থাইরয়েড গ্রন্থি বা থাইরয়েড হল দুইটি লোব দ্বারা গঠিত একটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি যার অবস্থান গ্রীবাতে। পুরুষের এডাম’স এপলের ঠিক নিচে এর অবস্থান। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে থাইরয়েড হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোনগুলো মেটাবলিক রেট ও প্রোটিন সিন্থেসিসকে প্রভাবিত করে।
আজ আমরা থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। তো আর কথা নয় – সরাসরি যাচ্ছি মূল আলোচনায়।
হরমোন নিঃসরনকারী গ্রন্থির মধ্যে থাইরয়েড একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি। ইহা গলার সন্মুখভাগে ত্বক ও মাংশের গভীরে অবস্থান করলেও এ গ্রন্থিটির আকার বড় হলে গলগন্ড নামক রোগ হয়, যাকে স্থানীয় ভাষায় ঘ্যাগও বলা হয়ে থাকে।
এই গ্রন্থিনিঃসৃত হরমোন শরীরের সমস্ত বিপাক প্রক্রিয়ার গতি নিয়ন্ত্রণ করে বিধায় চিকিত্সা বিজ্ঞানে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
থাইরয়েডজনিত রোগীর সংখ্যাও অনেক। চিকিত্সা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে আমাদের দেশেও থাইরয়েডের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় ক্রমাগত উন্নতি হচ্ছে।
গত শতকের আশির দশকেও থাইরয়েডের চিকিৎসায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সার্বজনীন ছিল না। চিকিত্সকের অভিজ্ঞতা ও পুরোনো কয়েকটি টেষ্টের মাধ্যমেই থাইরয়েডের রোগ নির্ণয় ও চিকিত্সা করা হতো ।
এতে রোগ নির্ণয় ও চিকিত্সা বিলম্বিত ও ত্রুটিপূর্ণ হবার আশংকা থাকতো। আধুনিক পদ্ধতিতে থাইরয়েড গ্রন্থির হরমোন নির্ণয়ের প্রচলন ক্রমান্বয়ে আমাদের দেশে আসতে শুরু করে।
থাইরয়েডের রোগের ধরণও তখন ভিন্ন ছিল। আয়োডিনের অভাবজনিত থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ গলগন্ড ও এর জটিলতার সংখ্যা এত বেশী ছিল যে এই গ্রন্থির অন্যান্য রোগ যেমন- গ্রেভস ডিজিস, হাশিমোটো ডিজিস, হাইপো ও হাইপার থাইরয়েড রোগসমূহ, থাইরয়েডের ক্যান্সার জাতীয় রোগ ইত্যাদির আনুপাতিক হার তুলনামূলকভাবে কম মনে হতো।
বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায় যে ঐ সময়ে আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে আয়োডিনের অভাবজনিত গলগন্ড রোগের প্রকোপ ছিল প্রায় শতকরা পয়ত্রিশজনের কাছাকাছি।
এসব রোগের সঠিক পরিসংখ্যাণ বিজ্ঞানসন্মত জার্ণালে প্রকাশিত ছিল না বলেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের দেশের পরিসংখ্যান ছিল অনেকটাই অনুমান নির্ভর।
জন বি ষ্টানবারী নামক এক বিশেষজ্ঞ আয়োডিন জনিত রোগ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ১৯৮১ সালেও বাংলাদেশে থাইরয়েড রোগের সঠিক কোন পরিসংখাণ বা রিপোর্ট না পাবার কথা উল্লেখ করেছেন।
১৯৯৫ সালে তদানীন্তন পিজি হাসপাতালে আমি ও আমার প্রবীন সহকর্মীদের করা এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায় যে আয়োডিনের অভাবজনিত কারণে থাইরয়েড রোগীর সংখ্যা সকল থাইরয়েড রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশী, প্রায় ৩৫%।
পত্রিকান্তরে ১৯৬৬ সালে তদানিন্তন পূর্ব বাংলায় প্রায় এক চতুর্থাংশ লোকের গলগন্ড রোগ ছিল বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
