বাত ব্যথার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। একটু বয়স্ক যারা তাদের এ সমস্যা বেশি হয়। বিভিন্ন প্রকার ওষুধেও তেমন কাজ হয় না। অনেকেই অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে যান।
তাছাড়া, সাইড ইফেক্ট এর ব্যাপার তো আছেই। বাত সহ বিভিন্ন ব্যথার ওষুধ বেশি খেলেই তা কিডনীর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। যাই হোক, আজ আমরা জানবো কিভাবে হোমিও ওষুধ দ্বারা এসব রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
তো আর কথা নয় – সরাসরি যাচ্ছি মূল আলোচনায়। তবে একটা কথা আগেই বলে রাখি, এসব ওষুধ এখানে পড়ার পরে নিজে নিজে ইচ্ছেমতো সেবন করতে যাবেন না।
অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করবেন। তাহলে আপনার কোন সমস্যা হবে না এবং রোগ সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা ১০০% থাকবে।
বাত ব্যথাসহ বিভিন্ন ব্যথার ধরন, ব্যথার কারণ ইত্যাদি লক্ষণ মিলিয়ে ঔষধ খেতে হবে। সব ধরনের ব্যথায় একই ঔষধ খেলে চলবে না। নিচে ব্যথার ধরণ অনুযায়ী ওষুধসমুহ উল্লেখ করা হলো:
Aconiturn Napellus: একোনাইট ব্যথার একটি সেরা ঔষধ। সাধারণত ভয়ঙ্কর ধরণের ব্যথা, ছুড়ি মারার মতো ব্যথা, হুল ফোটানোর ব্যথা, ব্যথার চোটে দম বন্ধ হয়ে আসে, ব্যথা যদি হঠাৎ দেখা দেয় এবং ব্যথার চোটে যদি ’এখনই মরে যাব’ এমন ভয় হতে থাকে, তবে একোনাইট খেতে হবে।
Arnica Montana: যেকোন ধরনের আঘাত, থেতলানো, মচকানো, মোচড়ানো বা উপর থেকে পতনজনিত ব্যথায় আর্নিকা খেতে হবে। বাত ব্যথায়ও এই ওষুধটি খুব ব্যবহৃত হয়।
এছাড়াও পেশী বা মাংশের ব্যথায় আর্নিকা এক নম্বর ঔষধ। শরীরের কোন একটি অঙ্গের বেশী ব্যবহারের ফলে যদি তাতে ব্যথা শুরু হয়, তবে আর্নিকা খেতে ভুলবেন না।
যদি শরীরের কোন অংশে এমন তীব্র ব্যথা থাকে যে, কাউকে তার দিকে আসতে দেখলেই সে ভয় পেয়ে যায় (কারণ- ধাক্কা লাগলে ব্যথার চোটে তার প্রাণ হয়তো বেরিয়ে যাবে) এমন লক্ষণে আর্নিকা মন্ট প্রযোজ্য।
আঘাত পাওয়ার কয়েক বছর পরেও যদি সেখানে কোন সমস্যা দেখা দেয়, তবে আর্নিকা সেটি নিরাময় করবে। বিভিন্ন ব্যথার ক্ষেত্রে আর্নিকা এক নম্বর ঔষধ।
Bryonia Alba: মাথা ব্যথা, জয়েন্টের ব্যথা, হাড়ের ব্যথা, মাংসের ব্যথা, বুকের ব্যথা, বাতের ব্যথা প্রভৃতিতে ব্রায়োনিয়া সেবন করতে পারেন যদি সেই ব্যথা নড়াচড়া করলে বেড়ে যায়। ব্রায়োনিয়ার লক্ষণ হলো আক্রান্ত অঙ্গ যত বেশী নড়াচড়া করবেন, ব্যথা তত বেশী পেতে থাকে।
