প্রবাস জীবন কারও জন্য হয় সুখের আবার কারও জন্য দুঃখের। এটা আগে থেকে বলা যায় না যে কার ভাগ্যে কি আছে। কিন্তু যারা প্রবাসে গিয়ে কষ্ট করে বা শুধু কষ্টের সাগরে ভেসে বেড়ায় তাদের জীবনে মনে হয় বড় ধরণের কোনো পাপ ছিল আর তাই শাস্তি হিসেবে প্রবাসে গিয়ে কষ্ট করতে হচ্ছে। এমনটাই বলে অনেক প্রবাসী। প্রবাসী হাসান হয়তো এমনটাই ভেবেছিলেন।
বর্তমানে যদিও হাসান প্রবাসী নয় কিন্তু তার ডাক নাম বর্তমানে প্রবাসী হাসান। হাসান ২০১৫ সালে প্রবাসে পাড়ি জমায়। স্থানীয় এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের প্ররোচনায় তিনি প্রবাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
তখন হাসান এর পরিবারে ৪ জন সদস্য। কোনো ছেলে সন্তান নেই। কেবল ২টি মেয়ে আর হাসান ও তার স্ত্রী। হাসানের স্ত্রী কোনভাবেই তাকে বিদেশ যেতে দেবে না। গ্রামের বাড়িতে ভালোই চলছিল তার। অল্প কিছু কৃষি জমি ছিল। টুকটাক ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। এভাবেই ভালোই চলছিল।
কিন্তু হাসানের মাথায় যেন ভুত চেপেছিল। উপরে কোনো গার্ডিয়ান ছিল না। আর তাই হাসানের কথার বাইরে কেউ কিছু বলতে পারতো না। হাসানের মা তখন বেঁচে ছিল, অবশ্য এখনো বেঁচে আছে। কিন্তু মা তো মা-ই। হাসান তার মায়ের কথাও শুনে নি।
অনেক টাকা ইনকামের আশায় ৩ লক্ষ টাকা খরচ করে পাড়ি জমায় বিদেশে। হাসানকে মূলত ইরাকে পাঠানো হয়েছিল। আর ইরাক দেশটির পরিস্থিতি সেসময় মোটেও ভালো ছিল না। আর ইরাকের টাকার মূল্যও তেমন একটা ছিলো না। প্রবাসী হাসান এসব কোন কিছু না ভেবেই সে দেশে পাড়ি জমায়।
বাংলাদেশ থেকে সেদেশে যাওয়ার পর তাকে একটি বড় ঘরে বন্দি করে রাখা হয় কয়েকদিন। সেখানেও বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী দালাল ছিল। তারা হাসানকে সেই ঘর থেকে বের করে আরেক জায়গায় নিয়ে যায়। সেখানে হাসানের মতো আর কয়েকশ মানুষ। তারা সবাই পরিবারকে ভালো রাখার আশায় হাসানের মতো স্বপ্ন নিয়ে বিদেশের মাটিতে পা রেখেছিলো।
কিন্তু হাসান তখন বুঝতে পারলো যে, সে তার জীবনের সর্বস্ব হারিয়েছে। এখন জীবনটা ফিরে পায় কিনা সন্দেহ। সেখানে যারা ছিলো সবাইকে নিয়মিত মারধর করা হতো এবং বাড়ির সাথে যোগাযোগ করে কয়েক লক্ষ করে টাকা নিয়ে যেতে বলা হতো।
ফলশ্রুতিতে হাসানও তার বাড়ির সাথে যোগাযোগ করে এবং আরও কয়েক লক্ষ টাকা পাঠানোর অনুরোধ করে। নইলে তাকে মেরে ফেলা হবে।
গ্রামের বাড়ি থেকে টাকা পাঠানোর মতো পরিস্থিতি ছিলো না। তবুও হাসানের স্ত্রী ও ছোট ভাই এর সহযোগীতায় ব্যবস্থা করে প্রায় ৩ লক্ষ টাকা পাঠানো হয়। হাসান কোনমতে সেখান থেকে ছাড়া পায়।
এরপর হাসান এর জীবনে নেমে আসে আরও কষ্টের দিন। কোথায় যাবে, কোথায় একটা কাজ পাবে তা নিয়ে চলতে থাকে সংশয়। এক পর্যায়ে সামান্য একটা কাজের সুযোগ পায়। কিন্তু তা দিয়ে কেবল নিজের জীবনটা কোনভাবে চলবে। বাড়িতে কোন টাকা পাঠানো সম্ভব না।
হাসান তখন তো আর সেখানে থাকতে চাইছিলো না। সে শুধু দেশে ফিরে আসতে চাইছিলো কিন্তু সাহস করে বলতে পারেনি। কারণ, দেশে ফিরে আসতে গেলেও তার জন্য আরো কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করতে হবে। আর এ টাকা কে দেবে তাকে?
সব মিলিয়ে হাসান প্রায় পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিলো। পরে পরিবারের মানুষ যেভাবেই হোক সবকিছু জানতে পারছে। এরপর যোগাযোগ করে আরও টাকার ব্যবস্থা করে হাসানকে দেশের মাটিতে অনেক কষ্টে ফেরৎ আনা হয়।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, হাসানের ঐ দূর সম্পর্কের আত্মীয় মানচ পাচার চক্রের সাথে জড়িত এবং সে হাসানকে বিক্রি করে দিয়েছিল। সে হাসানের দেয়া সব টাকা আত্মসাৎ করেছে।
বর্তমানে হাসান তার নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছে। টুকটাক ব্যবসা-বাণিজ্য করছে এবং জীবন পরিচালনা করছে। তার দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়েও দিয়েছে।
পরিশেষে বলতে চাই, হাসানের মতো করে কেউ বিদেশ যাবেন না। গেলেও ভালো-মন্দ ভেবে যাবেন। কোন দেশে যাবেন সেটাও ভাবার বিষয়। কারণ, ভালো দেশে গেলে ভালো সাপোর্ট পাওয়া যায়। আর কার সাথে যোগাযোগ করে যাবেন সেটাও ভাবার বিষয়।
কখনোই যাকে তাকে বিশ্বাস করবেন না। কারণ, বিদেশে পাঠানোর নাম করে প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ কিন্তু বাটপারি করে। টাকা আত্মসাৎ করে। সুতরাং নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই সব ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করুন।
সামান্য কারণে আপনিও নিজেও হারিয়ে যেতে পারেন আর এতে করে আপনার পরিবারকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাস্তায় নামতে হবে। আর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হলে কখনোই বিদেশ যাওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে যাবেন না। সবাই ভালো থাকুন আর সুস্থ্য সুন্দর জীবন উপভোগ করুন। মনে রাখবেন, ভিন দেশে লাখ টাকা কামানোর চেয়ে নিজের দেশে হাজার টাকা কামানো এবং পরিবারের সবার সাথে থাকা অনেক সুখময় – যদি আপনি মনে করেন।
আরও পড়ুন: প্রবাস জীবন কতোটা কষ্টের তা এই গল্প থেকে জানা যায়।