ব্লাড প্রেসার বা রক্তচাপ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া কোনো ভালো লক্ষণ নয়। রোগীকে যদি এমন অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসা দেয়া সম্ভব না হয় তবে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ব্লাড প্রেসার কেন বাড়ে, এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা সকলের রাখা প্রয়োজন। আজ আমরা এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানবো।
ব্লাড প্রেসার নির্ভর করে মানুষের দৈনন্দিন কার্যক্রম, শরীরের পজিশন, মানসিক অবস্থা ইত্যাদির উপর। দিন-রাতের অবস্থাভেদেও রক্তচাপের পরিবর্তন হয়ে থাকে (গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকলে রক্তচাপ সাধারণত কম থাকে এবং সকালের দিকে রক্তচাপ বেশি থাকে)।
এক মিনিট ব্যবধানে রক্তচাপ মাপলে রক্তচাপের বিভিন্নতা দেখা যায়। বিশ্রাম বা ব্যায়াম, চা, কফি, সিগারেট ইত্যাদি বিভিন্ন নিয়ামক রক্তচাপের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।
কাজেই কোনো ব্যক্তির রক্ত চাপ সম্বন্ধে ধারণা পেতে হলে- বসা অবস্থায়, রিলাক্স মুডে, দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় (যেমন- বিকেলের) রক্তচাপ মাপতে হবে।
রক্তচাপ হলো শক্তি অর্থাৎ যে শক্তিতে ধমনির মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়। দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপের কারণে ধমনি শক্ত হয়ে যেতে পারে, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
তবে একবার রক্তচাপ বেশি দেখলেই হাই ব্লাড প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপের রোগী বলা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন কিছুদিন পর পর বেশ কয়েকবার রক্তচাপ মেপে দেখা এবং তারিখ ও সময়সহ তা লিখে রাখা।
আবার রক্তচাপ যদি অনেক বেড়েও যায়, তা আবার এক ধাক্কায় কমানো উচিত না। ধীরে ধীরে কমানো উচিত। অন্যথায় শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন মস্তিষ্ক, চোখ, হৃৎপিণ্ড, লিভার, কিডনি ইত্যাদি বিকল হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ক্ষণস্থায়ী রক্তচাপ বৃদ্ধি অনেক ক্ষেত্রেই পরে স্বাভাবিক হয়ে যায়। তারপরও এটিকে অবহেলা করা উচিত নয়।
আবার বেশ কিছু দিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরে বাড়তি রক্তচাপ থাকলে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। হার্ভার্ড হেলথ পাবলিকেশনের মতে, রক্তচাপের এই হঠাৎ বেড়ে যাওয়া বেশ কিছু কারণে হতে পারে। সেগুলো হলো:
১. ব্যথার ওষুধ (অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রুফেন জাতীয়), গর্ভ নিরোধক পিল, নেশাজাতীয় বস্তু যেমন- কোকেন, অ্যামফিটামিন ইত্যাদি গ্রহণ করা।
২. হরমোনজনিত কিছু রোগ।
৩. কিডনি রোগ যেক্ষেত্রে কিডনিতে রক্ত প্রবাহ কমে যায়।
৪. গর্ভাবস্থায় গর্ভজনিত জটিলতা।
৫. ব্লাড প্রেশারের রোগী যিনি ব্লাড প্রেশারের বড়ি অনিয়মিতভাবে গ্রহণ করে থাকেন।
৬. রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার একটি প্রধান কারণ অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করা। যদিও অতিরিক্ত লবণ গ্রহণে সবার রক্তচাপ বাড়ে না।
তারপরও খাদ্যাভ্যাস (ভাতের সঙ্গে পাতে অতিরিক্ত লবণ নেওয়া), ফাস্ট ফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য গ্রহণ- শরীরে অতিরিক্ত লবণ ঢুকে যাওয়ার অন্যতম কারণ। তা ছাড়া ভূরিভোজন নাড়ির গতি ও রক্তচাপ বাড়ায়।
৮. মানসিক চাপের কারণে শরীরে হরমোন তৈরি হয়। হৃৎপিণ্ড দ্রুত কাজ করে। রক্তনালি সংকুচিত হয়ে ব্যাসার্ধ কমে চিকন হয়ে যায়।
