বিভিন্ন হাদিস দেখিয়ে দাবি করা হয় যে, আয়েশা (রা.) এর বয়স যখন ৯ বছর ছিল তখন নবী সা: তাঁর সাথে সহবাস করেছিলেন। এহেন দাবি করে ইসলামের শত্রুরা নবী সা: কে শিশুকামী (Pedophile) বলার স্পর্ধা দেখায় (নাউযুবিল্লাহ)।
এই লেখাটিতে একটি ভাষাগত আলোচনার মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করা হবে যে উক্ত হাদিসগুলোতে আসলেই এমন কিছু বলা হয়েছে, নাকি অন্য কিছু বোঝানো হয়েছে।
এই মর্মে যেই হাদিসগুলো দেখানো হয়, তার প্রায় সবগুলোরই মুল রূপ কিছুটা এমন:
“আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন আমি যখন ৬ বছর বয়সী ছিলাম তখন রাসুল (ﷺ) আমাকে বিয়ে করেন, এবং আমি যখন ৯ বছর বয়সী ছিলাম তখন তিনি (নবী সা:) আমার সাথে সহবাস (যেই অর্থটা প্রচার করা হয়) করেন।
” বর্ণনাটির কিছু রেওয়ায়েতে আয়েশা (রা.) “তৃতীয় ব্যাক্তি”(Third person) হিসেবে এসেছেন, এবং বাচনভঙ্গী ও শব্দের ছোটখাটো পার্থক্যের বিবেচনায় এই হাদিসটির একাধিক রেওয়ায়েত রয়েছে …
এ সংক্রান্ত হাদিসের ইংরেজি অনুবাদে Consumate শব্দটি দেখেও অনেকে ধারণা করেন এখানে মূল আরবিতে সহবাসের কথা বলা হয়েছে।
প্রথমত, হাদিসগুলোর যেসব বর্ণনা হতে দাবি করা হয় তিনি (রা. ) এখানে “সহবাসের ” কথা উল্লেখ করেছেন, সেইসব বর্ণনায় “البناء ب”(আল-বানা বি) এবং “الدخول ب”(আদ-দুখুল বি) , এই দু’টি কথা ব্যবহৃত হয়েছে। “আল-বানা বি” ও “আদ-দুখুল বি” হলো একে অপরের “সমার্থক, পরিপুরক”, যেমনটা আবুল-ফারাজ ইবনুল যাওযি (র.) লিখেছেন।
এখন “الدخول ب” (আদ-দুখুল বি) কথাটির দুইটি অর্থ হয়। একটা হলো “বিয়ে করে সহবাস করা” এবং আরেকটা হলো “শুধুমাত্র স্বামী স্ত্রীর মাঝে একটি নির্জন স্থানে সাক্ষাত হওয়া, যেখানে তারা দুজন ব্যাতিত আর কেউই নেই।” আর পুর্বেই বলেছি, “البناء ب”(আল-বানা বি) হলো “الدخول ب “(আদ-দুখুল বি) এর “সমার্থক,পরিপুরক”।
এই পর্যন্ত এসে দেখা যাচ্ছে যে, আয়েশা (রা.) এর হাদিসের “আদ-দুখুল বি” ও “আল-বানা বি” কথাটির দুইটি অর্থ হতে পারে। হয় আয়েশা (রা.) এর দ্বারা “সহবাস” বুঝিয়েছেন, আর নাহয় তিনি তাঁর জীবনের প্রথমবার “রাসুল (ﷺ) এর সাথে নির্জনে সাক্ষাত হওয়ার ব্যাপারটি” বুঝিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো সঠিক কোনটা? এ দু’টি অর্থের মধ্যে তিনি আসলে কি বুঝিয়েছেন? সেটাই এখন নির্ণয় করতে হবে, বের করতে হবে।
“আদ-দুখুল বি” ও “আল-বানা বি” এই কথা দু’টিসহ বর্ণিত রেওয়ায়েতগুলো এটা স্পষ্ট করছে না যে হাদিসে “সহবাস” বোঝানো হয়েছে, নাকি “নির্জনে সাক্ষাত হওয়া” বোঝানো হয়েছে। এখানে উভয় অর্থের যেকোনটি সঠিক হবার সম্ভাবনা থাকে।
তবে অন্যান্য কিছু রেওয়ায়েতে এটির স্পষ্টকরণ রয়েছে। যার ফলে একদম সুনির্দিষ্টভাবে বোঝা যাবে এখানে কোন অর্থ প্রযোজ্য হবে। নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হলোঃ
এক.
