আমাদের ত্বক খুবই নমনীয়। বলা যায় নাজুক প্রকৃতির। আমরা যদি প্রতিদিন আমাদের ত্বকের যত্ন না নিই তাহলে যেকোন রোগে সহজেই (বিশেষ করে ফাঙ্গাল ইনফেকশন) আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
বিশেষ করে এখানে ত্বকের রোগের কথা বলা হচ্ছে। ত্বকের রোগগুলোকে আমরা চর্ম রোগ বলে থাকি। একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন, ত্বকের যেকোন রোগ দীর্ঘদিন মানুষকে ভোগায়। আবার, বিভিন্ন রকম দাগ থেকে যায়। আর ত্বকের যতো রোগ আছে তার মধ্যে বেশিরভাগই হয় ফাঙ্গাল ইনফেকশনের মাধ্যমে।
ফাঙ্গাল ইনফেকশন কি? ফাঙ্গাল ইনফেকশন একটি সংক্রামক রোগ। আমাদের চারপাশে নানা ধরনের রোগ জীবাণু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে যা খালি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় দেহে প্রবেশ করে এসব জীবাণু।
সাধারণত এসব জীবাণু শরীরের যে কোনো একটি অংশকে আক্রান্ত করে। দ্রুত এ রোগের চিকিৎসা না নিলে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবণা থেকে যায়।
বিশেষ করে বর্ষাকালে ত্বকে ফাঙ্গাল আক্রমণ বেশি হয়। তাই শরীরের ত্বকে যে কোন ধরনের রোগে আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
যাদের ইমিউন সিস্টেম বেশি দূর্বল তারা বেশি ফাঙ্গাল ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়। ফাঙ্গাল ইনফেকশনের প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন- টিনিয়া পেডিস (এথলেটস ফুট), টিনিয়া করপোরিস (দাদ রোগ), ওনিচোমাইকোসিস (পায়ের নখের ইনফেকশন), টিনিয়া ভর্সিকুলার (সরাসরি ত্বকে আক্রান্ত হলে) ইত্যাদি।
কি কি কারনে স্কিন ফাঙ্গাস হতে পারে? ফাঙ্গাস বা ছত্রাক সাধারনত স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে জন্মে। বিশেষ করে বর্ষাকালে এ রোগ বেশি হয়। আবার ঘর্মাক্ত শরীরে স্কিন ফাঙ্গাস হতে পারে।
এছাড়াও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে বসবাস করা, খালি পায়ে নোংরা স্থানে হাঁটাচলা করা ইত্যাদি কারণেও ত্বকে ফাঙ্গাস আক্রমন করতে পারে। যাঁদের পা অতিরিক্ত ঘামে তাঁদের জুতো থেকেও ফাঙ্গাস আক্রমণ করতে পারে। এমনকি মাথার ত্বকেও ফাঙ্গাল ইনফেকশন হতে পারে।
সংক্রমণ: আগেই বলা হয়েছে ফাঙ্গাল ইনফেকশন সাধারণত সংক্রমণজনিত রোগ। তাই ফাঙ্গাল ইনফেকশনে ভুগছে এমন রোগী থেকে দূরে থাকাই সবচেয়ে ভালো উপায়।
ওবেসিটি: মাত্রাতিরিক্ত ওজন ও মেদ ফাঙ্গাল ইনফেকশনের কারণ হতে পারে। কেননা যাঁদের অতিরিক্ত ওজন তারা প্রচুর ঘামে ও ঘাম থেকেই হতে পারে স্কিন ডিজিজ।
ফাঙ্গাল ইনফেকশনের উপসর্গ:
১. ত্বক ক্রমশ অস্বাভাবিক লাল হওয়া;
২. ত্বকে প্রচুর চুলকানি, জ্বালা-পোড়া ও অস্বস্তি বোধ হওয়া;
৩. নখ বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ও হঠাৎ ভঙ্গুর হওয়া;
৪. হাত ও পায়ের ত্বকে আক্রান্ত স্থানে প্রচুর চুলকানি বেড়ে যায়, ত্বক খসখসে হওয়া ও চামড়া উঠে যাওয়া;
৫. আক্রান্ত স্থান হতে চুলকানির ফলে পানি বের হয়;
প্রতিরোধ: ত্বকের যেকোন ধরনের সমস্যা দেখা দিলেই খুব দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। কেননা আক্রান্ত স্থান থেকে সারা শরীরে ও ফাঙ্গাল খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ওষুধই শেষ কথা নয়। যদি দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে না পারেন তাহলে ঘরোয়া পদ্ধতিতে ফাঙ্গাল ইনফেকশন থেকে মুক্তি পেতে পারেন। সহজেই কিভাবে বাড়িতে বসে খুব সহজ উপায়ে নিজের যত্ন নিবেন তা নিচে দেয়া হলো, দেখে নিন।
১. খুব বেশি সময় ঘামে ভেজা কাপড় পড়ে না থাকা।
২. নিয়মিত কাপড়-চোপড় ডিটার্জেন্ট দিয়ে ধৌত করা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা
৩. যাদের পা ঘামার প্রবণতা বেশি তারা সম্ভব হলে আবদ্ধ জুতা পড়বেন না। আবদ্ধ জুতা পরলে পা থেকে দূর্গন্ধ সৃষ্টি হয় ও ফাঙ্গাস আক্রমণ করে।
যদিও অফিস-আদালতে আবদ্ধ জুতা পড়তে হয় সেক্ষেত্রে নিয়মিত জুতা-মোজা পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখার চেষ্টা করতে হবে। অতিরিক্ত পা ঘামলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
৪. দই এর ব্যবহার- ত্বকের যেকোন ধরনের ক্ষত ও ফাঙ্গাল ইনফেকশন দূর করতে সবচেয়ে কার্যকরী ঘরোয়া উপাদান হল দই।
এতে থাকা ল্যাকটিক এসিড জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল হিসেবে কাজ করে। দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য হাতে তৈরি খাঁটি দই আক্রান্ত স্থানে লাগাতে হবে। আবার নিয়মিত দই খেলেও ত্বকের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
৫. রসুন এর ব্যবহার- রসুন ইনফেকশনের বিরুদ্ধে কাজ করে। ২ কোয়া রসুন হালকা থেঁতো করে দুই চামচ সরিষার তেলে গরম করে আক্রান্ত স্থানে লাগাতে হবে। এভাবে এক সপ্তাহ লাগালে ত্বকের সমস্যা থেকে পরিত্রান পাওয়া যায়।
৬. নারিকেল তেল এর ব্যবহার- চুল থেকে ত্বক সকল সমস্যার সমাধান দেয় একটি মাত্র উপাদান সেটি হলো খাঁটি নারিকেল তেল। ফাঙ্গাল ইনফেকশন মোকাবেলা করতে এ তেল এর কোনো জুড়ি নেই।
এতে রয়েছে তিন ধরনের ফ্যাটি এসিড,ক্যাপ্রিক এসিড,ক্যাপ্রোলিক এসিড ও লরিক এসিড যা অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান হিসেবে কাজ করে। প্রতিদিন নিয়ম করে আক্রান্ত স্থানে নারিকেল তেলের প্রলেপ লাগালে দ্রুত ত্বকের রোগ থেকে আরোগ্য পাওয়া যায়।
৭. অ্যাপল সিডার ভিনিগার এর ব্যবহার- জীবানুর বিরুদ্ধে একটি প্রধান রক্ষক। নানা ধরনের ভাইরাস,ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া ও ফাঙ্গাস নিমিষেই পরাস্ত করতে অ্যাপল সিডার ভিনেগারের কোন জুড়ি নেই।
এতে আছে অ্যাসিটিক অ্যাসিড ক্ষতিকারক ফাঙ্গাস দূর করে। এতে আরো রয়েছে পেকটিন এসিড যা শরীরে কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করে ক্ষতিকারক ফাঙ্গাস নতুনভাবে বংশবৃদ্ধি থেকে শরীরকে রক্ষা করে।
এক চামচ অ্যাপল সিডার ভিনেগার ও তিন চামচ পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে তুলার সাহায্যে লাগাতে হবে। শুকিয়ে গেলে ঠান্ডা পানির সাহায্যে ধুয়ে নিতে হবে।
অথবা গোসলের সময় এক বালতি পানিতে ২ কাপ অ্যাপল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে নিতে হবে। যতদিন না ইনফেকশন কমে আসছে ততদিন গোসলের একটি প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতে হবে একে। এভাবে নিয়মিত ব্যবহারে ক্ষতিকারক ফাঙ্গাস ও জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়।
৮. টি-ট্রি অয়েল এর ব্যবহার- এই তেলে রয়েছে অনেকগুলো অ্যান্টিফাঙ্গাল কম্পাউন্ড যা শরীরের কোন স্থানে ফাঙ্গাস আক্রমণ হলে তা দ্রুত সারিয়ে তোলে।
১ অনুপাত ১ পরিমাণে টি-ট্রি অয়েল ও কাঠ বাদাম তেল মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগাতে হবে। অথবা ৩ অনুপাত ১ পরিমাণে টি-ট্রি অয়েল ও অ্যালোভেরা জেল’র মিশ্রণ আক্রান্ত স্থানে লাগাতে হবে। এভাবে ব্যবহার করলে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়।
পরিশেষে বলা যায়, ফাঙ্গাল ইনফেকশন আমাদের শরীরে হোক তা কখনোই কাম্য নয়। ত্বকের যত্ন নিতে হবে। ত্বক সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
আর শরীরে যদি কোন চর্মরোগ হয়েই যায় তাহলে সময় ক্ষেপন না করে দ্রুত নিকটস্থ কোন চর্ম বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেয়ার অনুরোধ রইলো। তবে উপরে বর্ণিত ঘরোয়া উপায়গুলোর মাধ্যমে আপনি যেকোন সময়ই চেষ্টা করতে পারেন।
আরও পড়ুন: চুল পড়ে যাওয়ার কারন এবং চিকিৎসা কি