বিষন্নতা সত্যিকার অর্থে একটি চরম মানসিক রোগ। সাধারনভাবে এটাকে আমরা বলতে পারি, মনমরা ভাব। কোন কোন মনোবিজ্ঞানী এই বিষয়টিকে বিষন্নতা বলে অভিহিত করেছেন।
ইংরেজীতে বলা হচ্ছে, Depression is the combination of misery and malaise. আবার কেউ কেউ রুগ্ন দুঃখ-কষ্টকে বিষন্নতা বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ Depression is defined as morbid sadness.
জীবনে বিভিন্ন ধরণের কষ্ট এলেই আমরা মন খারাপ করি। হতে পারে পরীক্ষা খারাপ হওয়ার জন্য, কারও সাথে ঝগড়া হওয়ার জন্য, কারও অসুস্থ্যতার কারণে, কারও মৃত্যুর কারণে ইত্যাদি।
তাহলে প্রশ্ন হলো আমরা কোন সময় বুঝবো যে, সাধারন এই কষ্টগুলো আমাদের বিষন্নতার জন্য দায়ী? আজ সেই বিষয় নিয়েই আলোচনা করবো। তো আর কথা নয় – সরাসরি যাচ্ছি মূল আলোচনায়।
প্রথমেই আমরা দেখবো যে, এ বিষয়ে অর্থাৎ বিষন্নতার কারণ/সংজ্ঞা হিসেবে মনোবিজ্ঞান কি বলে:
১. যদি কখনো কোন কারন ছাড়াই দুঃখবোধ/মন খারাপ/কিছু ভালো না লাগা/বিষাদ/মনমরা ভাব দেখা দেয়।
২. যদি কোন মানুষের জীবনে সামান্য কারণেই দুঃখবোধ গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হয়।
৩. যথেষ্ট সঙ্গত কারণে সৃষ্ট মন খারাপ/বিষাদময়তা যখন দীর্ঘস্থায়ী ও গভীর হয়।
৪. মানুষ যখন কোন সাধারন কষ্টের কারণকে মেনে নিতে পারে না। নিজের উপর দোষ চাপিয়ে দেয় এবং কষ্ট প্রকাশ করে।
আর উপরের এই সব অবস্থাকে (অসুস্থ্যতাকে) আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ডিপ্রেসিভ ইলনেস (Depressive Illness) হিসেবে অভিহিত করেছেন।
অন্যদিকে মজার ব্যাপার হলো, পুরুষের তুলনায় নারীরা দ্বিগুণ হারে বিষন্নতায় আক্রান্ত হন। আর যারা বিবাহিত মহিলা তাদের বেলায় এটা আরও অনেক বেশি। এর থেকেও বেশি বিষন্নতায় ভোগেন যারা তালাক প্রাপ্ত এবং স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন ও একাকী বসবাস করেন।
বিষন্নতা-র লক্ষণ:
১. সব সময় বিষন্নভাব নিয়ে বসে থাকা;
২. মন ভালো থাকে না। বেশিরভাগ সময় আনমনায় কাটে;
৩. নিঃসঙ্গতা ও একাকী লাগা;
৪. যেকোন কাজের আগ্রহের অভাব সেটা যে কাজই হোক;
৫. যেকোন কিছুর প্রতি কৌতুহলের অভাব;
৬. মনোযোগের অভাব, ফলশ্রুতিতে স্মরণশক্তি কমে যায়;
৭. সহজেই কেঁদে ফেলা অথবা ক্রন্দন প্রবণতা;
৮. কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়া;
৯. নিজের প্রতি অপরাধবোধ লাগা;
১০. বর্তমান সময় সম্বন্ধে অসহায়বোধ প্রকাশ করা;
১১. ভবিষ্যত সম্বন্ধে অনাগ্রহ, অনীহা এবং সবকিছু অনিশ্চিত মনে করা;
১২. নিজেকে সব কিছুর জন্য অযোগ্য মনে করা;
১৩. কারও সাথে মিশতে না চাওয়া;
১৪. আত্মহত্যার প্রবণতা ও চেষ্টা করা;
১৫. রাতের বেলা ঘুম কম হওয়া বিশেষ করে শেষ রাত্রে;
১৬. কোন ধরণের অসুখ ছাড়াই শরীরের ওজন কমতে শুরু করা;
১৭. শারিরীক কোন কারণ ছাড়া মহিলাদের মাসিক ঋতুর অনিয়ম হওয়া বা মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া;
১৮. শারিরীক তেমন কোনো কারণ ছাড়া মাথা থেকে পা পর্যন্ত শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে নানা ধরণের উপসর্গ অনুভব করাসহ ইত্যাদি।
বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, কোন রোগীর যখন শারিরীক বিভিন্ন সমস্যার জন্য কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যাবেনা অথচ রোগী নিজেকে অসুস্থ্য মনে করবে এবং বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে যাবে কিন্তু রোগ ভালো হবে না তখনই বুঝতে হবে তিনি মানসিক রোগে আক্রান্ত।
