পাইলস বা অর্শ রোগের আসলে কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নাই। মোট কথা, পায়খানার রাস্তা ফুলে যাওয়া, ব্যথা করা, রক্ত পড়া, ফেটে যাওয়া, মাংস খন্ড বেরিয়ে পড়া ইত্যাদিকে একত্রে পাইলস অর্শ রোগ বলে। ইহার মতো কষ্টদায়ক রোগ মনে হয় মানুষের জীবনে কমই আছে।
একে তো পায়খানার সময় ব্যথার চোটে জান বেরিয়ে যাওয়ার জোগার তারপর আবার বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ ভদ্র সমাজে রক্তক্ষরণ হয়ে কাপড়-চোপড় নষ্ট হয়ে ইজ্জত নিয়ে টানাটানি।
পাইলস হওয়ার মূল কারণ হলো দীর্ঘদিন কোষ্ঠকাঠিন্য বা পায়খানা শক্ত থাকা। পাইলসের আরেকটি কারণ হলো তলপেটের ভেতরে থাকা রক্তনালীর গঠনগত ত্রুটি।
সামান্য কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চললে যেমন পায়খানা নরম রাখা অর্থাৎ কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে দূরে থাকা এবং দু-চার ছয় মাস হোমিও ঔষধ খেলে পাইলস পুরোপুরি সেরে যায়।
সেটা যতো বড় মারাত্মক পাইলস রোগ হোক না কেন। তবে যাদের পাইলসের টেনডেনসি আছে, তাদেরকে সারাজীবনই সতর্ক থাকতে হবে যাতে পায়খানা কোন অবস্থাতেই শক্ত হতে না পারে।
অনেকেই না জানার কারণে অপারেশন করে পাইলস সারাতে চেষ্টা করেন কিন্তু এতে আপনি নির্ঘাত পায়খানার রাস্তায় ক্যানসারে আক্রান্ত হবেন।
পাইলসের চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য:
পাইলসের চিকিৎসায় প্রথম কথা হলো যদি কোষ্ঠকাঠিন্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন অর্থাৎ পায়খানা নরম রাখতে পারেন, তবে ৯৯% পাইলস বিনা ঔষধেই সেরে যাবে। আর কোষ্ঠকাঠিন্য চিরতরে নির্মূল করার জন্য কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য যে হোমিও ঔষধগুলো নির্ধারিত সেগুলো সেবন করতে হবে।
অনেক হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানী পাইলসের রোগীদেরকে সকালে Sulphur এবং সন্ধ্যায় Nux Vomica ঔষধ দুইটি খেতে দিতেন।
সাধারণত ৩০ শক্তিতে কয়েক মাস খেলে অধিকাংশ পাইলস ভালো হয়ে যায়। অন্য কোন ঔষধের প্রয়োজন হয় না। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অবশ্যই ঔষধ সেবন করতে হবে।
এই ঔষধ দুটি সরাসরি পাইলস নিরাময় করে না কোষ্ঠকাঠিন্য সারানোর মাধ্যমে এরা পাইলস নির্মূল করে থাকে। এমনকি কোন কোন চিকিৎসা বিজ্ঞানী এমনও বলেছেন যে, সালফার, নাক্স ভমিকা এবং থুজা মাত্র এই তিনটি ঔষধ দিয়ে পৃথিবীর এমন কোন রোগ নাই যা সারানো যায় না (সুবহানাল্লাহ)।
এই কথার রহস্য কি? আসলে আমাদের শরীরে যত রকমের বিষ তৈরী হয় এবং যত রকমের বিষ বাইরে থেকে ঢুকে, তাদের শরীর থেকে বের করার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো পায়খানা।
ঢাকা শহরের সমস্ত ড্রেন এবং সোয়ারেজ লাইনগুলি যদি সাতদিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে যেমন সমস্ত শহরের পরিবেশ দূষিত-বিষাক্ত হয়ে অগণিত মারাত্মক রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়বে, তেমনি যেসব মানুষের নিয়মিত পায়খানা হয়না তাদেরও ধীরে ধীরে শরীর বিষাক্ত হয়ে হৃদরোগ, কিডনীর রোগ, স্নায়ুরোগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিস সহ ইত্যাদি মারাত্মক রোগ পয়দা হতে থাকে। আর এই তিনটি ঔষধই মোটামুটি কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য শ্রেষ্ঠ ঔষধ।
যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য খুবই জটিল, সারতেই চায় না, তারা অবশ্যই কোষ্ঠকাঠিন্য বিষয়ে নিম্নে বর্ণিত ঔষধগুলো চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অবশ্যই গ্রহণ করবেন।
Calendula Officinalis: পায়খানার রাস্তা যদি মাত্রাতিরিক্ত ফুলে যায়, ইনফেকশন হয়ে যায়, ঘায়ের মতো হয়ে যায়, ব্যথায় টনটন করতে থাকে, তবে ক্যালেন্ডুলা ঔষধটি নিম্নশক্তিতে (মাদার টিংচার) কিছু পানির সাথে মিশিয়ে তাতে তুলা ভিজিয়ে সেখানে দু-চার ঘন্টা পরপর প্রয়োগ করুন।
দু-চার ঘণ্টা পরপর বা অথবা আরো ঘনঘন প্রয়োগ করুন। যত মারাত্মক ইনফেকশান বা ফোলা-ব্যথা-আলসার হোক না কেন, দেখবেন দুই-এক দিনের মধ্যে সব চলে গেছে।
এলোপ্যাথিতে যেমন ডেটল, স্যাভলন, হেক্সিসল ইত্যাদি আছে, তেমনি হোমিওপ্যাথিতে আছে ক্যালেন্ডুলা। তবে ক্যালেন্ডুলার ক্ষমতা তুলনাবিহীন।
আক্রান্ত স্থানে লাগানোর পাশাপাশি দশ-বিশ ফোঁটা করে খেতেও পারেন। অথবা লক্ষণ মতে অন্য কোন ঔষধ খান। পাশাপাশি যেকোন ধরনের কাটা-ছেড়া-ঘা-ইনফেকশনে ক্যালেন্ডুলার সাহায্য নিতে ভুলবেন না যেন।
পাইলস থেকে উজ্জল লাল রঙের রক্তপাত হলে Millefolium ঔষধটি দশ-বিশ মিনিট পরপর খেতে থাকুন। যতক্ষণ না রক্তপাত বন্ধ হয়।
অন্যদিকে কালো কালচে রক্তপাত হলে Hamarmelis Virginica ঔষধটি দশ-বিশ মিনিট পরপর খেতে থাকুন। পায়খানার রাস্তা
থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে শরীর দূর্বল হয়ে পড়লে, রক্তশূন্যতা দেখা দিলে China Officinalis অথবা Acidum Phosphoricum ঔষধটি খান। পাশাপাশি ভিটামিন জাতীয় অন্যান্য ঔষধগুলোও খেতে পারেন।
Aesculus Hippocastanum: এসকিউলাসকে বলা যায় সবচেয়ে সেরা পাইলসের ঔষধ। এই ঔষধের কাজের মূল কেন্দ্র হইল তলপেটের যন্ত্রপাতি।
ইহার প্রধান প্রধান লক্ষণ হলো কোষ্ঠকাঠিন্য (পায়খানার সাইজ বড় বড় এবং শক্ত) রক্তক্ষরণযুক্ত অথবা রক্তক্ষরণবিহীন পাইলস, পায়খানার রাস্তায় কেহ আলপিন দিয়ে খোঁচা মারছে এমন ব্যথা, পায়খানার রাস্তা শুকনা শুকনা লাগা, তলপেটে দূর্বলতা, পায়ে অবশ অবশ ভাব, হাটলে রোগের মাত্রা বেড়ে যায় এবং রোগী খুবই বদমেজাজি ইত্যাদি।
ঔষধ নিম্নশক্তিতে খেলে রোজ দুই-তিন বার করে খাবেন আর উচ্চ শক্তিতে খেলে দশ-পনের বিশ দিন পরপর এক মাত্রা করে খাবেন।
Collinsonia Canadensis: ইহার প্রধান প্রধান লক্ষণ পেট এবং পায়খানার রাস্তার অসুখের সাথে মাথাব্যথা, নাভী এবং তলপেটে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য, কোথানি, অবসন্নতা, আম ও রক্তযুক্ত পায়খানা, মাসিকের সময় পাইলস, পায়খানার রাস্তার মাংস বেরিয়ে পড়া রোগের লক্ষণ শরীরের ওপর থেকে নীচের দিকে যায়, হার্টের সমস্যা এবং পাইলসের রক্তক্ষরণ ঘুরে-ফিরে আসে, বিভিন্ন জয়েন্টের বাতের ব্যথা, বুকে ব্যথা ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই এই ঔষধ সেবন করুন।
Aloe Socotrina: এলো সকোট্রিনার প্রধান প্রধান লক্ষণ কোষ্ঠকাঠিন্য, পেট, তলপেট এবং মাথায় রক্তসঞ্চয়, অদল-বদল করে মাথাব্যথা এবং কোমরের বাত, শীতকালে পাইলসের উৎপাত বৃদ্ধি পায়, দূর্বলতা, খাওয়ার পরপরই পায়খানার বেগ হওয়া, শক্ত পায়খানা (ঘুমের মধ্যে) নিজের অজান্তেই বিছানায় পড়ে থাকে, পাইলেসের চেহারা দেখতে আঙুরের থোকার মতো, সারাক্ষণ নীচের দিকে ঠেলামারা ব্যথা, রক্তক্ষরণ, টনটনে ব্যথা, স্পর্শ করা যায় না, গরম, ঠান্ডা পানিতে আরাম লাগে ইত্যাদি।
