নিউমোনিয়া ও ব্রংকোলাইটিস রোগ:
নিউমোনিয়া ও ব্রংকোলাইটিস রোগ সাধারণত শীতকালে বেড়ে যায়। এ সময় ছোট বাচ্চারা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সময় পার করে।
শীতের পুরো সময়টা শিশুদের জন্য বয়ে আনতে পারে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি। তাই রোগ লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নেয়া প্রয়োজন। আজ আমরা নিউমোনিয়া ও ব্রংকোলাইটিস রোগ দুটি নিয়ে বিস্তারিত জানবো।
নিউমোনিয়া:
নবজাতকের ক্ষেত্রে প্রতি মিনিটে ৬০ বার, যাদের বয়স ১ বছর তাদের প্রতি মিনিটে ৫০ বার এবং ১ থেকে ৩ বছরের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্রতি মিনিটে ৪০ বার শ্বাস-প্রশ্বাস ঘটলে বুঝতে হবে নিউমোনিয়ার লক্ষণ কিংবা নিউমোনিয়া হয়েছে।
সাধারণত নিম্নোক্ত লক্ষণসমুহ দেখা যাবে:
- বুকে যে পাজর রয়েছে সেখানটায় দেবে যাবে – এরকমটা মনে হবে।
- শ্বাস নেয়ার সাথে সাথে নাকের ডগা ফুলে যাবে।
- বাচ্চাদের শরীরে ক্লান্তি ও অসুস্থ্যতার ভাব প্রকট আকার ধারণ করবে।
- শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। কোন কোন সময় তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে যাবে।
- কাশি হবে এবং তা রাত্রের মধ্যভাগে ও শেষভাগে বেশি হবে।
- মধ্য বয়সী বাচ্চাদের কফ হতে পারে কিন্তু নবজাতকের ক্ষেত্রে তা হবে না।
- বুকে মাথা রাখলে ঘড়-ঘড় আওয়াজ শোনা যাবে।
- শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণত স্ট্রেপটোকক্বাস, হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা ও স্ট্যাফাইলো কক্বাস জীবাণুগুলো আক্রান্ত করে থাকে। তবে কিছু ভাইরাসও জড়িত থাকে।
প্রতিরোধ হিসেবে যা করবেন:
- শ্বাস-কষ্ট যদি খুব বেশি হয় তাহলে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। বাড়িতে নিয়ে বসে থাকা উচিত হবে না। অনেকেই তেল মালিশ করে ক্ষান্ত থাকেন। ভুলেও এমন কাজ করবেন না। আর তিন মাসের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে শরীর যদি বার বার নীল হয়ে আসে তবে হাসপাতালে দ্রুত নিয়ে যাবেন।
- সমস্যা প্রকট আকার ধারণ না করলে বাড়িতেই পারিবারিক শিশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করাতে পারেন।
- শ্বাস-কষ্ট যদি খুব বেশি না হয় তবে হাসপাতালে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাসায়-ই চিকিৎসা করাতে পারেন।
বাসায় চিকিৎসার ক্ষেত্রে যা করবেন:
- বাচ্চার জ্বর কমানোর জন্য সিরাপ প্যারাসিটামল (নাপা, এইস ইত্যাদি) ব্যবহার করুন। ওজন অনুযায়ী ১৫ মি.গ্রা/কেজি ব্যবহার করবেন। দিনে ৪ বার কিংবা উর্ধ্বে ৬ বার পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারেন। প্যারাসিটামল দেওয়ার আধা ঘণ্টা পর কুসুম গরম পানি দিয়ে আধা ঘণ্টা ধরে গা, হাত, পা ও মাথা মুছে দিতে ভুলবেন না যেন।
- একান্ত প্রয়োজনে এন্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। তবে এই বয়সের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সাধারণত অ্যামোক্সিসিলিন অথবা তৃতীয় জেনারেশন সেফিক্সিম গ্রুপের কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, অ্যান্টিবায়োটিক অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শেই ব্যবহার করতে হবে। নাক ও গলা বাল্ব সাকার দিয়ে পরিষ্কার করলে উপকার পাওয়া যায়।
- নাকে নরমাল স্যালাইন ড্রপ ব্যবহার করবেন। প্রতিবার ১ ফোঁটা করে ২ নাকে ৪ বার বা ৬ বার ব্যবহার করুন। এতে নাসিকা পথ পরিষ্কার থাকবে। শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হবে না।