বিষন্নতার সবটুকুই হয়তো সেই রোগীর মধ্যে প্রবেশ করেছে। হয়তো বিভিন্ন চিকিৎসায় সাময়িক ভালো হয় পরে আবার অসুস্থ্য হয়ে যায় অর্থাৎ উপসর্গ স্থায়ী নিরাময় হয় না। আর এসব ক্ষেত্রেই বোঝা যায় যে, ঐ ব্যক্তি বিষন্নতায় আক্রান্ত।
যেসব কারণে বিষন্নতা হয়:
১. বংশগত কারণে হতে পারে।
২. জৈব রাসায়নিক অর্থাৎ নর-এড্রেনালিন ও ফাইবহাইড্রোক্সিট্রিপ্টামিন এর স্বল্পতা, বিভিন্ন হরমোনের বিশৃঙ্খলা এবং কোষের ভেতরে সোডিয়ামের আধিক্য, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম এর গোলযোগসহ ইত্যাদি।
৩. বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও এমন হতে পারে যেমন- উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ, জন্মনিয়ন্ত্রক বড়ি ইত্যাদি।
৪. অ্যাবনরমাল দৈহিক অবস্থার কারণে যেমন- মস্তিষ্কে টিউমার, সন্তান প্রসবের পরে ইত্যাদি।
মনস্তাত্ত্বিক কিছু কারন:
১. ছোটবেলা থেকেই যারা অতিশয় দূর্বল প্রকৃতির হয়;
২. বাল্যকালেই মা, বাবার বিচ্ছেদ কিংবা বাবা-মা থেকে আলাদা বসবাস করা;
৩. অযত্ন কিংবা অত্যাধিক সুরক্ষিত শৈশব অবস্থাসহ ইত্যাদি।
সামাজিক কিছু কারন:
১. পরিসংখ্যান অনুসারে যারা ১১ বছর কিংবা তার আগের বয়সেই মা হারিয়েছেন;
২. যেসব নারী স্বামীর সমর্থন পাননি;
৩. যারা সবসময় অলস প্রকৃতির এবং কোন কাজ করে না।
আরেকটি মজার তথ্য আসলে আপনাদের বলা দরকার। সেটি হলো- যারা বউকে দেশে রেখে বিদেশে বসবাস করেন অর্থাৎ কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে এমনটা বেশি ঘটে। স্বামীর ক্ষেত্রেও ঘটে এবং স্ত্রীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঘটে।
যেসব মহিলার স্বামী মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করে এবং মহিলারা শশুরালয়ে একাকী থাকে তাদের ক্ষেত্রে বিষন্নতার হার অনেক বেশি। হাস্যকর হলেও এমন নামকরণ করা যায় যেমন- দুবাই সিনড্রোম, সৌদি সিনড্রোম ইত্যাদি।
তাই প্রবাসী ভাইদের উদ্দেশ্যে বলবো, প্লীজ একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর নিজে দেশে আসুন। প্রয়োজনে বউকে নিয়ে যান। অথবা, বউ এর সাথে যেভাবেই হোক সুসম্পর্ক রাখুন। তাহলে আপনার জীবন এবং আপনার পরিবার ভালো থাকবে এবং বিষন্নতা নামক বিষ থেকে মুক্ত থাকবে সবাই।
আবার মা-বাবা যদি কোন কারনে সন্তানদের থেকে দূরে থাকে তবেও একপ্রকার রোগ হতে পারে যাকে বলা হয় “এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম” (Empty Nest Syndrome).
চিকিৎসা:
বিষন্নতা নামক রোগের চিকিৎসা আসলে তেমন কোনো ওষুধ নয়। সাধারণত চিকিৎসকগণ বিভিন্ন সময় ঘুমের ওষুধ প্রেসক্রাইব করে থাকেন।
তবে চিকিৎসা আছে, নেই এমন কোনো কথা নয়। নিজে নিজে করা যাবে না। সবার আগে পরিবার থেকে ঐ ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ সাপোর্ট দিতে হবে।
আরও পড়ুন: ডাক্তার রোগীকে যেসব প্রশ্ন অবশ্যই করেন তা জেনে নিন।
তার রোগের জন্য কোন কারনটি দায়ী সেটা খুঁজে বের করতে হবে। তারপর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। আর প্রয়োজনে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীর কাছে গিয়ে পরামর্শ ও চিকিৎসা নিতে হবে।
উৎস: ডা. ফাইজুল হক (খানিকটা পরিমার্জিত)