আন-নাসাঈর বর্ণিত একটি, আল-বুখারীর বর্ণিত একটি, আবু-আওয়ানাহর বর্ণিত একটি, আত-তাবারানীর বর্ণিত চারটি, ইবন হাযমের বর্ণিত একটি, ইবন হিব্বানের বর্ণিত একটি; অর্থাৎ আন-নাসাঈ, আল-বুখারি, আবু-আওয়ানাহ, আত-তাবারানী, ইবন হাযম ও ইবন হিব্বান, এনাদের সকলের বর্ণিত মোট নয়টি – রেওয়ায়েতে “আদ-দুখুল বি” বা “আল-বানা বি” এর বদলে “الدخول علی” (আদ-দুখুল আলা) ব্যবহৃত হয়েছে।
“আদ-দুখুল আলা” মানে হলোঃ দেখতে যাওয়া, সাক্ষাত করা, পরিদর্শন করা ।
দুই.
মুসলিম, ইবন আবি-আসেম, আন-নাসাঈ, আবু-আওয়ানহ, আল-বাগভী, আল-বায়হাকী, আবু-নুয়াইম ও ইবন আবিদ-দুনিয়া (রহিমাহুমুল্লাহ) ; এনাদের প্রত্যেকে একটি করে হাদিসটির মোট ৮ টি রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন, যেখানে “আদ-দুখুল বি” বা “আল-বানা বি” এর বদলে “زف” (যাফফুন) ব্যবহৃত হয়েছে।
যাফফুন অর্থ হলোঃ কনেকে বরের কাছে পাঠানো, কন্যা সম্প্রদান করা, বউ নিয়ে আসা_
তিন.
আব্দুর-রাজ্জাক দুইটি, আত-তাবারানী একটি, আবু-নুয়াইম একটি অর্থাৎ তাঁরা সকলে হাদিসটির মোট ৪ টি রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। যাতে “আদ-দুখুল বি” বা “আল-বানা বি” এর বদলে “إهتداء إلی” (ইহতিদা ইলা) ব্যবহৃত হয়েছে ।
“ইহতিদা ইলা ” অর্থ হলো: সন্ধান পাওয়া, পথ পাওয়া, পেয়ে যাওয়া, আবিস্কার করা, পৌছে যাওয়া।
“আদ-দুখুল আলা”, “যাফফুন”, এবং “ইহতিদা ইলা” – এই তিনটি শব্দ হলো “আল-বানা বি” ও “আদ-দুখুল বি” এর ব্যাখ্যাস্বরূপ এবং অর্থ স্পষ্টকরণের সাহায্যকারী।
কেননা এই তিনটি শব্দ একই হাদিসের অন্যান্য রেওয়ায়েতে “আল-বানা বি” ও “আদ-দুখুল বি” এর বিকল্প হিসেবে বর্ণিত হয়েছে, উল্লেখিত হয়েছে। যেহেতু কিছু বর্ণনায় “আল-বানা বি” ও “আদ-দুখুল বি” এর এর বদলে “আদ-দুখুল আলা”, “যাফফুন”, এবং “ইহতিদা ইলা” এসেছে।
সেহেতু অবশ্যই “আল-বানা বি” ও “আদ-দুখুল বি” এর অর্থ এমন কিছু হতে হবে যা এই তিনটির সাথে অধিক সামঞ্জস্যপুর্ণতা রাখে। এক্ষেত্রে “আল-বানা বি” ও “আদ-দুখুল বি” এর দ্বিতীয় অর্থটি (স্বামী স্ত্রীর মাঝে নির্জনে সাক্ষাত হওয়া) “আদ-দুখুল আলা”, “যাফফুন”, এবং “ইহতিদা ইলা ” এর অর্থের সাথে অধিক সামঞ্জস্যপুর্ণ।
সুতরাং হাদিসে বর্ণিত “আল-বানা বি” বা “আদ-দুখুল বি” দ্বারা “স্বামী স্ত্রীর মাঝে নির্জনে সাক্ষাত হওয়া” বোঝানো হয়েছে, “সহবাস” বুঝানো হয়নি।স্বামী-স্ত্রীর মাঝে নির্জনে প্রথমবার সাক্ষাত হয়ার অর্থই এটা না যে তারা উক্ত সময়ে সহবাস করেছে, বরং সহবাস ব্যাতিতও স্বামী স্ত্রীর মাঝে প্রথমবার নির্জনে সাক্ষাত হতে পারে।
