বাল্য বিয়ে আসলে একটি জীবনের জন্য কেবল হুমকিস্বরূপ। এটি জীবনের জন্য কখনো ভালো কিছু বয়ে আনে না। আর এই কথাটা আমরা প্রথমেই বুঝতে চাই না। যখন কোনো মেয়ের ক্ষতি হয়ে যায় তখন আমরা বুঝতে পারি।
ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর থানার অন্তর্গত মাঝিপাড়া গ্রামের হারুনের মেয়ে নাহিদার ক্ষেত্রে ঠিক এমন ঘটনাই ঘটেছে। মেয়েটি ৫ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তার বাবা তার বিয়ে দিয়ে দেয়।
বিয়ে দেয় পাশের গ্রামেরই এক মাঝির ছেলের সাথে। নাহিদা পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। ৫ম শ্রেণীতে তার রোল নম্বর ছিলো ২। মেয়েটি পড়াশোনা করতে চেয়েছিল। কিন্তু এত ছোট মেয়ের কথার মূল্য কে দেয়।
বিয়ে দেওয়ার পরে কিছুদিন ভালোই চলছিলো। এরপর শুরু হয় নির্যাতন। নাহিদার স্বামীও অল্প বয়সী। যার কারণে তেমন কোনো কর্ম ছিলো না। তাই নাহিদার উপর যৌতুক হিসেবে টাকার দাবি করা হয়।
কিন্তু নাহিদার বাবা বিয়ের সময় ছেলেকে ৫০ হাজার টাকা যৌতুক হিসেবে দিয়েছিল। সেই ৫০ হাজার টাকা দিতেই তিনি হিমশিম খেয়েছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে ধার দেনা করে দিয়েছেন।
আর কোনো টাকা দেয়ার তার সামর্থ্য ছিলো না। কিন্তু নাহিদা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাবার বাড়িতে চলে আসে। তার বাবাকে সব কিছু বলে। কিন্তু তার বাবা আসলে কিছুই করতে পারছিলেন না।
বিয়ের সময় বলেছিলো নাহিদার পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। কিন্তু নাহিদার স্বামী তা করতে দেয়নি। যাইহোক, অতিরিক্ত টাকা দিতে না পারায় নাহিদাকে তার শশুরবাড়ির লোকজন আর নিতে আসে না।
এরই মধ্যে ঘটে আরেক দূর্ঘটনা। নাহিদার পেটে সন্তান চলে আসে। নাহিদা ছোট মেয়ে। ও ওসবের তেমন কিছুই বুঝে না। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে তার কিছুই জানা ছিলো না।
সব মিলিয়ে নাহিদার বাবা অনেক চিন্তায় পড়ে যান। নাহিদার শশুরবাড়ির লোকজন কিংবা ওর স্বামী কোন খোঁজ-খবরই রাখে না।
ধীরে ধীরে নাহিদার পেটের সন্তান বড় হতে থাকে। এত ছোট মেয়ে কিভাবে সন্তান প্রসব করবে তা আসলে ভাবার বিষয়। বিয়ের সময় নাহিদার বাবার এই বিষয়টি মাথায় ঢোকেনি।
কিন্তু নাহিদার এমন অবস্থা দেখে তিনি তখন খুবই মর্মাহত হয়ে পড়েন। বিশেষত নাহিদার শশুরবাড়ির লোকজন অতিরিক্ত যৌতুকের টাকার কারণে নাহিদার কোনো খোঁজ নেয় না এই বিষয়টি উনাকে বেশি আঘাত দিয়েছে।
এরপর এভাবে বেশ কয়েক মাস কেটে যায়। নাহিদারও বাচ্চা হওয়ার সময় চলে আসে। কিন্তু নরমাল ডেলিভারী সম্ভব নয়। সিজার করানোর প্রয়োজন পড়ে।
কিন্তু সিজার করাতে বেশ কিছু টাকার প্রয়োজন অন্তত ১৫ হাজার টাকা। কোনো উপায় না পেয়ে নাহিদার বাবা নাহিদার মায়ের অংশীদারিত্বে পাওয়া সম্পত্তি থেকে ১৫ হাজার টাকা নিয়ে আসেন।
নাহিদার সিজার করানো হয়। একটি মেয়ে সন্তান হয়। মেয়ে হয়েছে শুনে নাহিদার স্বামী কিংবা উনার পরিবারের কেউ-ই দেখতে আসেনি।
নাহিদাকে বেশ কিছুদিন পরে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আনা হয়। নাহিদার বাবার ওপর কেবল বোঝা হয়ে থাকে নাহিদা। কিছুই করার ছিলো না। সবকিছু যেন ঝাপসা মনে হয়। একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এক বছরের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেলো।
বর্তমানে নাহিদা তার বাবার বাড়িতেই আছে। অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছে। নাহিদা নিজেই একটি বাচ্চা মেয়ে তার ওপর আবার তার কোলে বাচ্চা। সব মিলিয়ে নাহিদার জীবনটা বিষাক্ত হয়ে উঠছিল।
গ্রাম্য সালিশীর মাধ্যমে নাহিদাকে তার স্বামীর বাড়ি পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু নাহিদাকে অত্যাচারের কারণে নাহিদা সে বাড়িতে বেশিদিন থাকতে পারেনি।
বর্তমানে নাহিদার বাবা তার ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কিছুই আর করার নাই। নাহিদা বর্তমানে কেবলই তার বাবার জন্য বোঝা হয়ে দাড়িয়েছে। শুধুমাত্র বাল্য বিয়ে-এর কারণে নাহিদার জীবন আজ জরা-জীর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে।
জীবিত থেকেও যেন মৃত মানুষ। সত্যিকার অর্থেই বাল্য বিবাহ কেবল মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। অল্প বয়সী ছেলে কিংবা মেয়ে সংসার ও জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই বোঝে না।
সামান্য কারণে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। অল্প বয়সে সন্তান নেওয়াতে অনেক সময় মায়ের মৃত্যু হয়। শারিরীক গঠনের অপূর্ণতা থাকে। সব মিলিয়ে বাল্য বিয়ে কেবল বিভিন্ন দিক থেকে ক্ষতিই করে থাকে।
আরও পড়ুন: ফার্মেসী থেকে ভেজালমুক্ত ওষুধ কেনার উপায়।
সরকারের পক্ষ থেকে যাতে বাল্য বিয়ে বন্ধে যে আইন রয়েছে তার কঠোর প্রয়োগ করা হয়। স্থানীয় প্রশাসনকে অনেক বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন সময়ে বাল্য বিবাহ বন্ধে গ্রামের মানুষকে সচেতন করার স্বার্থে বিলবোড, সভা-সেমিনারের আয়োজন করা উচিত।