বায়োক্যামিক চিকিৎসা:
ডাঃ সুয়েসলার (Dr. Schuessler) এর মতে, মানুষের দৈহিক গঠনে ১২টি ধাতব লবণ (Inorganic Salt) অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই লবণগুলোর এক একটির ক্রিয়া মানবদেহে এক এক প্রকারের হয়। বায়োক্যামিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে মূলত এই লবণগুলোই ব্যবহৃত হয়।
মানব দেহে এগুলোর অভাব ঘটলে নানা প্রকার শারীরিক গোলযোগ দেখা দেয়। বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে এই ধাতব লবণগুলো ওষুধ হিসাবে গ্রহণ করলে দেহ রোগমুক্ত হয়।
এই ওষুধগুলো সাধারণত ট্রাইচুরিশান (চূর্নিকৃত + শক্তিকৃত) অবস্থায় ব্যবহৃত হয় – পাউডার অথবা ট্যাবলেট রূপে। শক্তির মাত্রা সমুহ হলো – 3x, 6x, 12x ইত্যাদি।
ট্যাবলেটগুলো সাধারণত ৩/৪ টি করে দিনে ৩/৪ বার খেতে হয়। গরম জলে গুলে খেলে এর ক্রিয়া ভালোভাবে হয়। অর্থাৎ বেশি কাজ করে। এটি বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষিত।
তবে গরম জলে খাওয়া সম্ভব না হলে ঠান্ডা জলে না খেয়ে চিবিয়ে খাওয়া যায়। আবার এই ১২টি ওষুধই হোমিওপ্যাথি পদ্ধতিতে শক্তিকৃত করে হোমিওপ্যাথি মতে (সদৃশ বিধান) রোগীর দেহে প্রয়োগ করা হয়।
সেক্ষেত্রে শক্তির মাত্রা – ৩/৬/৩০/২০০/১০০০/১০০০০/১০০০০০ ইত্যাদি। এখন এই ১২টি ওষুধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
ক্যালক্যারিয়া ফ্লোরিকা (Calcaria Flourica):
পরিচয়: ক্যালসিয়াম ফ্লোরাইড যাকে ফ্লোরস্পোর বলা হয়। রাসায়নিক সংকেত – CaF2
প্রয়োগ ক্ষেত্র: ছানি, লাম্বাগো (কোমরে ব্যথা), মচকা ব্যথা, স্তনে গুটি, দাঁত উঠতে দেরি হওয়া, দাঁতের ক্ষয় ও প্রদাহ, চামড়া ফাটা, সহজেই রক্তপাত, বংশগত সিফিলিস ও অ্যাডিনয়েডস।
ক্যালক্যারিয়া ফস:
পরিচয়: ক্যালসিয়াম ফসফেট, ফসফেট অব লাইম। রাসায়নিক সংকেত – Ca3(PO4)2
প্রয়োগক্ষেত্রঃ স্নায়ুর দুর্বলতা, মৃগী, অন্ত্রের প্রদাহ, পরিপোষণ বা মেটাবলিজমের ত্রুটি, দাঁত উঠতে বিলম্ব, ক্ষয়রোগ, পায়খানার সঙ্গে অভুক্ত দ্রব্য, পেটে বায়ু। ডায়াবেটিস রোগীদের অস্থিভঙ্গ, মস্তিষ্কের অবসাদ, ব্রাইটস ডিজিজ, রসযুক্ত চর্মরোগ।
ক্যালক্যারিয়া সালফ (Calcarea Sulphuricum):
পরিচয়: ক্যালসিয়াম সালফেট। জিপসাম। প্লাস্টার অব প্যারিস। রাসায়নিক সংকেত – CaSO4H2O
প্রয়োগক্ষেত্র: ফোঁড়া, কার্বাঙ্কল, পুঁজযুক্ত ব্রণ, পোড়া ঘা, চুলকানি, ফিশ্চুলা, গ্রন্থিস্ফীতি, স্নায়বিক দুর্বলতা, জনন ইন্দ্রিয়ের দুর্বলতা, পরিবর্তনশীল মানসিকতা, পায়ের তালুতে জ্বলন এবং চুলকানো, অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ খাওয়ার পরে শারিরীক দুর্বলতা।
ফেরাম ফস (Ferrum Phosphoricum):
পরিচয়: ফেরোসো ফেরিক ফসফেট। ফসফেট অব আয়রন। রাসায়নিক সংকেত – Fe3(PO4)2
প্রয়োগক্ষেত্র: অ্যানিমিয়া, রক্তপাতের ফলে রক্তাল্পতা, নাড়ির গতি দ্রুত, মাথার যন্ত্রণা, জিভের প্রদাহ, জিভ লেপাকৃত অথবা রক্তাভ, অক্ষুধা, দেহের ওজন এবং শক্তি হ্রাস পাওয়া, শিশুদের মানসিক ও দৈহিক বল হ্রাস, শীর্ণতা, ক্ষুধামান্দ্য।
ক্যালি মিউর (Kali Muriaticum):
পরিচয়: পটাশিয়াম ক্লোরাইড। রাসায়নিক সংকেত – KCl
