ব্রণ:
ব্রণ একটি সাধারণ সমস্যা। এটি সাধারণত যৌবনকালের একটি অবাঞ্চিত সমস্যা। কারণ, কেউ চায় না তার ব্রণ হোক। ব্রণ হলে মুখের সৌন্দর্য নষ্ট হয়।
ব্রণ হলে মনে স্বস্তি থাকে না। অনেকেই নানারকম ক্রীম ত্বকে ব্যবহার করেন। ব্রণ উঠলেই নানারকম ক্রীম ব্যবহার করা উচিত নয়। নচেৎ মুখের সৌন্দর্য বিনষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে।
ব্রণ কোন বয়সে বেশি হয়?
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, ব্রণ সাধারণত ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সে বেশি হয়। যাদের বয়স ২০ থেকে ৩০ এর মধ্যে তাদেরও ব্রণ হতে পারে। যারা ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সী তাদের ৯০ শতাংশেরই ব্রণের অভিজ্ঞতা হয়।
তবে ২০ বছর পার হয়ে গেলে মুখে ব্রণের প্রবণতা কমতে থাকে। ব্রণ একটি স্বাভাবিক সমস্যা। বয়সের সাথে এর সম্পর্ক আছে। ত্বকে এটি দেখা গেলেই হুটহাট করে কিছু করা উচিত নয়।
ব্রণ কোথায় হয়?
খুব সহজ একটি প্রশ্ন। ব্রণ সাধারণত মুখে যেমন গাল, নাক, কপাল কিংবা থুতনীতে হতে দেখা যায়। তবে শরীরের অন্যান্য অংশেও হতে পারে।
তবে সাধারণত শরীরের উপরের অংশেই এটি হয়। হাতের উপরের অংশেও ব্রণ সচরাচর হতে দেখা যায়।
ব্রণ হওয়ার কারণসমুহ:
বংশগত কারণ অনেকটা প্রভাব ফেলে। বংশে কারও ব্রণ হওয়ার ইতিহাস থাকলে তাহলে হতে পারে। আর বৈজ্ঞানিক কারণ অনুযায়ী, লোমের গোড়ায় ’প্রোপাওনি ব্যাকটেরিয়াম একনি’ নামক ব্যাকটেরিয়া থাকে।
অপরদিকে, বয়ঃসন্ধিকালে সেবাসিয়াস গ্রন্থি থেকে সেবামের নিঃসরণ অনেকটা বেড়ে যায় যার প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এড্রোজেন হরমোন।
এরপর সেবাম থেকে ঐ ব্যাকটেরিয়াগুলো ফ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরী করে। ফলশ্রুতিতে লোমের গোড়ায় প্রদাহের সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। এখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে তৈরী হওয়া ফ্যাটি অ্যাসিড।
ঠিক এই সময় লোমের গোড়ায় কেরোটিন নামক পদার্থ জমা হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে লোমের গোড়ার সেবাসিয়াস গ্রন্থিপথ বন্ধ হয়ে যায়। গ্রন্ধিপথগুলো কেরাটিন, লিপিড আর মেলানিন নামক পদার্থ দিয়ে বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তীতে এগুলো ব্লাক হেড বা হোয়াইট হেড হিসেবে দেখা দেয়। তখন এই ব্লাক হেড বা হোয়াইট হেডকে-ই আমরা ব্রণ হিসেবে অভিহিত করি।
ব্রণের সাথে খাদ্যের সম্পর্ক আছে কি?