চিকিত্সক, গবেষক, স্বাস্থ্য বিভাগের নীতিনির্ধারক ও সর্বস্তরের জনগণের অংশ গ্রহণে আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণ কার্যক্রম সার্বজনীনভাবে গৃহীত হবার ফলে গলগন্ড রোগের প্রকোপ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে গেছে।
একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে আয়োডিনের ঘাটতিজনিত থাইরয়েডের রোগের চেয়ে অন্যান্য থাইরয়েড রোগের হারই বেশী। এদের মাঝে হাইপোথাইরয়েডিসম, থাইরটক্সিকসিস ও থাইরয়েডের ক্যান্সারজনিত রোগসমূহই প্রধান।
উল্লেখ্য যে থাইরটক্সিকসিস জাতীয় রোগ হলে হরমোনের আধিক্যে রোগীর চঞ্চলতা বৃদ্ধিপায়, হাত পা কাপে, বুক ধড়পর করে, যথেষ্ঠ খাওয়া সত্বেও ওজন কমে যায়, শরীর ঘামে ও ক্ষেত্রবিশেষে মানসিক সমস্যাসহ নানাবিধ জটিলতা দেখা দেয়।
হাইপোথাইরয়েডিসমে প্রায় উল্টোরকম সমস্যা দেখা যায়। হরমোনের মাত্রা কমে যাবার কারণে রোগী অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে, ওজন বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে, শরীর ব্যথা করে, মাসিক অনিয়মিত হয়, সন্তান ধারণ ক্ষমতা কমে যায়, স্মৃতিশক্তি কমে যায়, চুল পড়ে যেতে থাকে এবং নানাবিধ মানসিক উপসর্গও দেখা দেয়।
আজকাল ল্যাবরেটরী মেডিসিন, রেডিওলজী ও নিউক্লিয়ার মেডিসিনের উন্নতির ফলে আমাদের দেশেও থাইরয়েড রোগ বেশ আগেই সনাক্ত করা যায়।
রোগের উপসর্গ দেখা দেবার আগেই শতকরা প্রায় দশভাগ লোকের রক্ত পরীক্ষায় থাইরয়েড হরমোনের মাত্রায় তারতম্য পাওয়া যায় যা এতকাল কারও জানার সুযোগ ছিল না।
এসব রোগীকে সাবক্লিনিক্যাল বা সুপ্ত থাইরয়েড জনিত রোগ বলা যেতে পারে। এসব রোগীদেরকেও চিকিত্সাসেবার আওতায় রাখা প্রয়োজন যদিও অধিকাংশেরই কোন ওষুধের প্রয়োজন হয় না।
এসকল সুপ্ত রোগী ও পরিপুর্ণ উপসর্গসহ থাইরয়েডের রোগী মিলিয়ে অনুমান করা যায় যে শতকরা দশ থেকে বিশ ভাগ লোকের কোন না কোন থাইরয়েডের রোগ আছে। এদের মধ্যে বেশ কিছু রোগী থাইরয়েডাইটিস ও থাইরয়েড ক্যানসারে আক্রান্ত ।
থাইরয়েড চিকিত্সায় ব্যাপক উন্নতির ফলে আজকাল পূর্বের ন্যায় অতিমাত্রার হাইপো বা হাইপারথাইরয়েড রোগী কম দেখা যায়।
অন্য কোন রোগ চিকিত্সার জন্য পরীক্ষা করার সময় অনেকের থাইরয়েড জনিত রোগ প্রথমবারের মত সনাক্ত হতে দেখা যায়।
চিকিত্সা আপাতঃদৃষ্টিতে সহজ মনে হওয়ায় বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ ছাড়াই অনেক রোগী চিকিত্সা চালিয়ে যান ফলে কখনও কখনও মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়।
থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা আগের তুলনায় বেশী সহজপ্রাপ্য হবার কারণে অনেকেই টেষ্টগুলো কারণে অকারণে করে থাকেন এবং অনেকেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়াই শুধুমাত্র টেষ্টের সামান্য তারতম্য দেখেই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে থাইরয়েডের ওষুধ দিনের পর দিন সেবন করে যাচ্ছেন।
ইহা অপ্রত্যাশিত এবং রোগীর জন্য ঝুকিপূর্ণ। এর ফলে রোগীরা হার্টের অসুখ ও অষ্টিওপরোসিস নামক অস্থি রোগের ঝুকি বাড়াচ্ছেন। যথাযথ চিকিত্সার অভাবে থাইরটক্সিক ক্রাইসিস নামক জটিলতায় আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুকি প্রায় শতভাগ।
