ঋতু ভেদে বসন্ত শেষে এবার গ্রীষ্মের প্রখর তাপের পালা। আর এই প্রখর তাপে সবচেয়ে ক্ষতি হয় ত্বকেরই। কারণ, ত্বকের উজ্জ্বল এবং সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয় ব্রণ।
আমাদের ত্বকের তৈল গ্রন্থি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হলে এর আকৃতি বৃদ্ধি পায়। তখন এর ভিতরে পুঁজ জমা হতে থাকে যা ধীরে ধীরে ব্রণের আকার ধারণ করে।
সাধারণত টিনেজার মেয়েরাই ব্রণের সমস্যায় বেশি পড়ে থাকে। কিন্তু আজকাল তরুণ-তরুণী এবং মধ্যবয়সী নারীরাও এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
স্থায়ীভাবে ব্রণ এবং ব্রণের দাগ দূর করতে কিছু উপায় অবলম্বন করা প্রয়োজন। বাজারের দামি কসমেটিক্স এর পরিবর্তে ব্যবহার করতে পারেন কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি যা সহজেই আপনার মুখ থেকে ব্রণ কমাতে সাহা্য্য করবে।
আর ঘরোয়া সামগ্রীই সবচেয়ে ভালো এবং নিরাপদ। এতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও থাকেনা। ব্রণ এবং ব্রণের দাগ দূর করতে যদিও সময় একটু বেশি লাগে, কিন্তু নিয়মিত চেষ্টায় এবং কিছু প্রাকৃতিক উপাদানের সাহায্যে এই দাগ ধীরে ধীরে দূর করা সম্ভব।
এই উপাদানগুলো প্রাকৃতিক ব্লিচিং হিসেবেও কাজ করবে এবং আপনার ত্বক থেকে স্থায়ীভাবে দাগ দূর করতে সাহায্য করবে। এটা ঠিক প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই ভালো এমন ব্যবস্থা। তো আর কথা নয় – সরাসরি যাচ্ছি মূল আলোচনায়।
ব্রণ দূর করার কিছু সহজ উপায়:
১. গ্রীষ্মকালে যাদের তৈলাক্ত ত্বক থাকে তাদের ব্রণের সমস্যা বেশি হয়। তৈলাক্ত ত্বকের ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে মুখে মুলতানি মাটি পানি দিয়ে পেস্ট করে লাগাতে হবে। মুলতানি মাটি ত্বকের অতিরিক্ত তেল শোষণ করে নেয় আর এর ফলে ব্রন উঠা কমে যায়।
২. শশার রস তৈলাক্ততা দূর করতে খুবই উপকারি। প্রতিদিন বাইরে থেকে এসে শশার রস দিয়ে মুখ পরিষ্কার করলে তৈলাক্ত ভাব একদম কমে যায়।
৩. আবার শসাকে স্ক্রাব হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলে শসার সাথে চালের গুঁড়া মিশিয়ে নিতে হবে। যাদের মধুতে অ্যালার্জি নেই, তারা এই মিশ্রণে সামান্য মধুও মিশিয়ে নিতে পারেন।
সপ্তাহে দুই দিন এই প্যাক ব্যবহার করলে ত্বক পরিষ্কার হবে। ব্ল্যাকহেডস ও হোয়াইট হেডস দূর হয়ে যাবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, ব্রণ থাকলে স্ক্রাব করা যাবে না।
৪. কাঁচা হলুদ এবং চন্দনকাঠের গুঁড়ো ব্রণের জন্য খুবই উপকারি দুটো উপাদান। একই পরিমাণ কাঁচা হলুদ বাঁটা এবং চন্দন কাঠের গুঁড়ো একত্রে নিয়ে এতে পরিমাণ মত পানি মিশিয়ে পেষ্ট তৈরি করে নিতে হবে।
