ফার্মেসী থেকে আমরা একান্ত প্রয়োজনে ওষুধ কিনতে যাই। ওষুধ মানুষের জীবন রক্ষা করে। বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্ত করে। সুতরাং ওষুধ যাতে নকল না হয় সেটা আমরা সবাই চাই।
কিন্তু সচেতনতার অভাবে আমরা অনেক সময় ভেজাল বা নকল ওষুধ কিনে ফেলি। আমরা কিন্তু এত সহজে সেগুলো বুঝতে পারি না। নকল ওষুধের প্রভাবে রোগ ভালো হওয়া তো দূরের কথা বরং মৃত্যু হতে পারে।
কিছুদিন আগে একটি পত্রিকায় খবর বের হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকার মধ্যে মিটফোর্ডে কম দামে অনেক ওষুধ পাওয়া যায়। আবার, ঢাকার অদূরে একটি ইউনানী ও আয়ুর্বেদী ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে বিগত ২ বছর থেকে কেবল আটা-ময়দা ও সামান্য কেমিক্যাল দিয়ে মোনাস (মন্টিলুকাস্ট গ্রুপ) এবং প্যানটোনিক্স (প্যান্টোপ্রাজল গ্রুপ) তৈরী করা হতো।
সেই সব ভেজাল বা নকল ওষুধ কম দামে মিটফোর্ডে বিক্রি করা হতো। মিটফোর্ড থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আনাচে কানাচে সেগুলো বিক্রি হতো।
তাহলে চিন্তা করা যায়, ২ বছর থেকে কি পরিমাণ ভেজাল ওষুধ মানুষের পেটে গেছে। এই ভেজাল ওষুধের প্রভাবে না জানি কতো জনের আরও কতো রকমের রোগ হয়েছে।
আর ফার্মেসী থেকে ওষুধ কেনার সময় আমাদের অবশ্যই অনেক সাবধান হতে হবে। ৫০০ কিংবা ১০০০ টাকা ভিজিট দিয়ে ডাক্তার দেখানোর পরে যদি ভেজাল ওষুধ কিনে খাই বা খাওয়াই তবে আমাদের মতো বোকা আর কে আছে।
এটা বাংলাদেশ। এখানে সব কিছুতে ভেজাল হয়। মানুষের মন-মানসিকতা ছোট। সবাই স্বার্থের পেছনে ছুটে। কিন্তু স্বার্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে অন্যদিকে কার কি ক্ষতি হচ্ছে তা কেউ ভাবে না।
যদি ভাবতো তাহলে অন্তত নকল ওষুধ তৈরী করার মন-মানসিকতা কারও থাকতো না। তাই অবশ্যই আপামর জনসাধারণকে সচেতন হতে হবে।
এবার চলুন জেনে নিই ফার্মেসী থেকে ওষুধ কেনার সময় কিভাবে ভেজালমুক্ত ওষুধ কিনবেন?
১. ওষুধ কেনার সময় প্রথমেই লক্ষ্য করবেন যে, ওষুধগুলোর মেয়াদ আছে কিনা? প্রতিটি ওষুধ (পাতা, পট, ইনজেকশন, পাউডার, সাসপেনশান ইত্যাদি) এর গায়ে উৎপাদন তারিখ এবং মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ উল্লেখ থাকে। অবশ্যই আপনি নিজে দেখে তা নিশ্চিত হবেন।
অনেক ফার্মেসী ভুল করে আপনাকে মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ দিয়ে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই ওষুধগুলো সেবনে আপনার মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে ১০০ ভাগ নিশ্চিত হয়ে ওষুধ কিনবেন।
২. অনেক সময় ডাক্তারের জন্য দেয়া স্যাম্পল ওষুধ ফার্মেসীতে বিক্রি হয়। যদিও গুণগত মানে সেগুলো খারাপ নয় কিন্তু আপনার ঐসব ওষুধ না কেনাই ভালো।
ওসব ওষুধের গায়ে সাধারণত ফিজিশিয়ান্স স্যাম্পল কথাটা বাংলায় অথবা ইংরেজীতে লেখা থাকে। আর বর্তমানে কিছু কিছু ওষুধ কোম্পানী এমনভাবে ডাক্তারদের জন্য স্যাম্পল ওষুধ তৈরী করে যা আপনি ধরতেই পারবেন না।