এভাবে রক্তচাপ বেড়ে যায়। আমেরিকান আয়াট্রোজেনিক অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ডাক্তারের কাছে গেলে ভয় ও মানসিক চাপে ২৫ ভাগ রোগীর রক্তচাপ এমনিতেই বেড়ে যায়। একে হোয়াইট কোট হাইপারটেনশন বলা হয়।
৯. ২০০৭ সালে প্রকাশিত আমেরিকান জার্নাল অব হাইপারটেনশনে বলা হয়, মাত্র একটি সিগারেট গ্রহণ রক্তনালির ওপর নিকোটিনিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য যথেষ্ট।
এতে রক্তনালি শক্ত হয়ে যায়। রক্তসংবহনতন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি হয়, নাড়ির স্পন্দন বেড়ে যায়, একই সঙ্গে রক্তচাপও বাড়ে।
উচ্চ রক্তচাপের উপসর্গ:
ক. রক্তচাপজনিত উপসর্গ:
১. মাথাব্যথা (সাধারণত মাথার পেছনের অংশে, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর নিয়মিত মাথাব্যথা, যা কয়েক ঘণ্টা পর ভালো হয়ে যায়);
২. মাথা ঝিমঝিম করা;
৩. অবসাদগ্রস্ততা;
৫. বুক ধড়ফড় করা;
৬. যৌন দুর্বলতা;
খ. রক্তচাপজনিত রক্তনালির রোগ:
১. নাক দিয়ে রক্ত পড়া;
২. চোখে ঝাপসা দেখা;
৩. বুকে ব্যথা;
৪. শ্বাসকষ্ট (হৃদযন্ত্র বিকল হলে);
গ. অন্যান্য রোগজনিত রক্তচাপ বৃদ্ধি:
১. কিডনি রোগ;
২. মাংসপেশির দুর্বলতা;
৩. অনিয়মিত ঘুম, নাকডাকা, দিনের বেলায় নিদ্রালুতা;
৪. বুক ধড়ফড় করা এবং হঠাৎ ঘাম;
৫. থাইরয়েডের সমস্যা;
৬. নিষিদ্ধ ওষুধ গ্রহণ;
রক্তচাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রোগ:
ঘন ঘন প্রস্রাবে ইনফেকশন বা ক্রনিক পায়েলোনেফ্রাইটিস:
রাতের বেলা ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া এবং অধিক পিপাসা বোধ হওয়া- মূত্রতন্ত্রের রোগ বা অনালগ্রন্থিতন্ত্র (এন্ডোক্রাইন) রোগ নির্দেশ করে।
হঠাৎ মাথাব্যথা, বুক ধড়ফড় করা এবং শোয়া বা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে মাথা ঝিমঝিম করা- ফিওক্রোমোসাইটোমা।
মানসিক দুর্বলতা, দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ উচ্চ মাত্রায় গ্রহণ করা (অ্যাজমার শ্বাসকষ্টে অ্যালার্জিতে এটি ব্যবহৃত হয়)।
অন্যান্য রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি, কায়িক পরিশ্রমের অভাব রক্তচাপ বাড়ানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে গেলে যা করতে হবে:
১. হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে গেলে ডাক্তারের পরামর্শে ঘুমের ওষুধ সেবন করা।
২. ওজন কমানো। বডি ম্যাস ইনডেক্স বা বিএমআই ২৫-এর নিচে রাখা।
৩. লবণ কম খাওয়া।
৪. মদ্যপান বা নেশাদ্রব্য গ্রহণ না করা।
৫. প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট জোরে জোরে হাঁটা।
৬. চর্বিজাতীয় খাবার কম খাওয়া।
৭. প্রচুর ফল ও শাকসবজি খাওয়া।
৮. মাছ বেশি খাওয়া।
৯. ধূমপান পরিত্যাগ করা।
১০. ডায়াবেটিস, হাইপারলিপিডেমিয়া (রক্তে অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়া) নিয়ন্ত্রণে রাখা।
১১. ঘন ঘন রক্তচাপ পরিমাপ না করা।
১২. হাসিখুশি ও প্রফুল্ল থাকা। বন্ধু-পরিজনসহ সুখী জীবন-যাপনের চেষ্টা করা।
১৩. মানসিক অবসাদগ্রস্ততা দূর করা।
১৪. উচ্চমাত্রার ওষুধ গ্রহণ করে হঠাৎ রক্তচাপের অতিরিক্ত না কমিয়ে ফেলা।
১৫. যথেষ্ট বিশ্রাম নেওয়া।
পরিশেষে বলা যায়, ব্লাড প্রেসার পরিমাণ মতো থাকা একান্ত চাওয়া সবার। কিন্তু বিভিন্ন কারণে কম-বেশি হয়ে যায়। তাই ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে সর্বদা সজাগ থাকা উচিত এবং কোনো পরিবর্তন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।
আরও পড়ুন: টনিক, ভিটামিন, শক্তিবর্ধক ও বল বর্ধক হোমিওপ্যাথি ঔষধ।