করতোয়া’র আজকের স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনায় স্বাগতম। আজ আমরা আলোচনা করবো লিভার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। সম্প্রতি দেশে ও বিদেশে একটি রোগ ব্যাপক হারে বেড়ে যাচ্ছে। সেটি হলো – ফ্যাটি লিভার।
এটা লিভারের খুবই মারাত্মক রোগ। লিভারে যদি অতিরিক্ত চর্বি জমে তাহলেই এই ফ্যাটি লিভার নামক রোগটি দেখা দেয়। খুব সহজ করে যদি বলি, তাহলে বিষয়টি হলো – লিভার বড় হয়ে যায়।
বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেয়া তথ্য মতে, দেশের ১৮ থেকে ২০ শতাংশ মানুষ বর্তমানে এই রোগে আক্রান্ত। মানুষকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায় এই রোগ। সুতরাং সবার সচেতন হওয়া জরুরী যাতে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
প্রথমেই আমরা কিছু ঘরোয়া উপায় সম্পর্কে জানবো। এই উপায়গুলোর মাধ্যমে লিভারে বা যকৃতে জমে থাকা চর্বি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
যদি আপনার মনে হয় যে আপনার লিভারে চর্বি জমে যাচ্ছে কিংবা কোনো প্যাথলজি পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারেন যে, আপনি এই রোগে আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন তবে নিচের ঘরোয়া নিয়মগুলো পালন করার চেষ্টা করুন।
১। প্রতিদিন অন্তত এক ঘন্টা জোরে জোরে হাঁটুন। এমনভাবে হাঁটুন যাতে আপনার শরীর থেকে ঘাম ঝরতে থাকে। অন্যের কোনো কথায় পাত্তা না দিয়ে আপন মনে আপনার মতো আপনি হাঁটতে থাকুন। ভোরবেলাতে এই কাজটি সবচেয়ে ভালো হয়। তখন ইচ্ছে করলে আপনি দৌড়াতেও পারেন।
২। বিড়ি, সিগারেট, তামাক, হুক্কা, জর্দ্দা, গুল সহ আরও যতো নেশা জাতীয় দ্রব্য আছে তা পরিহার করুন। আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করুন। আপনার লিভার সুরক্ষা আগে নাকি আপনার নেশা আগে? আপনি নিজেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিন। খারাপ কাজ বা এমন কাজ যার জন্য নিজের ক্ষতি হয় তা বাদ দেওয়ার জন্য কারও পরামর্শ না নিলেও সমস্যা নেই।
৩। এখনতো যেখানে সেখানে ফাস্টফুডের দোকান পাওয়া যায়। ফাস্টফুড খাওয়া টোটালি বন্ধ করে দেওয়াই ভালো। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার চকলেট, কেক, মিষ্টি ও শর্করা আছে এমন ড্রিংক্স বা পানীয় বর্জন করুন – যতোটা সম্ভব।
৪। প্রতিদিনই কোনো না কোনো কায়িক বা শারীরিক পরিশ্রম করার চেষ্টা করুন। সকাল ও বিকালে নিয়ম করে ব্যায়াম করুন। শারীরিক পরিশ্রম আর ব্যায়াম লিভারের চর্বি কমাতে অনেকটাই ভূমিকা রাখে।
৫। ডাক্তার’রা ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় বিশেষতঃ জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তনের উপরই বেশি জোর দিয়ে থাকেন। শরীরের ওজনের প্রতি খেয়াল রাখা এবং প্রয়োজনে তা কমানো, প্রতিদিন শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করা এবং ক্যালরিযুক্ত আঁশসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ খুবই জরুরী।
৬। এখানে উপরের একটি বিষয় আরেকবার রিপিট করা প্রয়োজন। সেটা হলো – শরীরের ওজনের প্রতি খেয়াল রাখা। বেশি বা অতিরিক্ত ওজন শরীরের জন্য কোনোভাবেই ভালো কিছু বয়ে আনে না।
পারিবারিক জীবনে তথা সাংসারিক জীবনেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। আপনার শরীরের শতকরা হিসাবে ৫ কিংবা ১০ শতাংশ যদি কমাতে সক্ষম হউন তবে আপনার লিভারের চর্বি অটোম্যাটিক কমে যাবে।
লিভারের অতিরিক্ত চর্বি কমে গেলে এনজাইমগুলো স্বাভাবিক হয়ে যায়। এখানে লিভারের এনজাইমের কথা বলা হলো। তবে, শরীরের ওজন কখনোই অতি দ্রুত কমানো যাবে না। এতে করে আপনার শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।
৭। প্রতি বেলার খাবারে আঁশসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন। যেমন- সবুজ ফলমুল, শাক-সবজি ইত্যাদি। মাছ, মাংস কম খান। উচ্চ শর্করা বা চর্বিযুক্ত খাবার যেমন – পনির, লাল মাংস, মাছের ডিম, ঘি, মাখন, মাছের মাথা, মাংসের চর্বি বর্জন করুন।
