বায়োক্যামিক চিকিৎসার ইতিহাস:
বায়োক্যামিক চিকিৎসা এবং এর ইতিহাস জগতের আর্ত ও দুঃস্থ মানবতার সেবক ও অসাধারন প্রতিভাশালী স্রষ্টা প্রদত্ত জ্ঞানভাণ্ডারের অধিকারী মহাত্মা স্যামুয়েল হ্যানিম্যানই সর্বপ্রথম গবেষণা করে ঘোষণা করেছেন যে, অচেতন ধাতব পদার্থে রোগ নিরাময় ও আরোগ্যকর ক্ষমতা রয়েছে।
এই আবিষ্কার’কে বলা হয় ‘মহা আবিষ্কার’। তিনিই প্রথম পরীক্ষা দ্বারা লবন, চুন, পটাশ ও বালিসহ প্রভৃতি অসংস্কৃতি অবস্থায় যা নিশ্চিত ছিল সেগুলোকে রোগ আরোগ্যের টিস্যু বা উৎপাদনীভূত ওষুধে পরিণত করেন।
অবশেষে জার্মানীর অন্তর্গত ওন্ডেনবার্স নিবাসী ডাঃ শুসলার গবেষণা ও অনুসন্ধানের দ্বারা বায়োক্যামিক চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
প্রকৃতপক্ষে, বায়োক্যামিক ওষুধের মূলতত্ত্ব নির্ভর করে আমাদের দেহের বিভিন্ন ইন্দ্রিয়গুলোর রচনা ও জীবনীশক্তির উপর। এই জীবদেহ কতকগুলো জান্তব (Organic) ও ধাতব (Inorganic) পদার্থ দ্বারা নির্মিত।
এটার মধ্যে জলীয় ভাগই শতকরা ৭০ ভাগ, জান্তব পদার্থের পরিমাণ শতকরা ২০-২৫ ভাগ এবং বাকি ৫-১০ ভাগ ধাতব পদার্থ। জীব শরীর দগ্ধ ও ভস্মীভূত করলে জলীয়াংশ উড়ে যায়, অবশেষে ধাতব পদার্থের অংশটুকু ভষ্ম হিসেবে পাওয়া যায়।
সাধারণত জীবদেহে জান্তব পদার্থের অভাব হয়না, তবে ধাতব পদার্থের অভাব অনেক সময় হয়ে থাকে। যখন কোনো কারণে এক বা একাধিক ধাতব পদার্থের অভাব দেখা দেয় তখন ঐ অভাবজনিত ধাতব পদার্থের কারণে কতকগুলো লক্ষণ প্রকাশ পায়, আর সেই লক্ষণগুলোই ভিন্ন ভিন্ন রোগ নামে অভিহিত হয়ে থাকে।
প্রকৃতিতে সর্বদাই মানবদেহের ধাতব লবণের অভাব পূরণ করার জন্য সততঃ চেষ্টা চলছে। আবার কোথাও বা অনিষ্টকারী পদার্থটিকে বের করে দেবার চেষ্টা করে। এ ব্যাপারে দেহ কৃতকার্য হলে আপনা হতেই সুস্থ্যতা আসে।
অপর পক্ষে, অকৃতকার্য হলে শরীরে ও মনে অসুস্থ্যতা থাকে। জান্তব ও ধাতব এই দুই প্রকার পদার্থের সমন্বয়ে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জীবন ধারার গতি অব্যাহত রয়েছে, যার ফলে মানব দেহের স্বাভাবিক পরিবর্তন ও সুস্থ্যতা রক্ষা হচ্ছে।
সম্প্রতি কিছু এক্সপেরিমেন্ট এর সাহায্যে এটা প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে যে, রক্তের মধ্যে সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও লাইম সল্ট পরিমাণ মতো থাকায় শরীর সুস্থ্য ও স্বাভাবিক থাকে – এটার ন্যূনতম অভাব বা বেশি হলেই রোগ বা পীড়া দেখা দেয়।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সাথে বায়োক্যামিক চিকিৎসার সম্পর্ক:
আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, বায়োক্যামিক চিকিৎসা পদ্ধতির জনক মহামতি শুসলার স্বয়ং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকও ছিলেন। অপরদিকে, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির জনক মহাত্মা হ্যানিম্যান ছিলেন একান্ত প্রতিভাবান ও খ্যাতি সম্পন্ন অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক।