এবার মিশ্রণটি ব্রণের জায়গায় লাগিয়ে রাখতে হবে কিছুক্ষণ। তারপর শুকিয়ে গেলে মুখ ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এই মিশ্রণটি শুধুমাত্র ব্রণ দূর করার কাজ করে না বরং ব্রণের দাগ দূর করতেও সাহায্য করে।
৫. আপেল এবং মধুর পেষ্ট ব্রণের দাগ দূর করার সবচেয়ে জনপ্রিয় ঘরোয়া উপায়। প্রথমে আপেলের পেষ্ট তৈরি করে তাতে ৪-৬ ফোঁটা মধু মিশাতে হবে। মিশ্রণটি মুখে লাগিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এরপর মুখ ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
এটি ত্বকের টানটান ভাব দূর করে। সপ্তাহে ৫-৬ বার এটি ব্যবহার করবেন। কয়েকদিনের মধ্যে পরিবর্তনটা অনুভব করতে পারবেন।
৬. ব্রণের সমাধানের জন্য তুলসি পাতার রস খুব উপকারী। কারণ তুলসি পাতায় রয়েছে আয়ূরবেদিক গুণ। শুধুমাত্র তুলসি পাতার রস ব্রনের স্থানে লাগিয়ে রেখে, শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এরপর কুসুম গরম পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে।
৭. প্রথমে চন্দন কাঠের গুড়োঁর সাথে গোলাপ জল মিশিয়ে পেষ্ট তৈরি করতে হবে। এরপর এতে ২-৩ ফোঁটা লেবুর রস মিশাতে হবে। গোলাপজল অনেকের ত্বকের সাথে এডজাষ্ট হয় না।
তাই সেই ক্ষেত্রে গোলাপ জলের পরিবর্তে মধু ব্যবহার করতে পারেন। এই মিশ্রণ আপনার ব্রণের দাগ দূর করতে সাহায্য করবে। সপ্তাহে ৩-৪দিন ব্যবহার করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
৮. গোলাপজলের নিয়মিত ব্যবহারে ব্রণের দাগ কমে যায়। দারুচিনি গুঁড়ার সাথে গোলাপজল মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। এই পেস্ট ব্রণের ওপর লাগিয়ে ২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। এতে ব্রণের সংক্রমণ, চুলকানি এবং ব্যথা অনেকটাই কমে যাবে।
৯. এছাড়া রাতে শোয়ার আগে ডিমের সাদা অংশ ব্রনের স্থানে ম্যাসেজ করে সারারাত রাখতে হবে। এটি আপনার ত্বকের খসখসে ভাব দূর করবে।
সবচেয়ে ভালো হয় যদি এর সাথে লেবুর রস যোগ করা যায়। লেবুর রস দিলে এটি আধ ঘন্টা পর ধুয়ে ফেলবেন।
১০. কমলা লেবুর খোসা শুকিয়ে মিক্সিতে গুঁড়ো করে নিতে হবে। এবার মসুরির ডাল আর চাল ভিজিয়ে ভালো করে পিষে নিতে হবে।
ঐ পেস্টের মধ্যে চন্দন পাউডার, মুলতানি মাটি, কমলালেবুর খোসার গুঁড়ো মিশিয়ে ভালো করে মিলিয়ে নিন। চাইলে এই মিশ্রণের মধ্যে দুই চামচ দুধও মিশিয়ে নিতে পারেন।
এবার মুখে লাগিয়ে কিছুক্ষণ রাখার পর ধুয়ে ফেলতে হবে। এই প্যাকটা নিয়মিত মুখে লাগাতে হবে। ত্বকের উজ্জ্বলভাব বাড়বে। ব্রণের দাগও দূর হয়ে যাবে।
১১. ব্রণ হবার একটি অন্যতম কারণ হলো অপরিষ্কার ত্বক। তাই ত্বক রাখতে হবে পরিষ্কার। নিয়মিত স্ক্রাবিং ত্বককে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে।
এক কাপ পাকা পেঁপে চটকে নিন। এবার এর সাথে মেশাতে হবে এক টেবিল চামচ পাতিলেবুর রস এবং প্রয়োজন অনুযায়ী চালের গুঁড়ো।