অনেকেই মনে করে, ব্রণের সাথে খাবারের অনেকটা সম্পর্ক আছে। আবার অনেকেই বলে তৈলাক্ত খাবার খেলে নাকি ব্রণ বেশি হয়। প্রকৃত অর্থে কথাটি সঠিক নয়।
বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেনি যে, ব্রণের সাথে কোনো প্রকার খাদ্যের সম্পর্ক আছে। তবে খাদ্য অনেক সময় সামান্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে।
ব্রণ হলে ক্রিমের ব্যবহার:
বাজারে বিভিন্ন প্রকার ক্রিম পাওয়া যায়। সব ক্রিম উপকারী নয়। যাদের মুখে খুব বেশি ব্রণ হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ঐসব ক্রিম ব্যবহার করা যাবে না যেসব ক্রিমে তৈলাক্ত উপাদানের উপস্থিতি রয়েছে।
তাছাড়া, অন্যান্য ক্রিম ব্যবহার করা যাবে। তবে ক্রিম ব্যবহারে সাবধান হতে হবে। কেননা, এলোমেলোভাবে বিভিন্ন প্রকার ক্রিম ব্যবহার করলে ব্রণ বেড়ে যেতে পারে। এতে মুখের সৌন্দর্য বিনষ্ট হতে পারে।
চিকিৎসা:
চিকিৎসকগণ ব্রণের ধরণ ও আক্রান্তের হার দেখে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করে থাকেন। সাধারণত শুরুতে মলম দিয়ে চিকিৎসা শুরু হতে পারে।
মুখে খাওয়ার জন্য অনেক সময় বিভিন্ন প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিকের সাথে সাথে রেটিনয়েড জাতীয় ওষুধও ব্যবহার করা হয়।
আরও পড়ুন: যৌন রোগ কেন হয়? ভয়াবহ কয়েকটি যৌন রোগ ও সেগুলোর চিকিৎসা জানুন।
বর্তমানে ব্রণের চিকিৎসায় অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। কমিডন ধরণের ব্রণ হলে ভ্যাকুয়াম ক্লিনজিং এবং আল্ট্রাসনিক ফেসিয়ালের মাধ্যমে মুখের ভেতর থেকে ব্ল্যাক হেডস কিংবা হোয়াইট হেডস বের করে আনা যায়।
সংক্রমিত বা পস্টিউলার ব্রণ হলে অ্যান্টিবায়োটিক কেমিক্যাল পিলিং এজেন্ট ত্বকের ধরণ অনুসারে ব্যবহার করা হয়।
ব্যাকটেরিয়ানাশক ব্যবহার: ১৮৫১ সাল থেকেই ব্রণের চিকিৎসায় টেট্রাসাইক্লিন (অ্যান্টিবায়োটিক) এর ব্যবহার হয়ে আসছে। এই ওষুধটি দামে বেশ সস্তা। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তেমন একটা নেই বললেই চলে।
ব্রণের জন্য এই ওষুধের কার্যকারিতা খুব বেশি। ব্রণ হওয়ার জন্য যেসব ব্যাকটেরিয়া দায়ী সেসবকে ধ্বংস করে দেয় এই অ্যান্টিবায়োটিক।
এই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে পরিপূর্ণ সফলতা পেতে গেলে কয়েক মাস ধরে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে অনেকেই ধের্য্য হারিয়ে ফেলে।
টেট্রাসাইক্লিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া শুরু করলে এক থেকে দেড় মাস সময় পর প্রাথমিক ফলাফল আসা শুরু করে। খুব দ্রুত কোনো ফলাফল আসে না।
টেট্রাসাইক্লিন জাতীয় ওষুধ এর পাশাপাশি বর্তমানে মিনোসাইক্লিন জাতীয় ওষুধও ব্যবহার করা হয়। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, টেট্রাসাইক্লিন এর তুলনায় মিনোসাইক্লিন অধিক কার্যকর।
ডক্সিসাইক্লিন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার: ব্রণের চিকিৎসায় এ জাতীয় ওষুধও অনেক ব্যবহার করা হয়। এরিথ্রোমাইসিন এর পাশাপাশি যদি ডক্সিসাইক্লিন খাওয়া যায় তবে দ্রুত ব্রণ সেরে যায়।
এরিথ্রোমাইসিন বা ক্লিনডামাইসিন এর ব্যবহার: যারা টেট্রাসাইক্লিন খেতে পারেনা (বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলারা) তাদের জন্য রয়েছে এরিথ্রোমাইসিন। বর্তমানে ক্লিনডামাইসিনেরও ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
হরমোনাল থেরাপি: মহিলাদের ওভারি থেকে যদি এন্ডোজেন হরমোন বেশি পরিমাণে তৈরী হয় তবে সেবামের নিঃসরণ বেড়ে যায়।