- শ্বাস-টান বা বুকের আওয়াজের জন্য সিরাপ স্যালবিউটামল বা নেবুলাইজেশন মেশিনে বাষ্পায়িত স্যালবিউটামল ব্যবহার করা যায়। আপনার আশপাশে যেকোন ভালো মানের ফার্মেসীতেই আপনি এই সেবা পাবেন।
ব্রংকোলাইটিস:
ব্রংকোলাইটিস রোগের জীবাণু হলো রেসপিউরেটরি সিনটাইটিয়াল ভাইরাস (Respiratory Syncytial Virus) সংক্ষেপে আরএসভি (RSV)।
তবে ইনফ্লুয়েঞ্জা, প্যারা ইনফ্লুয়েঞ্জা, এডিনো ও রাইনো ভাইরাসও কখনো কখনো এ রোগ সৃষ্টি করে থাকে। হেমন্তের শেষ থেকে বসন্তের শুরু অবধি দুই বছরের কম বয়সের শিশুদের শ্বাসতন্ত্রের এ সংক্রমণ দেখা যায়।
সাধারণত নিম্নোক্ত লক্ষণসমুহ দেখা যাবে:
- ব্রংকোলাইটিস হলে নিউমোনিয়ার মতো বাচ্চা অতটা অসুস্থ্য হবে না। বাচ্চা বেশির ভাগ সময়ই হাসি-খুশি থাকবে কিন্তু বুকে বাঁশির মতো আওয়াজ থাকবে। বুকে মাথা রাখলেই বুঝতে পারবেন।
- শরীরের তাপমাত্রা অল্প বাড়বে। ১০০ থেকে ১০১ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। প্রথমে নাক দিয়ে পানি পড়ে তারপর দুই এক দিনের মধ্যেই শ্বাস-কষ্ট শুরু হয়।
- ব্রংকোলাইটিস সাধারণত রেসপিরেটরি ভাইরাস দিয়ে বেশি হয়। তবে অন্য ভাইরাস যেমন ইনফুয়েঞ্জা, প্যারা ইনফুয়েঞ্জা, এ্যাডিনো ভাইরাস দিয়েও হতে পারে (প্রথম প্যারায় উল্লেখ করা হয়েছে)।
- ব্রংকোলাইটিস ২ মাস থেকে ২ বছর বয়সী বাচ্চাদের বেশি হয়। তবে ৬ মাস থেকে ৯ মাস বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এর প্রকোপ বেশি হতে পারে।
প্রতিরোধ হিসেবে যা করবেন:
- সমস্যা প্রকোপ না হলে বাসায় রেখে চিকিৎসা করাতে পারেন। অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই ওষুধ খাওয়াবেন।
- বাচ্চার নাক ও গলা পরিষ্কার রাখতে হবে। প্রয়োজনে বাল্ব সাকার ব্যবহার করতে পারেন পরিষ্কার করার জন্য।
- এ সময় বাচ্চাকে বেশি করে তরল খাবার খাওয়াতে হবে। তরল খাবার খাওয়ালে বাচ্চার শরীর ভালো থাকবে। মল-মূত্র স্বাভাবিক থাকবে।
- নাকে নরমাল স্যালাইন ড্রপ ব্যবহার করতে পারেন।
- সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে বাচ্চার বয়স যদি ৩ মাসের নিচে হয় তবে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে। যদি নতুন করে বুকে বাড়তি প্রদাহ হয় বা তাপমাত্রা অল্প সময়ে অনেক বেশি বৃদ্ধি পায় তবে অবশ্যই অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে।
আরও পড়ুন: বুক জ্বালা পোড়া রোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা জেনে নিন।
- শ্বাস-কষ্টের জন্য সিরাপ স্যালবিউটামল বা বাষ্পায়িত স্যালবিউটামল ব্যবহার করা যেতে পারে যেমনটা নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে।
- জ্বরের জন্য সিরাপ প্যারাসিটামল (নাপা, এইস ইত্যাদি) ব্যবহার করতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে, বাচ্চার বয়স যদি ৩ মাসের নিচে হয় বা বাচ্চা যদি বহুদিন ধরে অ্যান্টি-ক্যান্সার জাতীয় ওষুধ খায় কিংবা বাচ্চা অন্য কোন রোগের কারণে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খায় সেক্ষেত্রে ব্রংকোলাইটিস আরো খারাপ হতে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই দ্রুত সময়ে হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত।
নিউমোনিয়া এবং ব্রংকোলাইটিস দুুটোই বাচ্চাদের জন্য ভয়াবহ রোগ। কারণ, একটু অবহেলার কারণে বাচ্চার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আর শীতকালে বাচ্চাকে অনেক সাবধানে রাখতে হবে।
বাচ্চার শরীরে যাতে ঠাণ্ডা না লাগে সেদিকে গভীর মনোযোগ রাখতে হবে। আর কোন কারণবশতঃ যদি নিউমোনিয়া বা ব্রংকোলাইটিস হয়েই যায় তবে অবশ্যই অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাওয়াবেন।