প্রয়োগ ক্ষেত্র: হার্টের দুর্বলতা, বুক ধড়ফড় করা, হৃদপিণ্ড বৃদ্ধি পাওয়া, পেরিকার্ডাইটিস, থ্রম্বোসিস (এম্বলিজম), গ্রন্থি বৃদ্ধি, ফুসফুস প্রদাহ, নিউমোনিয়া, পিত্ত নিঃসরণ কম হওয়ার ফলে অজীর্ণ, অক্ষুধা, গতক্ষত, লিভারের দুর্বলতা।
ক্যালি ফস (Kali Phosphoricum):
পরিচয়: পটাশিয়াম ফসফেট। রাসায়নিক সংকেত – K2HPO4
প্রয়োগক্ষেত্র: মানসিক দুর্বলতা, মানসিক বিপর্যয়, মানসিক অবসাদ, মানসিক কারণে মাথার যন্ত্রণা, মস্তিষ্কের দুর্বলতা ও অবসাদ, পেটে বায়ু এবং সে কারণে হৃদপিণ্ডের অপক্রিয়া, দুর্গন্ধযুক্ত পায়খানা, উঠে দাড়ালে মাথা ঘোরা, সেরিব্রাল অ্যানিমিয়া, জননাঙ্গের দুর্বলতা।
ম্যাগ ফস (Magnesia Phosphoricum):
পরিচয়: ম্যাগনেসিয়াম ফসফেট। রাসায়নিক সংকেত – MgHPO4, 7H2O
প্রয়োগক্ষেত্র: বিভিন্ন প্রকারের ব্যথা ও যন্ত্রণা, মাথা যন্ত্রণা, পেটে ব্যথা, স্নায়ু শূল, স্প্যাজমোডিক পেন, স্মৃতিশক্তিহীনতা, চিন্তাশক্তির দুর্বলতা, স্নায়বিক দুর্বলতা, দাঁড়ানো অবস্থায় এবং চলতে চলতে মলমূত্র ত্যাগের ইচ্ছা। এই ওষুধ স্নায়ুকোষে পুষ্টি জোগায়।
ন্যাট্রাম মিউর (Natrum Muriaticum):
পরিচয়: সোডিয়াম ক্লোরাইড। সাধারণ লবন। রাসায়নিক সংকেত – NaCl
প্রয়োগক্ষেত্র: নুন বেশি খাওয়ার প্রবণতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, মাথা যন্ত্রণা (হাঁপানি সহ), সর্দি কাশির প্রবণতা, হাঁচি, নাক দিয়ে কাঁচা জল পড়া, হিস্টিরিয়া, সংজ্ঞালোপ, টাইফয়েড, জ্বরে প্রলাপ বকা, পেটে শূল বেদনা, লিভারের গোলযোগ, বোধ শক্তির অভাব, কৃমি, মস্তিষ্কের দুর্বলতা।
ন্যাট্রাম ফস (Natrum Phosphoricum):
পরিচয়: সোডিয়াম ফসফেট (Na2PO4)
প্রয়োগক্ষেত্র: অম্লরোগ, পাকস্থলী এবং অন্ত্রের গোলযোগ, শিশুদের অতিরিক্ত দুধ খাওয়ানোর ফলে ল্যাকটিক অ্যাসিড বৃদ্ধি পাওয়া, গণোরিয়া জিভে হালকা প্রলেপ, বুকের বাঁ দিকে ব্যথা (নিপল এর নিচে), ডান কাঁধে বাত জনিত ব্যথা, স্বপ্ন দোষ ব্যতিত ধাতুক্ষয়, অপথ্যালমিয়া, কান থেকে রস পড়া।
আরও পড়ুন: যৌন মিলন বিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা – যা জানা জরুরী।
ন্যাট্রাম সালফ (Natrum Sulphuricum):
পরিচয়: সোডিয়াম সালফেট। গ্লুবারস সল্ট (Na2SO4), (10H2O)
প্রয়োগক্ষেত্র: গ্যাসট্রাইটিস, পেটে বায়ু, পেটে ব্যথা, লিভারের গোলমাল, নখের গোড়ায় প্রদাহ এবং পুঁজ, অবসাদ, তন্দ্রালুতা, আঁচিল – চোখের চারপাশে, মাথায়, মুখে, বুকে ও মলদ্বারে। নেফ্রাইটিস, মেরুদন্ডে ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা, সেক্রামে ব্যথা।
সাইলিশিয়া (Silicea):
পরিচয়: সিলিকা। সিলিসিক অক্সাইড (SiO2)
প্রয়োগক্ষেত্র: রিকেট, বাতরোগ, প্রস্টেট গ্ল্যাণ্ডের বৃদ্ধি, মধ্য কর্ণের প্রদাহ, দেহের কোথাও পূঁজ, গেঁটে বাত, কোষ্ঠাকাঠিন্য, অম্ল, অজীর্ণ, পুরানো কাশি।
হোমিওপ্যাথির সাথে বায়োক্যামিক চিকিৎসা পদ্ধতির অনেক মিল রয়েছে। দুটোই সদৃশ বিধানের উপর কাজ করে। বায়োক্যামিক চিকিৎসা হোমিওপ্যাথির তুলনায় কম জনপ্রিয়।
বর্তমানে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার পাশাপাশি সম্পূরক হিসাবে বায়োক্যামিক চিকিৎসা দেয়া হয়। বায়োক্যামিক চিকিৎসা হোমিওপ্যাথির মতোই সহজলভ্য এবং চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যয়বহুল নয়।