ঐ সময় তুলনামূলক কম শক্তিমাত্রার/ডোজের জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়া যাবে। অবশ্য নন-এন্ডোজেন প্রজেস্টিন থাকতে হবে।
এ হরমোনাল চিকিৎসা পদ্ধতি ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনোভাবেই নিতে যাবেন না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
আইসোট্রিসনিন এর ব্যবহার: এ রোগের চিকিৎসায় ভিটামিন ‘এ’ এর ব্যবহার বহুল প্রচলিত একটি পদ্ধতি। আর এটা সম্ভব হয়েছে আইসোট্রিসনিন এর আবিষ্কারের ফলে।
যেকোন ধরণের ব্রণ চিকিৎসায় এটি সফলতার দাবিদার। এর দাম খুব বেশি। তাই সব ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার করা সম্ভব হয় না।
মহিলাদের ক্ষেত্রে এই ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। পেটের বাচ্চার ওপর এই ওষুধ মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এই জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা একদম নিষেধ।
অপারেশন পদ্ধতি: সাধারণত অপারেশন করার মাধ্যমে কালো দাগ, পাকা ব্রণ এবং সিস্ট জাতীয় ব্রণ দূর করা সম্ভব। জানলে অবাক হবেন, স্কালপেল দুই নম্বর ব্লেডের সাহায্যে এই জাতীয় অপারেশন করা হয়।
ফোটন থেরাপি: ক্লিনিক্যাল স্টাডি করে দেখা গেছে যে, ফোটন থেরাপি বা আলোর সাহায্যে ব্রণ চিকিৎসা শতভাগ কার্যকরী।
আমেরিকান ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফ,ডি,এ) সম্প্রতি এ মেডিক্যাল যন্ত্রটিকে নিরাপদ ও শতভাগ কার্যকর হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে।
ক্লিনিক্যাল স্টাডিতে দেখা গেছে যে, যেকোন ব্রণ খুব সহজেই এই প্রক্রিয়ায় দূর করা সম্ভব। তবে এই চিকিৎসা পদ্ধতি কিছুটা ব্যয়বহুল।
ফোটন থেরাপি যেভাবে কাজ করে: আলোর দুটি তরঙ্গ দৈর্ঘ্য এক্ষেত্রে কাজ করে। একটি ৪১৫ ন্যানোমিটারের নীল বেগুনি আলোতে এবং অপরটি ৬৬০ ন্যানোমিটারের লাল আলোতে কাজ করে।
প্রথমটি সাধারণত প্রদাহযুক্ত ব্রণে বা ’প্রোপিওনিব্যাকটেরিয়াম একনি’ নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রোধ করে।
ফোটন থেরাপি কেন সেরা: ওষুধ বা ক্রিম যতোটা কাজ করে সেই তুলনায় ফোটন থেরাপি প্রায় ৩ গুণ দ্রুত ও কার্যকরভাবে কাজ করে।
ফোটন থেরাপির সাথে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড যোগ করেও চিকিৎসা করা যায়। চার সপ্তাহে সাধারণত আটটি থেরাপি নিতে হয়।
ফোটন থেরাপি চলাকালীন রোগীর কোনো ব্যথা হয় না। রোগীকে হাসপাতালে থাকতে হয় না। কোনো ধরণের অপারেশন কিংবা কাটা-ছেড়া করতে হয় না।
ফোটন থেরাপি কোন সময় করা যাবে না:
আলোর সংস্পর্শে এলে ত্বকে কোনো প্রকার রেশ বা প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হলে ফোটন থেরাপি ব্যবহার করা যাবে না।
ত্বকের মধ্যে একজিমা জাতীয় চর্মরোগ থাকলে যখন তা আলো সংবেদনশীল হয় সেই সময় ব্যবহার করা যাবে না।
শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনীর কোনো বড় ধরণের সমস্যা থাকলে।
আরও পড়ুন: লিভার ভালো রাখতে যে কাজগুলো করতে হবে তা জেনে নিন।
ত্বকে কোনো প্রকার ক্যান্সার থাকলে এ ধরণের থেরাপি ব্যবহার নিষিদ্ধ। কারও শরীরে যদি ইমিউন সিস্টেমজনিত রোগ (এসএলই) থাকে।
পরিশেষে বলতে চাই, ব্রণ একটি স্বাভাবিক সমস্যা। এটি আপনার শরীরে কোনো প্রকার ক্ষতি করে না। শুধুমাত্র বাইরের দিক থেকে বিশ্রী দেখা যায়।
উপরে বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আপনার যদি ব্রণের সমস্যা থেকে থাকে তবে অবশ্যই আপনি সঠিক চিকিৎসা নিন।
আজেবাজে ক্রীম ব্যবহার করে ত্বকের ক্ষতি করতে যাবেন না। আর ধৈর্য্যশীল হতে পারলে ব্রণ আসলে একটা সময় এমনিতেই সেরে যায়।