মিশ্রণটি মুখসহ পুরো শরীরে লাগিয়ে ২০-২৫ মিনিট ম্যাসাজ করে গোসল করতে হবে। পেঁপে ছাড়াও ব্যবহার করতে পারেন ঘৃতকুমারীর রস।
১২. চার-পাঁচটা নিম পাতা ভালো করে ধুয়ে পিষে নিতে হবে। এর মধ্যে এক চামচ মুলতানি মাটি, অল্প গোলাপ জল মিশিয়ে প্যাক তৈরি করতে হবে।
প্যাকটা যদি গাঢ় হয়ে যায় তাহলে এর মধ্যে গোলাপ জল মিশিয়ে নিলে ভাল হবে। মুখে লাগিয়ে বেশ কিছুক্ষণ রেখে দিন। প্যাকটা মুখে শুকিয়ে গেলে হালকা পানি দিয়ে মুখটা ধুয়ে ফেলতে হবে।
১৩. অতিরিক্ত গরমের কারণে ত্বকে যেসব ফুসকুড়ি এবং ব্রণ হয় সেগুলো দূর করতেও পুদিনা পাতা উপকারী। টাটকা পুদিনা পাতা বেটে ব্রণের ওপর লাগিয়ে রেখে ২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলতে হবে।
আসুন এবার জেনে নিই ব্রণের দাগ দূর করার প্রাকৃতিক উপায়:
১. লেবু
(ক) লেবু একটি প্রাকৃতিক ব্লিচ। লেবুর রসের সাথে সামান্য পানি মিশিয়ে একটি তুলার বলের সাহায্যে তা মুখে ৩-৪ মিনিট ঘষতে হবে।
(খ) যদি সেনসিটিভ স্কিন হয় তাহলে এর সাথে গোলাপ জল মিশিয়ে নিতে হবে। সম্ভব হলে ১ চামচ লেবুর রসের সাথে ২ চামচ ই ক্যাপসুল মিশিয়ে ত্বকে লাগাতে হবে।
ভিটামিন ই ক্যাপসুল ত্বকের জন্য খুবই উপকারী। এছাড়া আপনি চাইলে একটানা ৭-১০ দিন নিচের ফেস প্যাক ব্যবহার করতে পারেন।
লেবুর ফেসপ্যাক:
১ টেবিল চামচ লেবুর রস, ১ টেবিল চামচ মধু, ১ টেবিল চামচ আমন্ড তেল, ২ টেবিল চামচ দুধ একসাথে মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে। শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলতে হবে। ব্রণ থাকা অবস্থায় দুধ ব্যবহার থেকে বিরত থাকবেন।
২. মধু
(ক) রাতে ঘুমানোর আগে মুখ ভালো করে ধুয়ে মধু লাগাতে হবে। সারারাত মধু রেখে সকালে ঘুম থেকে উঠে ধুয়ে ফেলতে হবে।
(খ) মধুর সাথে দারুচিনি গুঁড়া মিশিয়ে শুধুমাত্র দাগের উপর লাগিয়ে ১ ঘণ্টা পর ধুয়ে ফেলতে হবে। চাইলে সারারাতও রাখা যাবে।
মধুর ফেসপ্যাক:
২-৩ টি অ্যাস্পিরিন ট্যাবলেট এর সাথে ২ চামচ মধু ও ২-৩ ফোঁটা পানি মিশিয়ে ফেসপ্যাক তৈরি করে ব্রনের দাগের উপর দিতে হবে। অ্যাস্পিরিন এর স্যালিসাইলিক এসিড ব্রণের দাগ দূর করতে খুবই উপকারি।
৩. অ্যালোভেরা জেল
দিনে দুইবার অ্যালোভেরা জেল মুখে লাগিয়ে ৩০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলতে হবে। এটি শুধুমাত্র ব্রণের দাগই দূর করবে না, বরং আপনার ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করবে এবং টানটান ভাব চলে যাবে।
৪. বেকিং সোডা
২ টেবিল চামচ বেকিং সোডা ও সামান্য পানি একসাথে মিশিয়ে মুখে ২-৩ মিনিট ঘষতে হবে এবং শুকানোর জন্য কয়েক মিনিট অপেক্ষা করুন। এরপর মুখ ধুয়ে এর উপর কোনও ময়েশ্চারাইজার ক্রিম বা অলিভ অয়েল লাগাতে হবে।