৮। তেলেভাজা খাবার এড়িয়ে চলুন। পরটা, বড়া, ভাজি, বিরিয়ানি, ফ্রাইড চিকেন, তেহেরী সহ আধুনিক সব তেলেভাজা খাবার আজ থেকেই খাওয়া বন্ধ করুন। বেঁচে থাকলে পরে অনেক খেতে পারবেন।
৯। মাছ, মাংস একেবারেই নিষিদ্ধ নয়। আপনি দেশী মুরগি এবং ছোট মাছ খেতে পারেন। তবে, কম তেল ও কম মশলা দিয়ে রান্না করা উচিত।
১০। সব তো শুধু নিষেধ-ই করলাম। এবার কিছু খাওয়ার কথা বলি। হ্যা, আপনি সবজি, ভাত, ওটস, চিড়া, খই, সুপ, সবজি খিচুড়ি, ছোলা এগুলো খেতে পারেন। তবে, অবশ্যই কম তেলে রান্না করে খেতে হবে।
১১। সাগরের মাছ খেলে ওজন ও চর্বি দুটোই বাড়ে। সুতরাং যতোটা সম্ভব সাগরের যেসব মাছে চর্বি ও তেল বেশি থাকে সেগুলো খাওয়া বাদ দিন আপাতত।
১২। অধিক পরিমাণে যারা অ্যালকোহল নেন তারাও খুব সহজেই ফ্যাটি লিভার রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। সো, অধিক পরিমাণে অ্যালকোহল সেবন বা গ্রহণ আজই বাদ দিন।
১৩। ফ্যাটি লিভারের সমস্যায় একটি উত্তম ওষুধ হলো – আপেল ভিনেগার। পানি সামান্য গরম করার পর তাতে কয়েক ফোঁটা আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে দিনে অন্তত দুই বার খাবারের আগে খেয়ে নিন।
প্রয়োজনে, এটার সাথে মধুও মিশিয়ে নিতে পারেন। এভাবে করে কয়েক মাস খান। এতে করে আপনার লিভারের চর্বি কমে যেতে বাধ্য।
১৪। করোনাকালে লেবু খাওয়ার হিরিক পড়ে গেছে আশপাশে। কারণ, লেবুতে আছে ভিটামিন সি। আর ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তাই, মানুষ প্রতিনিয়ত লেবু খাওয়ার চেষ্টা করছে।
অপরদিকে, এই লেবু আপনার লিভারের ফ্যাট কমাতেও সাহায্য করে। একটি লেবুর পুরো রস হাফ গ্লাস পানিতে নিয়ে শরবত বানিয়ে খেয়ে নিন। এভাবে কয়েক সপ্তাহ খেতে থাকুন। আশা করি, উপকার পাবেন নিশ্চিত।
১৫। আরেকটি সহজ কাজ রয়েছে। হলুদ তো আমরা সব সময়ই তরকারিতে ব্যবহার করি। আর এটা সবার বাড়িতেই আছে। প্রতিদিন আপনি ১ গ্লাস পানিতে হাফ চামচ হলুদের গুড়া মিশিয়ে বা বেটে নিয়ে সেটা মিশিয়ে সামান্য গরম বা ফুটিয়ে নিন।
তারপর খেয়ে নিন। দিনে দুইবার খাওয়া উচিত। তাহলে উপকার বেশি হবে। কারণ, হলুদে আছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা ফ্যাট হজম করতে সাহায্য করে। অন্তত এই পদ্ধতিতে দুই সপ্তাহ ধরে হলুদ খেতে থাকুন। তারপর ফলাফলটা আপনি নিজেই টের পাবেন।
১৬। আমরা ইচ্ছে করলেই এখন গ্রিন টি খেতে পারি। দিনে অন্তত দুই বার গ্রিন টি খেলে লিভার ভালো থাকে।
১৭। হলুদের মতো আদা সবার বাড়িতে পাওয়া যায় না। এটা একটু ব্যয়বহুল। তারপরও প্রতিদিন (যদি পারেন) এক চামচ আদা হালকা গরম পানিতে মিশিয়ে খান।
শুধু লিভারের-ই উপকার হবে না বরং আপনার হজমজনিত যতো সমস্যা আছে সব দূর হয়ে যাবে। ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য ন্যূনতম দুই সপ্তাহ ধরে খান।
১৮। এক কাপ গরম পানিতে যদি হাফ চামচ যষ্টিমধু মিশিয়ে দিনে দুইবার খেতে পারেন তবেও আপনার লিভার থেকে ফ্যাটি অ্যাসিড অনেকটা দূর হবে।
১৯। শরীরে আলাদা কিছু রোগ থাকলেও কিন্তু ফ্যাটি লিভার রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং রোগগুলোর ব্যাপারে সজাগ থাকা জরুরী।
যেমন – ডায়াবেটিস, হাই-ব্লাড প্রেসার, ডিজলিপিডেমিয়া বা রক্তে চর্বি জমা বা বেশি থাকা ইত্যাদি। শরীরে এসব রোগ থাকলে এগুলোর চিকিৎসা জরুরী করা প্রয়োজন।
২০। ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হার্ট ডিজিজ কিংবা ব্রেইন স্ট্রোকের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই, আপনার যদি এই রোগ হয়ে থাকে তবে দ্রুত কোনো অভিজ্ঞ কোনো ডাক্তারের তত্বাবধানে চিকিৎসা করুন।
আরও পড়ুন: ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে যে ১০ বিষয়ের উপর সচেতন হওয়া জরুরী।
হতে পারে সেটা হোমিওপ্যাথিক, অ্যালোপ্যাথিক কিংবা অন্য কোন। রোগ নিয়ে বসে থাকা মোটেই উচিত নয়। আর উপরের পয়েন্ট আকারে যে কথাগুলো বলা হয়েছে সেগুলো মেনে চলার চেষ্টা করুন।