ঠিক এ কারণেই এই সংক্রান্ত হাদিসের বাংলা অনুবাদে ‘বাসর হওয়া’ কথাটি দেখা যায়। বাসর হওয়া দ্বারা বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর প্রথম একাকী অবস্থান করাকে বোঝানো হয়। কিন্তু বাসর হওয়া মানেই যৌন সহবাস না।
عَنْ عُرْوَةَ تَزَوَّجَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَائِشَةَ وَهِيَ بِنْتُ سِتِّ سِنِينَ وَبَنٰى بِهَا وَهِيَ بِنْتُ تِسْعٍ وَمَكَثَتْ عِنْدَه“ تِسْعًا.
‘উরওয়াহ (রহ.) হতে বর্ণিত।
তিনি বলেন, যখন নবী সা: ‘আয়িশা (রাঃ)-কে বিয়ে করেন তখন তাঁর বয়স ছিল ছয় বছর এবং যখন বাসর করেন তখন তাঁর বয়স ছিল নয় বছর এবং নয় বছর তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে জীবন কাটান।
অতএব, নবী সা: আয়েশা (রা.) এর সাথে যখন সহবাস করেন তখন আয়েশা (রা.) এর বয়স ৯ বছর ছিল, এরূপ দাবি করাটা সঠিক নয় বরং ভুল। আলোচ্য বর্ণনা দ্বারা সহবাসের বিষয়টি প্রমাণ হয় না বরং শুধু বাসর হওয়া প্রমাণ হয়।
তাছাড়া মুহাদ্দিসরাও “আল-বানা বি” ও “আদ-দুখুল বি” দ্বারা সেটাই বুঝেছেন যা আমি উল্লেখ করলাম।
“আল-বানা বি” এর ব্যাখ্যায় যারা “ঘরে তোলা, সংসার করা, স্ত্রীর দায়িত্ব নেয়া” এই ধরণের অর্থ বুঝেছেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন:
ক. আল-আমিন আল-হারারী
খ. ইবনুল মালাক আল-কিরামানী
গ. মাযহারুদ্দিন আয-যাইদানী
ঘ. মোল্লা আলি আল-ক্বারী
ঙ. শারফুদ্দিন আত-তাইবী
চ. ইবন রাসালান আর-রমলী
ছ. মুহাম্মাদ ফাওয়াদ আব্দুল-বাকী (মুহাক্কিক)
“আল-বানা বি” এর ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসদের উল্লেখিত এই ধরনের অর্থগুলো “আদ-দুখুল বি” এর জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য হবে ; কেননা “আল-বানা বি” ও “আদ-দুখুল বি” লাউ-কদুর মতো একে অপরের সমার্থক।
“আদ-দুখুল বি” বলতে যারা “সাক্ষাত করা” বা এই ধরণের অর্থ বুঝেছেন তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন:
ক. দ্বিয়াউদ্দিন আল-মাকদেসী
খ. খালিল আহমাদ আস-সাহারানপুরী
গ. ইবন রাসলান আর-রমলী
ঘ. ইবন কাইয়িমিল জাওযিয়াহ
ঙ. আল-আমিন আল-হারারী
পরিশেষে বলা যায় (উপসহংহারস্বরূপ), আমরা উপসংহারে বলতে পারি যে, আলোচ্য হাদিসগুলো দ্বারা এটি প্রমাণ হয় যে ৯ বছর বয়সে আয়েশা (রা.) স্বামীগৃহে গিয়েছেন, তাঁর স্বামী নবী করিম (ﷺ) এর সঙ্গে তাঁর বাসর হয়েছে।