৫. টমেটো
একটি লাল টমেটোর কিছু অংশ নিয়ে তার রস, শশার রসের সাথে মিশিয়ে নিতে হবে। এই মিশ্রণটি মুখে লাগিয়ে ১০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলতে হবে।
সপ্তাহে ৩ বার এই প্যাকটি লাগালে ব্রণের দাগ দূর তো হবেই সেই সাথে রোদে পোড়া দাগ দূর হয়ে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পাবে।
উপরের সবগুলো উপাদান ত্বকের দাগ দূর করতে অনেক উপকারী। আপনার ত্বকের ধরন অনুযায়ী যে উপাদান বেশি ভালো তা ব্যবহার করা শুরু করতে পারেন এবং আপনার মূল্যবান ত্বকের যত্ন নিতে পারেন বেশি করে।
ব্রণ থেকে চিরতরে মুক্তির কিছু টিপস:
১. প্রতিদিন ৯-১০ গ্লাস পানি পান করবেন।
২. প্রতিদিন রাতের খাবারের পর যেকোনও ধরনের মৌসুমি ফল খেতে চেষ্টা করবেন। এটি আপনার ত্বককে সতেজ রাখবে। যতটা সম্ভব তেলযুক্ত বা ফাষ্ট ফুড জাতীয় খাবার পরিহার করবেন।
৩. সব সময় বাইরে থেকে আসামাত্র মুখ ফেসওয়াস দিয়ে ধুয়ে ফেলবেন। এছাড়া হালকা গরম পানির স্টীম নিতে পারেন। এতেকরে ত্বকে জমে থাকা ধূলোবালি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
৪. আমাদের মধ্যে অনেকেরই নখ দিয়ে ব্রণ খোটার বাজে অভ্যাস রয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে এটা কোন সমাধান না।
উল্টো এতে ব্রণের অবস্থা আরও খারাপ হবে। এর ফলে ব্রণ লাল হয়ে যাবে। এমনকি তা ফেটে গিয়ে মুখে দাগের সৃষ্টি করবে।
ব্রণ না যাওয়া পর্যন্ত মেক-আপ ব্যবহার না করাই উচিত। দিনে অন্তত দুই বার তেল-মুক্ত ক্লিনজার দিয়ে মুখ ধুয়ে নিতে হবে।
৫. সূর্যের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে কারণ, সূর্যের আলোতে ব্রণের দাগ বসে যায়। তাই চেষ্টা করবেন সূর্যের সংস্পর্শ থেকে নিজেকে দূরে রাখার। কিন্তু বাইরে না গিয়ে তো উপায় নেই।
তাই যখনই বাইরে যাবেন তখন অবশ্যই সানস্ক্রিন ক্রিম লাগিয়ে যাবেন। আর ছাতা, হ্যাট, ওড়না, স্কার্ফ ইত্যাদি দিয়ে নিজের ত্বককে সূর্যের রশ্মি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন।
৬. যারা বহুদিন যাবত ব্রণ সমস্যায় ভুগছেন এবং কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না তারা আর দেরি না করে কোন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।
পরিশেষে বলা যায়, ব্রণ এমন একটি সমস্যা যা কেবল আপনার মুখের সৌন্দর্য নষ্ট করে, তাছাড়া আর কিছু নয়। একটি নির্দিষ্ট বয়সে এটি এমনিতেই হয়।
সবসময় ব্রণ কেন হচ্ছে তা খুঁজে বের করা যায় না। তবে ব্রণ হলে উপরে যতোগুলো উপায় বলা হয়েছে তন্মধ্যে আপনি কয়েকটি ট্রাই করে দেখতে পারেন। আশা করা যায়, উপকৃত হবেন নিশ্চিত।
আরও পড়ুন: ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ানোর সহজ ও প্রাকৃতিক কিছু টিপস – ত্বক মাত্র ৭ দিনে ফর্সা হবে।