ভেষজ গুণ সম্পর্কে আমরা সবাই সব কিছু জানি না। গ্রামে যারা একটু বয়স্ক মানুষ তারা বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে ভেষজ গুণসম্পন্ন বিভিন্ন গাছ-গাছালির ওষুধ ব্যবহার করে।
সত্যিকার অর্থে, ছোট ছোট বিষয়ে আমরা অনেক সময় অনেক টাকা খরচ করে ফেলি। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই এবং জানার চেষ্টা করলেই হয়তো সেই খরচটা বেঁচে যেতে পারে।
কারণ, ভেষজ গুণ সম্পন্ন গাছ-গাছালি আমাদের চারপাশে অনেক আছে। বন-জঙ্গলে একটু খুঁজলেই নানারকম গাছ-গাছালি পাওয়া যায়। যদিও বর্তমানে খুব একটা পাওয়া যায় না।
আজ আমরা বহেড়া, আদা এবং আমের ফুল যেটাকে আক বা আম্র বলা হয় সেগুলো নিয়ে আলোচনা করবো। তো আর কথা নয় – সরাসরি যাচ্ছি মূল আলোচনায়।
ভেষজ গুণ সম্পন্ন অক্ষ বা বহেড়া:
বহেড়া গাছগুলি ৬০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয় অর্থাৎ বেশ বড় গাছ। গাছের গুড়িও বেশ লম্বা হয়। শীত ঋতুতে এই ফলগুলো পুষ্ট হয়। তারপর আপনা থেকেই গাছ থেকে খসে পড়ে।
ছোট নাগপুর, বিহার, হিমাচল প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ এবং বাংলাদেশের কিছু জায়গায় এই গাছ দেখা যায়। এই গাছের ফল দুই রকম হয়। প্রথম প্রকার হয় গোল আর দ্বিতীয় প্রকার হয় ডিম্বাকৃতির। এর ফল ও ফলমজ্জা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
রোগের ব্যবহার:
১. শ্বেতী রোগ: বহেড়া বীজের শাঁসের তেল বের করে শ্বেতীর ওপর লাগালে গায়ের বর্ণ কিছুদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়।
২. আমাশয়: সাদা আমাশয় বা রক্ত আমাশয় বা যেকোন আমাশয়ে বহেড়া চূর্ণ প্রত্যহ সকালে জলসহ খেলে অনেক উপকার হয়।
৩. অকালে চুল পাকলে: বহেড়ার বীজ বাদ দিয়ে ছাল ১০ গ্রাম পরিমাণ নিয়ে জলসহ বেটে নিন। এক কাপ জলে গুলে জলটা ছেঁকে নিন, এবার সেই জলে চুল ধুয়ে ফেলুন।
৪. ফুলা কমানোর জন্য: বহেড়ার বীজ বাদ দিয়ে ছাল বেটে একটু গরম করে ফুলাতে প্রলেপ দিলে ফুলা কমে যায়। কয়েকদিন লাগালে ফুলা কমার সাথে সাথে ব্যথাও কমে যায়।
৫. অকালে টাক পড়লে: বহেড়া বীজের শাঁস সামান্য জলে মিহি করে বেটে টাকের জায়গায় চন্দনের মতো লাগালে টাক রোগ আরোগ্য হয়।
আর্দ্রক বা আদার গুনাগুণ:
কন্দ জাতীয় উদ্ভিদ হলো আদা। সব জায়গায় এর চাষ হয়। এই গাছ ২-৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এর পাতা লম্বায় ১২-১৩ ইঞ্চি পর্যন্ত হয় আর এক থেকে দেড় ইঞ্চি চওড়া হয়। আদার বোটানিক্যাল নাম হলো- Zingiber Officinale Rose.
সাধারনত আদার মূল অর্থাৎ কন্দই ব্যবহার করা হয়। আবার অনেক সময় আদাকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুকিয়ে নেওয়া হয় তখন একে বলে শুঁট বা শুঁঠা।
রোগের ব্যবহার:
১. অরুচিতে: অরুচি হলে আহারে রুচি ফিরিয়ে আনার জন্য সিকি কাপ জলে দুই চামচ আদার রস ও অল্প লবণ দিয়ে দশ থেকে পনের মিনিট মুখে দিয়ে রাখবেন। অরুচি তাহলে কেটে যাবে।
২. কোন জায়গা কেটে গেলে: যদি দেহের কোন স্থান কেটে গিয়ে রক্তপাত হতে থাকে এবং রক্ত বন্ধ না হয় তাহলে একটু শুঠ আদা গুড়ো করে সেই চূর্ণ কাটা জায়গায় টিপে দিলে রক্ত পড়া বন্ধ হবে।
৩. পুরাতন আমাশয়ে: যাঁদের খুব পুরাতন আমাশয় আছে তারা এক গ্রাম পরিমাণ শুঁঠের গুড়ো জলের সঙ্গে খাবেন। তার ফলে আম পরিপাক হবে।
৪. বসন্ত রোগ হলে: আজকাল আর প্রকৃত বসন্ত হয় না বললেই চলে। তবু জেনে রাখতে দোষ নেই। বসন্তের গুটিগুলো তাড়াতাড়ি বের করার জন্য এক চা চামচ আদার রস ও এক চামচ তুলসী পাতার রস এক সঙ্গে মিশিয়ে খাইয়ে দিন। এতে খুবই উপকার হবে।
৫. আমবাত হলে: এতে দেহে চাকা চাকা দাগ হয়, লাল হয়ে ফুলে ওঠে। এই অবস্থায় পুরানো গুড়ের সঙ্গে অল্প আদার রস মিশিয়ে খেতে দিলে আমবাত কমে যায়।
ভেষজ গুণ সম্পন্ন আম্র বা আক:
আমের ফুল অর্থাৎ আম্র মুকুলের সৌরভ বহুদূর থেকে পাওয়া যায়। এটি মধুর রসসম্পন্ন। সেই জন্য একেবারে ভ্রূণ অবস্থা থেকেই এর দিকে বিভিন্ন ধরণের মৌমাছি, মাছি, কীট-পতঙ্গ ও পাখিরা ছুটে আসে।
আমাদের কাছে আমের পাতা মঙ্গলচিহৃরূপে পরিচিত। সেই জন্য মঙ্গল ঘরে বাটি দেওয়া যায়। আমের আক এর বোটানিক্যাল নাম হলো- Magifera Indica.