Peonia Officinalis: পিওনিয়ার প্রধান প্রধান লক্ষণ হলো পায়খানার রাস্তায় জ্বালাপোড়া, চুলকানি, ফুলে যাওয়া, (বিছানা-জুতার) চাপ থেকে ঘা হওয়া, পায়খানার রাস্তার ফোড়া, ফেটে যাওয়া (Fissure), ভগন্দর (Fistula), রক্তনালী ফোলে যাওয়া (Varicose Veins), ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখা (Nightmare), নড়াচড়া-হাঁটা-স্পর্শে রোগের কষ্ট বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
Nitricum Acidum: নাইট্রিক এসিডের প্রধান প্রধান লক্ষণ হলো কোষ্ঠকাঠিন্য, (শক্ত হোক বা নরম) পায়খানার পরে ব্যথা, মেজ, প্রস্রাবের গন্ধ গরুর প্রস্রাবের মতো খুবই কড়া, আবহাওয়া পরিবর্তন হলেই অসুস্থ্য হয়ে পড়ে, শরীরের ছিদ্রযুক্ত স্থানের ক্ষত, খিটখিটে মেজাজ, ঘন-ঘন ডায়েরিয়ায় ভোগে, চোখের নালী ক্ষত, রাতের বেলা হাড়ের ব্যথা, হাড়ের ক্ষত, যেকোন ঘা বা ক্ষত সহজে সারতে চায় না, শরীরে পানির পরিমাণ বেশী ইত্যাদি।
Muriaticum Acidum: মিউরিয়েটিক এসিডের প্রধান প্রধান লক্ষণ হলো কান্ডজ্ঞান লোপকারী মাথাব্যথা, চোখে অন্ধকার এবং উল্টা-পাল্টা দেখা, অনিচ্ছাকৃতভাবে পায়খানা-প্রস্রাব বেরিয়ে যাওয়া, প্যারালাইসিস, পাইলসে বা পায়খানার রাস্তায় জ্বালাপোড়া, মাঝারি বা মারাত্মক ধরনের ইনফেকশন, পূজঁ-নিঃশ্বাস-শরীরের গন্ধ সবই দূর্গন্ধযুক্ত, পাইলস দেখতে আঙুরের থোকার মতো, পিতল বর্ণের, স্পর্শ করলে জ্বালা করে, কোথানি দিলে আলিশ বেরিয়ে যায়, জিহ্বায় ইনফেকশন সহ ইত্যাদি।
Sepia Officinalis: সিপিয়ার প্রধান প্রধান লক্ষণ হলো পেশা এবং পরিবারের লোকজনদের প্রতিও উদাসীনতা, রোগের গতি শরীরের নীচে থেকে উপরের দিকে, রোগী সবর্দা শীতে কাঁপতে থাকে, পেটের ভিতরে চাকার মতো কিছু একটা নড়াচড়া করছে মনে হওয়া, পাইলস, পায়খানার রাস্তা বা জরায়ু ঝুলে পড়া (Prolapse), খাওয়া-দাওয়া ভালো লাগে না, পায়খানার রাস্তা ভারী মনে হয়, শিশুরা ঘুমানোর সাথে সাথেই বিছানায় প্রস্রাব করে দেয়, মুখের মেছতা (Chloasma), পুরুষাঙ্গের মাথার চারদিকে গোটা (Condylomata), ঘনঘন গর্ভপাত (Abortion), যৌনাঙ্গে এবং পায়খানার রাস্তায় ভীষণ চুলকানি, দীর্ঘদিনের পুরনো সর্দি, অল্পতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে, দুধ হজম করতে পারে না, স্বভাবে কৃপন-লোভী, একলা থাকতে ভয় পায় ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা যায়, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় প্রথমেই আপনার বিশ্বাস থাকতে হবে। বিশ্বাসে বস্তু মিলে। পাইলস রোগের জন্য সম্পূর্ণরুপে আপনি হোমিওপ্যাথির উপর নির্ভর করতে পারেন।
অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ এবং ভালো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। পাইলস রোগটি খুব খারাপ প্রকৃতির রোগ। মানুষকে খুব কষ্ট দেয় এই রোগটি। তাই অবহেলা না করে রোগ লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করুন।
আরও পড়ুন: ঘুমের জন্য ১০০% কার্যকরী হোমিও ঔষধ সম্পর্কে তথ্য।