Rhus Toxicodendron: পক্ষান্তরে মাথা ব্যথা, জয়েন্টের ব্যথা, হাড়ের ব্যথা, মাংসের ব্যথা, বুকের ব্যথা, বাতের ব্যথা প্রভৃতিতে রাস টক্স সেবন করতে পারেন যদি সেই ব্যথা নড়াচড়া করলে কমে যায়।
রাস টক্সের লক্ষণ হলো আক্রান্ত অঙ্গ যত বেশী নড়াচড়া করবেন, ব্যথা তত বেশী কমতে থাকে। খুব ভারী কিছু উঠাতে গিয়ে কোমরে বা শরীরের অন্য কোন স্থানে ব্যথা পেলে রাস টক্স এক নাম্বার ঔষধ। বাত ব্যথাতে এই ওষুধটিও খুব ব্যবহার হয়।
Chamomilla: যদি ব্যথার তীব্রতায় কোন রোগী দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়ে, তার স্বাভাবিক জ্ঞান লোপ পেয়ে যায়, সে ডাক্তার বা নার্সকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিতে থাকে তবে তাকে ক্যামোমিলা খাওয়াতে হবে। ক্যামোমিলা হলো অভদ্র রোগীদের ঔষধ।
Colchicum Autumnale: কলচিকাম গেটে বাত বা জয়েন্টের ব্যথায় ব্যবহৃত হয়। ছোট ছোট জয়েন্টের বাতে এবং বিশেষত পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলের বাতের ব্যথায় কলচিকাম প্রযোজ্য।
কলচিকামের প্রধান লক্ষণ হলো খাবারের গন্ধে বমি আসে এবং আক্রান্ত অঙ্গের জোর বা শক্তি কমে যায়।
Hypericum Perforatum: যেসব আঘাতে কোন স্নায়ু ছিড়ে যায়, তাতে খুবই মারাত্মক ব্যথা শুরু হয় যা নিবারণে হাইপেরিকাম খাওয়ানো ছাড়া গতি নেই।
শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে আঘাত পেলে বা কিছু বিদ্ধ হলে হাইপেরিকাম খেতে হবে ঘনঘন যেমন- ব্রেইন বা মাথা, মেরুদন্ডের (পাছার নিকটে) হাড়ে, আঙুলের মাথায়, অণ্ডকোষে ইত্যাদি।
তবে যেসব ক্ষেত্রে পেশী এবং স্নায়ু দুটোই আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে বলে মনে হয়, তাতে আর্নিকা এবং হাইপেরিকাম একত্রে মিশিয়ে খেতে পারেন।
আঘাতের স্থান থেকে প্রচণ্ড ব্যথা যদি চারদিকে ছড়াতে থাকে বা খিঁচুনি দেখা দেয় অথবা শরীর ধনুকের ন্যায় বাঁকা হয়ে যায় (ধনুষ্টঙ্কার), তবে হাইপেরিকাম ঘনঘন খাওয়াতে থাকুন।
Ledum Palustre: সূচ, আলপিন, তারকাটা, পেরেক, টেটা প্রভৃতি বিদ্ধ হলে ব্যথা কমাতে এবং ধনুষ্টঙ্কার / খিঁচুনি
ঠেকাতে লিডাম পাল ঘনঘন খাওয়ান।
অর্থাৎ যেসব ক্ষেত্রে কোনকিছু শরীরের অনেক ভেতরে ঢুকে যায়, তাতে লিডাম প্রযোজ্য। এই ক্ষেত্রে লিডাম ব্যথাও দূর করবে এবং ধনুষ্টংকার হলে তাও সারিয়ে দেবে।
চোখে ঘুষি বা এই জাতীয় কোনো আঘাত লাগলে লিডাম এক ঘন্টা পরপর খেতে থাকুন। বাতের ব্যথায় উপকারী বিশেষত যাদের পা দুটি সব সময় ঠান্ডা থাকে।