আয়ুর্বেদ গ্রন্থগুলোতে বিভিন্ন সময়ে আম যে বিভিন্ন গুণসম্পন্ন সেই কথাই স্পষ্টই বলা আছে। যেমন- কচি আম রক্তপিত্তকর, মধ্য বয়সের আম পিত্তকর এবং পাকা আম বর্ণ, মাংস, শুক্র এবং শক্তি প্রদানকারক।
আমের সঙ্গে দুধ মিশিয়ে খেলে বল এবং তেজ দুটিই বাড়ে। কিন্তু বলবৃদ্ধি করে বলে আপনি যদি আপনার হজমশক্তির চেয়ে বেশি আম খান তাহলে কিন্তু উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হবে। মনে রাখতে হবে, রাত্রিবেলা শুধু আম কেন – কোন ফলই খাওয়া উচিত নয়।
আম এমনিতেই ঠান্ডা। তবে বর্তমানে কৃত্রিমভাবে অর্থাৎ কারবাইড দ্বারা সব রকম ফল পাকানো হয় বলে, ঠান্ডা কথাটা বলা চলে না। পাকা আম খেলে ফোঁড়া হয় কিন্তু আমরা বাজারে যে আম দেখি সেটা নামেই পাকা। আসলে কাচা আমকে এক প্রকার জোর করেই পাকানো হচ্ছে।
সেজন্য যাদের দেহ পিত্তবাহুল্য, তারা এই আম খেলে খুব স্বাভাবিক কারণেই ফোঁড়া হবে দেহে। কিন্তু প্রকৃত পাকা আম খেলে তা হয় না।
রোগের ব্যবহার:
১. বমি বমি ভাব হলে: প্রায়ই যাদের বমি-বমি ভাব দেখা যায় তারা তিন থেকে চারটি আমপাতা জলে সিদ্ধ করে সেই জলটুকু সারাদিনে একটু একটু করে খাবেন।
২. আমাশয় রোগে: কচি আমপাতা ও কচি জামপাতার রস এক সঙ্গে মিশিয়ে ২-৩ চা চামচ একটু গরম করে খান। আমাশয় আরোগ্য হবে।
৩. রক্ত আমাশয়ে: আমগাছের ছাল পরিষ্কার করে ধুয়ে রস বার করে সেই রস এক বা দুই চামচ আধাপোয়া ছাগলের দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে দিন। যদি ইচ্ছে করেন একটু চিনি বা মধু মিশিয়ে নেবেন।
৪. পা ফাঁটা রোগে: যাদের পায়ের গোড়ালি ফাটে বিশেষত শীতকালে, তারা ফাটা শুরু হলেই সেই ফাটায় আম গাছের আঠা দিন। আবার এর সঙ্গে যদি কিছু ধুনোর গুড়ো মিশিয়ে নেন তাহলে আরও ভালো হয়।
৫. অকালে চুল পাকা শুরু হলে: আমের কুশি ৫-৬ গ্রাম পরিমাণ নিয়ে থেতো করে ও ২-৩টি আমলকি একটু থেতো করে ১০-১২ চামচ জলে ভিজিয়ে লোহার পাত্রে ৫-৬ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখার পর ছেঁকে নিয়ে সেই জল চুলে লাগালে চুল পাকা কমে যাবে।
৬. মাথার চুল উঠতে থাকলে: আমের কুশি অর্থাৎ কচি আমের আঁঠির শাঁস একটু থেতো করে জলে ৫-৬ ঘন্টা ভিজিয়ে নিন। তারপর সেই জল শুকনো চুলের গোড়ায় ঘষে লাগালে চুল উঠা অনেক কমে যাবে। মাথায় কোন প্রকার তেল ব্যবহার করা যাবে না।
৭. প্লীহা বৃদ্ধি হলে: বায়ুপ্রধানজনিত প্লীহা রোগ আরোগ্য করতে হলে পাকা মিষ্টি আমের রস ৭-৮ চা চামচ নিয়ে তার সঙ্গে ২ অথবা ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে খেতে দিলে উপকার হবে।
আরও পড়ুন: হার্টের রোগ সারাতে হোমিওপ্যাথির সাফল্য।
পরিশেষে বলা যায়, ভেষজ গুণ সম্পন্ন গাছ-গাছালি দিয়ে একই সাথে একাধিক রোগের চিকিৎসা নেয়া সম্ভব। তাই ভেষজ গুণসম্পন্ন গাছ-গাছালি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অর্জন করা উচিত।
বাড়ির আঙিনায় বিভিন্ন ধরণের ওষুধি গাছ লাগানো উচিত। বাজারের অযাচিত যত্তোসব ওষুধ সেবনের ব্যাপারে সাবধান হোন। ভেষজ চিকিৎসায় কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তাই নিশ্চিন্তে আপনি ভেষজ চিকিৎসা নিতে পারেন।