থাইরয়েড রোগের চিকিত্সায় প্রভুত উন্নতি হওয়া সত্বেও অজ্ঞতা ও অবহেলার কারণে প্রানহানি ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও যত্নবান হতে হবে।
এই রোগ নির্ণয়, চিকিত্সা ও চিকিত্সাপরবর্তী পরিচর্যায় চিকিত্সা বিজ্ঞানের প্রচলিত প্রায় সব বিভাগের সাথেই যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়।
এদের মাঝে ল্যাবরেটরী মেডিসিন, শল্যবিভাগ, ইএনটি ও নিউক্লিয়ার মেডিসিনের সহায়তা প্রায়ই দরকার হয়। এ রোগ নির্ণয় ও চিকিত্সায় কখনও কখনও নিউক্লিয়ার মেডিসিনের সহায়তা প্রয়োজন হয়।
সাধারণ মানুষের মধ্যে সঙ্গত কারণেই রেডিয়েশন ভিতি রয়েছে। অতিরিক্ত রেডিয়েশনের ফলে ভবিষ্যতে ক্যানসারসহ আরও মারাত্মক প্রতিক্রিয়া যাতে না হয় এজন্য নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগের প্রচেষ্টা রয়েছে আর চিকিত্সকরাও বিশেষভাবে প্রয়োজন না হলে নিউক্লিয়ার মেডিসিনে রোগীদেরকে অহেতুক রেডিয়েশনের ঝুকিতে রাখেন না।
বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল চিকিত্সকদের কে কোন রোগের বিশেষজ্ঞ তা সার্টিফিকেট যাচাই করে নির্ধারন করেন যা সাধারণ জনগণ ভালভাবে অবহিত নন।
এই সুযোগেই অপচিকিত্সার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় যা থাইরয়েডের রোগের বেলায়ও দেখা যায়। কাউন্সিল কর্তৃক স্বীকৃত নয় এমন কারও চিকিত্সার মত স্পর্শকাতর বিষয়ে প্রাকটিস করা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।
আমাদের দেশে থাইরয়েড রোগের চিকিত্সায় অর্জন কম নয়। দেশের বড় বড় চিকিত্সা প্রতিষ্ঠানে এন্ডোক্রাইনোলজী বিভাগ চালু হয়েছে।
থাইরয়েড রোগীর রোগ নির্ণয় ও চিকিত্সায় অনেক সময় নিউক্লিয়ার মেডিসিনের সহায়তা প্রয়োজন হয়। আণবিক শক্তি কমিশনের আওতায় বেশ কয়েকটি চিকিত্সাপ্রতিষ্ঠানে নিউক্লিয়ার মেডিসিনের শাখা রয়েছে যা ভবিষ্যতে আরও প্রসারিত হবে আশা করা যায়।
সার্জারী ও অনকোলজী বিভাগের বিভিন্ন শাখার বিস্তার ভবিষ্যতে থাইরয়েড রোগের চিকিত্সাকে আরও সমৃদ্ধ করবে। এ রোগ নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন।
চিকিত্সার টার্গেট নির্ধারণে ব্যাপকভাবে বিদেশী গাইডলাইন ব্যবহারের যে রেওয়াজ চালু আছে সেসব দেশীয় গবেষণা দ্বারা আমাদের দেশের জন্য উপযোগী করা প্রয়োজন।
বিশেষকরে গর্ভবতী মহিলাদের থাইরয়েড রোগের চিকিত্সা আমাদের দেশীয় তথ্যের ভিত্তিতে হওয়া খুবই প্রয়োজন। থাইরয়েডের রোগসমূহ মূলত- অসংক্রামক।
পরিবেশদুষণের সাথে এ সকল রোগের যোগসূত্র আছে কিনা সে বিষয়েও গবেষণা করা প্রয়োজন। থাইরয়েড একটি এন্ডোক্রাইন গ্রন্থি বিধায় এন্ডোক্রাইনোলজী বিভাগের প্রসারের সঙ্গেই থাইরয়েড রোগীদের চিকিত্সাসেবা আরও সম্প্রসারিত হবে।
দিন দিন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক তৈরী হচ্ছে এবং প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে এন্ডোক্রাইনোলজী বিভাগের আরও প্রসার ঘটলে এবং রোগীরা সচেতনভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ গ্রহণ করলে থাইরয়েড রোগের চিকিত্সায় বিদেশে যাবার প্রয়োজন শুন্যের কোঠায় নেমে আসবে।
আরও পড়ুন: যৌনাঙ্গে চুলকানি হওয়ার কয়েকটি কারন ও প্রতিকার।