Kali Bichronicum: ক্যালি বাইক্রোম ঔষধটির প্রধান লক্ষণ হলো ব্যথা আঙুলের মাথার মতো খুবই অল্প জায়গায় হয়ে থাকে, ব্যথা ঘন ঘন জায়গা বদল করে ইত্যাদি।
Plantago Major: দাঁত, কান এবং মুখের ব্যথায় প্লানটাগো মেজর এমন চমৎকার কাজ করে যে – তাকে এক কথায় যাদু বলাই যুক্তিসঙ্গত।
পত্রিকায় দেখলাম, একজন প্রখ্যাত সাংবাদিকের দাঁত ব্যথা সারাতে না পেরে ডেন্টিস্টরা শেষ পর্যন্ত একে একে তাঁর ভালো ভালো চারটি দাঁতই তুলে ফেলেছেন।
আহা! বেচারা ডেন্টিস্টরা যদি প্লান্টাগোর কথা জানতো তবে প্রবীণ এই সাংবাদিকের দাঁতগুলো হয়তো বেঁচে যেত।
Pulsatilla Pratensis: পালসেটিলার ব্যথার প্রধান লক্ষণ হলো ব্যথা ঘনঘন স্থান পরিবর্তন করে। আজ এক জায়গায় তো কাল অন্য জায়গায় কিংবা সকালে এক জায়গায় তো বিকালে অন্য জায়গায়। ব্যথার ধরন এরকম হলে অবশ্যই পালসেটিলা প্রয়োগ করতে হবে।
Lac Caninum: ল্যাক ক্যান এর ব্যথার প্রধান লক্ষণ হলো ব্যথা ঘন ঘন সাইড বা পার্শ্ব পরিবর্তন করে। আজ ডান পাশে তো কাল বাম পাশে কিংবা সকালে সামনের দিকে তো বিকালে পেছনের দিকে।
Bellis Perennis: প্রচণ্ড গরমের সময় অথবা পরিশ্রম করে ঘর্মাক্ত শরীরে আইসক্রিম বা খুব ঠান্ডা পানি খাওয়ার পরে যদি ব্যথা বা অন্য যেকোন রোগ দেখা দেয়, তবে বেলিস পিরেনিস খাওয়া ছাড়া আপনার মুক্তির কোন বিকল্প রাস্তা নাই।
Magnesia Phosphorica: ম্যাগ ফস স্নায়ুবিক ব্যথার এক নম্বর ঔষধ। ইহার ব্যথা অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুড়ি মারা অথবা চিড়িক মারা ধরণের মারাত্মক ব্যথা। আক্রান্ত অঙ্গকে মনে হবে কেউ যেন লোহার হাত দিয়ে চেপে ধরেছে। এমন ক্ষেত্রে অবশ্যই ম্যাগনেসিয়া ফসফরিকা সেবন করুন।
Thuja Occidentalis: টিকা বিসিজি, ডিপিটি, এটিএস, পোলিও, হেপাটাইটিস, এটিএস ইত্যাদি নেওয়ার কারণে ব্যথা হলে থুজা খেতে হবে।
টিকা নেওয়ার কারণে শরীরের বিভিন্ন স্থানে চিড়িক মারা ব্যথা (Neuralgia, Sciatica) অর্থাৎ যদি স্নায়ুবিক ব্যথা হয় এবং ডা. বার্নেটের মতে থুজা হলো এর শ্রেষ্ঠ ঔষধ।
পরিশেষে বলা যায়, এখানে ব্যথার ধরন অনুযায়ী কিছু ঔষধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত এগুলোই প্রধান ঔষধ। তবে হোমিওপ্যাথিতে এর বাইরেও ঔষধ আছে।
তবে আপনাদের কাছে অনুরোধ, নিজে নিজে ঔষধ কিনে সেবন করতে যাবেন না। আপনি এখানে উল্লেখিত ঔষধই সেবন করুন কিন্তু কোন চিকিৎসকের (হোমিওপ্যাথি) পরামর্শ নিন। নইলে ক্ষতি হতে পারে। কারন বিভিন্ন লক্ষণ অনুযায়ী ঔষধের মাত্রার ও শক্তির ব্যাপার থাকে।
আরও পড়ুন: ডা. নীলকমল বর্মণ এর হোমিওপ্যাথিক মর্মবাণী জেনে নিন।