প্রথম আলো বা দৈনিক প্রথম আলো একটি সংবাদ পত্র যা শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বের মধ্যে সুপরিচিত। প্রতিদিন অসংখ্য খবর ও তথ্য এখানে প্রকাশিত হয়।
প্রথম আলো পত্রিকাটি প্রথম অবস্থায় অফলাইন ছিলো। এখন অনলাইনেও চলে এসেছে। গুগল প্লে স্টোর থেকে প্রথম আলো অ্যাপটি যদি মোবাইলে ইন্সটল করে নেন তবে পেয়ে যাবেন প্রতি মুহূর্তের খবর।
আজ আমরা এই পত্রিকাটির আদ্যোপান্ত জানবো। কিভাবে এর সূচনা হয়েছিল, এতোদূর আসতে কতোটা কাঠ-খড় পোহাতে হয়েছে এবং বর্তমানে কারা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে সবই জানবো। তো আর কথা নয় – সরাসরি যাচ্ছি মূল আলোচনায়।
দৈনিক প্রথম আলো বাংলাদেশ থেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একটি দৈনিক সংবাদপত্র। ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি বর্তমানে অনলাইন এবং অফলাইনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্র।
দৈনিক প্রথম আলো ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বরে প্রথম প্রকাশিত হয়। তখন কেউ জানতো না যে, এই পত্রিকাটিই হবে দেশের সহ বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদ পত্র।
২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে রেমন ম্যাগসেসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ মতিউর রহমান এ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি এ পত্রিকাটির প্রকাশক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
পত্রিকাটি সামাজিক আন্দোলনের সংকেত হিসাবে প্রথমে যে শ্লোগানটি আপ্ত করে তা হলো “যা কিছু ভালো তার সঙ্গে প্রথম আলো”।
২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে তা পরিবর্তন করে “বদলে যাও, বদলে দাও” শ্লোগানটি গ্রহণ করা হয়। ২০১৩ সালে প্রথম আলোর ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নতুন স্লোগান করা হয় “পথ হারাবে না বাংলাদেশ”। ২০১৮ সালে ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে স্লোগান হয় “ভালোর সাথে আলোর পথে”।
২০২১ সালে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে আটক করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় গোপন নথি ‘চুরির চেষ্টা’ অভিযোগ এনে তাঁকে সচিবালয়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়।
পরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের একজন কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক গোপনীয়তা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর তাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
২৩ মে ২০২১ সালে আদালতে পাসপোর্ট জমা রাখার শর্তে ৫ হাজার টাকা মুচলেকায় মুক্তি পান রোজিনা ইসলাম। এই ঘটনায় সারাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে উৎকণ্ঠার সঞ্চার হয়েছিল।
প্রথম আলো ব্রডশিট আকারে মুদ্রিত হয়। এতে বাদামি নিউজপ্রিন্ট কাগজ ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে কলাম সংখ্যা ৬ (পূর্বে ছিল ৮)। নিয়মিত সংখ্যা ২০ পৃষ্ঠা। সপ্তাহে চার দিন মূল ব্রডশিট পত্রিকার সঙ্গে ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়।
প্রথম আলোর নিয়মিত আয়োজনে থাকে- সংবাদ, সম্পাদকীয়, খবর, আন্তর্জাতিক, খেলাধুলা, বিনোদন, পড়াশোনা, মতামত, অর্থ-বাণিজ্য, টেক বার্তা।
ফিচারপাতা হিসাবে আছে- শনিবারে “প্র-ছুটির দিনে”, রোববারে “প্র-স্বপ্ন নিয়ে” ও “বন্ধুসভা”, সোমবারে “প্র-বাণিজ্য” ও মূল পাতায় “গোল্লাছুট”, মঙ্গলবারে “প্র-নকশা”, বুধবারে “প্র-অধুনা”, বৃহস্পতিবারে “প্র-আনন্দ” এবং শুক্রবারে “প্র-অন্য আলো”।
এছাড়া শুধুমাত্র চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাঠকদের জন্য সপ্তাহে তিনদিন প্রকাশ হয় “আমার চট্টগ্রাম”। প্রতিদিনই মূল কাগজে থাকে উত্তরাঞ্চলের পাঠকদের জন্য “রংপুর”, “বগুড়া” এবং “রাজশাহী” নামে বিভিন্ন আঞ্চলিক আয়োজন।
প্রথম আলো’র অনেক পাঠক প্রিয় ফিচার পাতা বন্ধ হয়ে গেছে। যেমন: “রস+আলো”, ঢাকার পাঠকদের জন্য “ঢাকায় থাকি” ইত্যাদি। এগুলো বন্ধ হওয়ার পেছনে তেমন কোনো কারণ ছিলো না।
সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও প্রথম আলো জড়িত আছে। এর মধ্যে রয়েছে এসিড সন্ত্রাস রোধ, মাদকবিরোধী আন্দোলনসহ নানা আয়োজন।
পাশাপাশি কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনাও রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন অলিম্পিয়াড আয়োজনেও এই প্রতিষ্ঠান সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
তরুনদের সমাজসেবায় উৎসাহ দিতে আছে “বন্ধুসভা” নামের তরুনদের জন্য সংগঠন। এছাড়া জরুরি জাতীয় আপৎকালীন সময়ে প্রথম আলো ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
সকল অর্থ আসে পাঠক-পাঠিকাদের আর্থিক অবদান থেকে। আর এ জন্য স্থাপন করা হয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট।