পরবর্তীকালে জগৎ শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকগণ যেমন- ডাঃ হেরিং, ডাঃ ডিউন, ডাঃ বরিক, ডাঃ লুটিস, ডাঃ কেন্ট, ডাঃ ক্লার্ক, ডাঃ মাথুর ও ডাঃ কালী সহ আরও অনেকেই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় বিখ্যাত হন এবং খ্যাতি অর্জন করেন কিন্তু তাই বলে হোমিওপ্যাথিক ও বায়োক্যামিক একই ধরণের চিকিৎসা শাস্ত্র নয়।
হোমিওপ্যাথিক ও বায়োক্যামিক দুই ভিন্ন ভিন্ন শাস্ত্র। এ চিকিৎসা শাস্ত্র দুটি ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অগ্রসর হয়ে আসছে। Bios শব্দের অর্থ জীবন আর Chemistry শব্দের অর্থ রসায়নশাস্ত্র।
সুতরাং এক কথায় Biochemistry শব্দের অর্থ জৈব রসায়ন বা জীবদেহ গঠন উপযোগী রসায়নশাস্ত্র। বায়োক্যামিক চিকিৎসা মতে, মাত্র বারটি লবণ দ্বারা জীনের কোষময়, দেহের বর্ধন, পোষণ ও সুস্থ্যতা রক্ষা থাকে।
পীড়ার বা রোগের উপসর্গ নির্ণয় করার জন্য এটা অতি সহজ ও যুক্তিযুক্ত সত্যের উপর অধিষ্ঠিত। বায়োক্যামিক মতে, জীবদেহের কোষসমুহে কোনো বিশেষ ধরণের লবণিক পদার্থের অভাবেই পীড়ার বা রোগের সৃষ্টি হয়।
আর এ অভাব হতে যে লক্ষণগুলো প্রকাশিত হয় চিকিৎসক তা দূর করবার জন্য রোগীর উপর উক্ত লবণসমুহ ওষুধ হিসেবে প্রয়োগ করেন।
হোমিওপ্যাথিকে কিন্তু সদৃশ বিধান চিকিৎসা পদ্ধতি বলা হয়। এর মূলমন্ত্র হিসেবে বলা যায়, ‘Similia Similibus Curantur’ এটি একটি Latin Phrase যার অর্থ হলো Like things are cured by likes.
এর মূলমন্ত্র হলো- যেখানে কোনো দ্রব্যের বিষক্রিয়ার ফলে কতকগুলো রোগ লক্ষন উপস্থিত হয়, কোনো স্বাভাবিক রোগে উপরোক্ত লক্ষণের সদৃশ লক্ষণাবলী প্রকাশিত হলে সেই রোগে উক্ত দ্রব্যটি উচ্চ ও অধিকতর উচ্চতর শক্তি অর্থাৎ সুক্ষমাত্রায় প্রয়োগ করলে তা আরোগ্য হয়।
যেমন- অ্যাকোনাইট ন্যাপ নামক হোমিওপ্যাথিক ওষুধের বিষক্রিয়ার ফলে আকষ্মিকতা, বিষন্নতা, মৃত্যুভয়, অস্থিরতা, পিপাসা, জ্বালা, প্রচন্ড শীত বা গরমের প্রকোপ ইত্যাদি বিশেষ লক্ষণ প্রকাশ পায়।
জ্বর বা অন্য কোনো রোগে উক্ত সদৃশ লক্ষণাবলী প্রকাশ পেলে অ্যাকোনাইট ন্যাপ শক্তিকৃত অবস্থায় অর্থাৎ সুক্ষমাত্রায় প্রয়োগ করলে উক্ত জ্বর লক্ষণ দূরীভুত হয়।
প্রত্যেকটি প্রমাণ দ্বারা বিভিন্ন রোগীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে যে লক্ষণ প্রকাশ পায় তা একত্রে লিপিবদ্ধ করা হয় হোমিপ্যাথিক মেটিরিয়া মেডিকা নামক গ্রন্থে কিন্তু বায়োক্যামিক মতে এক একটি লবণিক অভাবের জন্য জীবদেহে যে সকল লক্ষণ প্রকাশ পায় তাই বায়োক্যামিক ওষুধের মেটেরিয়া মেডিকা’য় স্থান পায়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দেহের মধ্যে ‘ফেরাম ফস’ লবণের ঘাটতি বা অভাব হলে রোগীর মধ্যে কতকগুলো লক্ষণ প্রকাশ পায় যেমন- বেদনা সহ রক্তস্রাব, তরুণ সর্দি, প্রদাহের প্রথমাবস্থা, দন্তশূল, চক্ষুশূল, রক্তহীনতা, রক্তে লাল কণিকার অভাব, অজীর্ণভুক্ত দ্রব্য, বমি ইত্যাদি।
সুক্ষমাত্রায় বায়োক্যামিক লবণ (ফেরাম ফস) প্রয়োগ করলে ঐ সকল লক্ষণ দূরীভুত হয়ে পীড়া বা রোগ আরোগ্য হয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দিক হলো- বায়োক্যামিক ওষুধ অর্থাৎ এটা মানুষের দেহের মধ্যেই রয়েছে, বহিরাগত কোনো বিষয় বা পদার্থ নয়।
অপরদিকে, হোমিওপ্যাথিক শাস্ত্র জগতের বিভিন্ন প্রকার ধাতু, জান্তব, উদ্ভিদ ও রোগ বীজ সহ বিভিন্ন পদার্থকে ওষুধ হিসেবে স্বীকার করেছে।