৩. যেসব ফার্মেসী ওষুধ কেনার পরে আপনি চাওয়া মাত্রই বেশি বেশি ছাড় দেয় সেসব ফার্মেসী থেকে কেনা ওষুধ সম্পর্কে অনুগ্রহ করে সচেতন হোন। কারণ, ঐসব ফার্মেসী ঢাকার মিটফোর্ড নামক এলাকা থেকে নকল ওষুধ কিনে এনে বিক্রি করতে পারে।
সাধারণত ওষুধ কোম্পানীগুলো সচরাচর ১২% লাভ দিয়ে থাকে ফার্মেসীদের। অর্থাৎ একজন ফার্মেসীওয়ালা কোম্পানী থেকে ১০০ টাকার ওষুধ কিনলে কোম্পানীকে তিনি দেন ৮৮ টাকা। আর ১২ টাকা থাকে লাভ। এখন আপনাকে যদি ১০০ টাকার ওষুধ কোন ফার্মেসীওয়ালা ৭০ টাকাতেই দিয়ে দেয় তাহলে ওসব ওষুধের গুণগত মান কেমন থাকে নিজেই আইডিয়া করুন।
৪. যখন প্রেসক্রিপশন নিয়ে কোনো ফার্মেসীতে যাবেন তখন প্রেসক্রিপশনের বাইরে ওষুধ নিতে যাবেন না। তাহলে আপনার সমস্যা হতে পারে। আর প্রেসক্রিপশনে দেয়া ওষুধ এবং ফার্মেসী থেকে দেয়া ওষুধ এর মিল আছে কিনা সেটাও ভালো মতো মিলিয়ে নিবেন। খুব সহজে এবং একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ওষুধের গ্রুপ পরিবর্তন করে ওষুধ কিনবেন না।
৫. শারিরীক কোনো সমস্যা হলে যেখানে সেখানে গিয়ে ফার্মেসী থাকা লোকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেতে যাবেন না। ফার্মেসী যারা থাকে তাদের ওষুধ সম্পর্কে যথেষ্ট আইডিয়া থাকে কিন্তু তাই বলে তারা ডাক্তার নয়।
আপনাকে ভুলভাল ওষুধ দিলে আপনার ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে, এমবিবিএস ডাক্তার এর অনুমতি ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়া নিষেধ। অথচ দেখা যায়, ফার্মেসীওয়ালারা মন চাইলেই কাউকে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়ে দেন।
ফলশ্রুতিতে, ভবিষ্যতে আপনার শরীরে ঐ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে যেতে পারে। এতে করে পরবর্তীতে আর ঐ অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ আপনার শরীরে কাজ করবে না।
৬. ওষুধ কেনার পরে অবশ্যই একটি স্লিপ নিয়ে নিবেন। পরবর্তীতে ওষুধ খেয়ে রোগীর কিছু হলে আপনি ফার্মেসীতে এসে বলতে পারবেন এবং প্রয়োজনে অভিযোগ করতে পারবেন। কিন্তু স্লিপ যদি না থাকে তবে আপনার অভিযোগ কেউ আমলে নাও নিতে পারে।
৭. যেসব ফার্মেসী ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ঘুমের ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ বিক্রি করে থাকে সেসব ফার্মেসী পরিহার করুন। কারণ, তারা সরকারের আইনের বাইরে কাজ করে। শুধু লাভের আশায় তারা এমনটা করে। কিন্তু এতে আপামর জনসাধারণের বিরাট ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
আরও পড়ুন: মোবাইল কেনার আগে যে বিষয়গুলোতে নজর দেয়া উচিত।
পরিশেষে বলবো, ওষুধ আপনি অবশ্যই ফার্মেসী থেকেই কিনবেন। কিন্তু উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো মাথায় রাখবেন। একটু ভুলের জন্য আপনার কিংবা আপনার পরিবারের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। রোগ হলে তা সারানোর জন্য ওষুধের বিকল্প নেই। তাই টাকা খরচ করে খারাপ ওষুধ কিনে নিজের কিংবা পরিবারের কারও জীবন বিপন্ন করার কোনো প্রশ্নই আসে না।
লিখেছেন: আইরিন সুলতানা আরশি (শিক্ষক)।