কিন্তু এর দ্বারা মোটেও সন্দেহাতীতভাবে এটি প্রমাণ হয় না যে ৯ বছর বয়সেই নবী (ﷺ) তাঁর সঙ্গে সহবাস করেছেন। এটি এমন এক ব্যাপার যা স্বামী-স্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত জিনিস এবং এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই ভালো জানেন।
আর এমনটি যদি প্রমাণিত হতোও তবু সেটিকে আমরা দোষনীয় কিছু মনে করি না বা এর দ্বারাই কেউ শিশুকামী প্রমাণ হয়ে যায় না। তবুও ইসলামবিরোধীদের লাগাতার অপপ্রচারের প্রেক্ষিতে আমরা আলোচ্য হাদিসগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলাম।
দলিলসমূহ:
১. আল-মুসনাদুল মুসান্নাফুল মুয়াল্লাল (38/212-218)
২. আল-মুসনাদুল জামে (19/788-792)
৩. ইবনুল যাওযী, কাশফুল মুশকিল (3/494)
৪. ড. আহমাদ মুখতার, মুজামুল লুগাতিল আরাবিয়াহ (1/727)
৫. ইবনুল যাওযী, কাশফুল মুশকিল (3/494)
৬. সুনান আন-নাসাঈ (হা/3378), সহিহ আল-বুখারী (হা/5133),মুস্তাখরাজ আবি-আওয়ানাহ (হা/4266), আল-মুজামুল কাবির (23/21) , আল-মুজামুল আওসাত (7/94) & (2/301) ,হুজ্জাতুল ওইদা’আ (হা/506), সহিহ ইবন হিব্বান (হা/3454)
৭. ড.ফজলুর রহমান, আল-মুজামুল ওয়াফী (পৃ/465)
৮. সহিহ মুসলিম (হা/1422),আল-আহাদ ওয়াল মাছানী (হা/3028), সুনানুন নাসাঈ আলকুবরা (হা/5544),মুস্তাখরাজ আবি-আওয়ানাহ (হা/4271),শারহুস সুন্নাহ (9/35), সুনানুল বায়হাকী আল-কুবরা (10/371),আল-মুসনাদুল মুস্তাখরাজ আলা সহিহ মুসলিম (হা/3312), আন-নুফকাহ আলাল ইয়াল (2/755)
৯. ড.ফজলুর রহমান, আল-মুজামুল ওয়াফী(পৃ/536-537)
১০. মুসান্নাফ আব্দুর-রাজ্জাক (হা/11191),আল-মুজামুল কাবির (23/17),মা’রেফাতুস সাহাবাহা (6/3208)
১১. ড.ফজলুর রহমান, আল-মুজামুল ওয়াফী(পৃ/187)
১২. সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৫১৫৮
https://www.hadithbd.com/hadith/error/?id=29721
১৩. তাহকিক সহিহ মুসলিম (2/1038),মুরশিদ যাওইল হাজা ওয়াল হাজাহ (11/425),শারহুল মাসাবিহ (3/560),আল-মাফাতিহ (4/35),মিরকাতুল মাফাতিহ (5/2066),শারহুল মিশকাহ (7/2285),শারহু সুনানে আবি-দাউদ (19/18)
১৪. বাযলুল মাজহুদ (8/47),আস-সুনান ওয়াল আহকাম (5/115),শারহু সুনানে আবি-দাউদ (9/431), তাহযিব সুনানে আবি-দাউদ(1/447), আল-কাওকাবুও ওয়াহহাজ (15/295),মুরশিদ যাওইল হাজা ওয়াল হাজাহ (11/425),আস-সুনান ওয়াল আহকাম (5/115)
আরও পড়ুন: মহিলারা পুরুষের সাথে জামায়াতে অংশগ্রহণ করে নামাজ পড়তে পারবে কিনা?