হোমিওপ্যাথিক আবিষ্কারক মহাত্মা হ্যানিম্যান পীড়ার কারণরূপে শরীরস্থ চারটি বিশেষ দোষের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো- সোরা, সিফিলিস, সাইকোসিস ও টিউবারকুলোসিস। এই চারটি বিষয় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে উপেক্ষা করার কোনো অবকাশ নেই।
আরও পড়ুন: কেউ বৈদ্যুতিক শক খেলে যা করবেন।
এগুলো দেহের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে জটিলতার সৃষ্টি করে সেই জটিলতার নামই রোগ বা পীড়া। এদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায় যে, দুটি চিকিৎসা ব্যবস্থাই সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উভয়েরই উদ্দেশ্য হলো মনুষ্যদেহের রোগ নিরাময় করা।
কোনো প্রতিবাদ বা যুক্তিতর্কের অবকাশ নেই। একজন বললো, তেলের অভাবে প্রদীপটি নিভে গেল, অপরজন বললো, অক্সিজেনের অভাবে প্রদীপটি নিভে গেল – এখানে উভয়ই ঠিক, যুক্তিতর্কে লাভ নেই।
এই দুটি শাস্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন দিকে প্রসারিত হলেও হোমিওপ্যাথিক ও বায়োক্যামিক এর মধ্যে কিছু সাদৃশ্য আছে।
হোমিওপ্যাথিক ও বায়োক্যামিক উভয় শাস্ত্র-ই লক্ষণের উপর নির্ভরশীল। যেমন- বায়োক্যামিক ‘ক্যালক্যারিয়া ফস’ প্রয়োগার্থে পাকস্থলীর উপর বিশেষ ক্রিয়ার দিকে দৃষ্টি দেয়া হয়।
পাকস্থলীর পরিপাক রসের অভাব হলে অজীর্ণতা, ক্ষুধা-মন্দা প্রভৃতি পীড়া ও তার সাথে অণ্ডলালাকার রসের সবুজ বর্ণ পিচ্ছিল ও দূর্গন্ধযুক্ত মলত্যাগ হতে থাকে। এই ওষুধটি হোমিওপ্যাথিক শাস্ত্রেও আছে।
হোমিওপ্যাথিক ওষুধ পরীক্ষাকালে দেখা গেছে যে, ‘ক্যালক্যারিয়া ফস’ সুস্থ্য মানব দেহে পুনঃ পুনঃ প্রয়োগ করলে অগ্নিমান্দ্য, অজীর্ণতা ও সবুজ রঙের পিচ্ছিল মল নির্গত হতে দেখা যায়। সুতরাং এই প্রকার লক্ষণের জন্য এই ওষুধটিই নির্ণয় করা হয়।
বায়োক্যামিক ওষুধগুলো বিচূর্ণ পদ্ধতিতে তৈরী করা হয়। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ তরলক্রম হিসেবে তৈরী করা হয়। বিশেষ করে নিম্ন পাওয়ারের/শক্তির ওষুধ এবং বেশি পাওয়ারের/শক্তির ওষুধ বিচূর্ণ পদ্ধতিতে একই ফার্মাকোপিয়ার নিয়ম-নীতি অনুসারে তৈরী করা হয়।
এ উভয় চিকিৎসা ব্যবস্থার সাদৃশ্যের দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য একটি আকর্ষণ হলো ‘উভয় চিকিৎসার ক্ষেত্রে সুক্ষ্মমাত্রা ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে’।
উভয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় সুক্ষ্মমাত্রার ওষুধ প্রয়োগ দ্বারা চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাহায্য করে মানুষের স্বাভাবিক আরোগ্যদায়ক শক্তিকে জাগিয়ে তোলে।
বায়োক্যামিক সব কয়টি ওষুধ হোমিওপ্যাথিক মেটেরিয়া মেডিকা হতে গৃহিত হয়েছে। বায়োক্যামিক চিকিৎসা ব্যবস্থা পৃথক হলেও হোমিওপ্যাথিক শিক্ষার্থীরাই বায়োক্যামিক চিকিৎসক হয়ে থাকেন এবং চিকিৎসা করেন।
অতএব, হোমিওপ্যাথিক ও বায়োক্যামিক চিকিৎসা শাস্ত্রদ্বয় পৃথক হলেও উভয়ে সমগোত্রীয়, একটি অপরটির সাথে কোনো বিরোধ সৃষ্টি করে না। একটি অপরটির পরিপূরক।