প্রথম আলোর নানা ধরনের সামাজিক কাজের মধ্যে গণিত অলিম্পিয়াড অন্যতম। প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে গণিত অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয়।
জাতীয় পর্যায়ে গণিত অলিম্পিয়াড শেষে সেরা নির্বাচিতরা অংশ নেন আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে (আইএমও)। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সেরা নির্বাচিতদের পুরস্কৃত করা হয়।
ভাষা প্রতিযোগ ২০০৫ সাল থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসা একটি ভাষা বিষয়ক প্রতিযোগিতা যেখানে চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে।
প্রথম আলো এবং এইচএসবিসি ব্যাংকের যৌথ ব্যবস্থাপনায় এই প্রতিযোগে এক ঘণ্টার পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবের সভাপতি আনিসুজ্জামান।
এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০০ স্কুলের ৬০,০০০+ শিক্ষার্থী এতে অংশ নিয়েছে। সাধারণত প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে এ প্রতিযোগের আঞ্চলিক পর্যায়ের আয়োজন করা হয়। এরপর মে-জুন মাসে জাতীয় পর্যায়ের আয়োজন হয়।
কিশোর আলো বাংলাদেশের একটি শিশু কিশোর প্রধান ম্যাগাজিন। ২০১২ সালে প্রথম আলো কিশোর নববর্ষ সংখ্যা ১৪১৯ প্রথম প্রকাশিত হয়।
এরপর ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় প্রথম আলো কিশোর নববর্ষ সংখ্যা ১৪২০। এরপর ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে এটি নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
ম্যাগাজিনটি (শিশুতোষ) শিশু-কিশোরদের জন্য বিভিন্ন বিষয় ছাপিয়ে থাকে। প্রতিমাসের ৫ তারিখে ম্যাগাজিনটি প্রকাশিত হয়।
বিজ্ঞানচিন্তা দৈনিক প্রথম আলো কর্তৃক প্রকাশিত একটি বিজ্ঞান সাময়িকী। দেশের মানুষকে বিজ্ঞানমনষ্ক করার উদ্দেশ্যে ১৫ই অক্টোবর ২০১৬ থেকে “বিজ্ঞানচিন্তা” যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে প্রতি মাসের ১৫ তারিখ এটি প্রকাশিত হয়।
প্রথম আলো ২০২২ সালে ‘গ্লোবাল মিডিয়া অ্যাওয়ার্ডস ২০২২’-এর ন্যাশনাল ব্র্যান্ড বিভাগে ‘বেস্ট ইউজ অব প্রিন্ট’ ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান এবং ‘বেস্ট আইডিয়া টু গ্রো অ্যাডভার্টাইজিং সেলস’ ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে।
পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যাওয়া সাপ্তাহিক রম্য ম্যাগাজিন আলপিন ২০০৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় বিড়ালের নামের আগে ইসলামিক নাম মোহাম্মদ ব্যবহার নিয়ে একটি কার্টুন ছাপায়।
এর ফলে বাংলাদেশী মুসলিম সংগঠনগুলো আন্দোলন ও রাজনৈতিক চাপ তৈরি করে। পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আলপিনের ৪৩১তম সংখ্যাটির বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ও কার্টুনিস্টকে গ্রেফতার করে।
প্রথম আলোর সম্পাদক জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের তৎকালীন খতিব উবায়দুল হক এর কাছে ক্ষমা ও দুঃখ প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে আলপিনের আদলে “রস+আল” নামক আরেকটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হয়।
২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুরের রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্যাম্পাসে কিশোর আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উৎসব চলছিল।
ওই অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঐ স্কুলেরই নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাইমুল আবরার নিহত হয়। ঘটনাটি তদন্ত করে পুলিশ আদালতে চার্জশিট দাখিল করে যেখানে কিশোর আলো কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলার কারণে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঘটনা উল্লিখিত হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি আদালত প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হকসহ দশজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পরবর্তীতে তা সমাধান হয়ে যায়।
পরিশেষে বলা যায়, প্রথম আলো সংবাদ পত্রটি আছে বলেই মানুষ সঠিক সময়ে সঠিক তথ্যগুলো পাচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ে এমন একটি পত্রিকা সবসময়ই প্রয়োজন।
প্রথম আলো কোনো ভুয়া খবর বা তথ্য প্রকাশ করে না। পত্রিকাটির জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত তেমন কোনো তথ্য বিভ্রাট পরিলক্ষিত হয়নি।
সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি সামাজিকভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম পত্রিকাটিকে আরও অনন্য উচ্চতায় নিচে গিয়েছে। বিশ্বের মধ্যে প্রথম আলো এক নম্বর পত্রিকা হিসেবে থাকবে কোনদিন – এটাই প্রত্যাশা।
আরও পড়ুন: বিএনপি এর সাথে পুলিশের সংঘর্ষের কারণ কি? কি হতে যাচ্ছে দেশে?
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া (সামান্য পরিমার্জিত)