি শরীরের ওজন বৃদ্ধি করে যা শরীরে রক্ত চাপ বাড়িয়ে দেয় ও কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।
১২. কর্কট রোগ বা ক্যান্সার সৃষ্টি: মাংস বিশেষ করে রেড মিট বিভিন্ন ভাবে শরীরে ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি করে। রেড মিটে বিদ্যমান আয়রন হিমোগ্লোবিনের হিমি নামক আমিষের মধ্যে থাকে।
মাংস খাওয়ার পর মানুষের খাদ্য নালীতে হিমির রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে যাতে কারসিনোজেনিক এন-নাইট্রোসো যৌগ তৈরি হয়।
এই যৌগ যা কলোরেকটাল ক্যান্সার সৃষ্টি করে। এছাড়া রেড মিটে বিদ্যমান ফ্যাট এসট্রোজেন ও প্রজেসটেরন সংশ্লিষ্ট ব্রেসট ক্যান্সার ঘটাতে অবদান রাখে।
এছাড়া রেড মিট উৎপাদনে মোটা তাজা করণ প্রক্রিয়ায় যে হরমোন ব্যবহৃত হয় তা এসট্রোজেনিক প্রক্রিয়ায় অবদান রাখে এবং ব্রেসট ক্যান্সার এর ঝুঁকি বাড়ায়।
১৩. ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি বাড়ায়: যত বেশি মাংস বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাত রেড মিট খাওয়া হবে তত টাইপ টু ডায়াবেটিস এর সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।
প্রক্রিয়াজাত মাংসে থাকে প্রিজারভেটিভ যেমন নাইট্রোসো অ্যামিন যা অগ্ন্যাশয়ের কোষের জন্য টক্সিক হিসেবে কাজ করে।
ফলে অগ্ন্যাশয়ের কোষে ইনসুলিন তৈরিতে সমস্যা সৃষ্টি হয় যার ফলে ডায়াবেটিস এর সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া মাংস রান্না বা প্রক্রিয়াজাত করার সময় রেড মিটের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে যা কোষ ও কলায় ইনসুলিনের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
পরিশেষে বলা যায়, মাংস বেশিরভাগ মানুষের পছন্দের খাবার। রসনার পরিতৃপ্তিতে মাংসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
মাংস যেমন বিপুল সংখ্যক মানুষ খায় তেমনই অনেক মানুষ এর উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রন্ধন প্রভৃতি দিক থেকে অর্থনৈতিক কাজে জড়িত। আমাদের উচিত পরিমিত পরিমাণে ভাল গুণাগুণ সম্পন্ন মাংসদ্রব্য গ্রহণ করা।
আরও পড়ুন: জিনসেং ঔষধটির গুণাগুণ জানলে অবাক হয়ে যাবেন।