আমরা সবাই তাঁকে ইতিহাসের বীর (তিতুমীর) বলেই উল্লেখ করি কিন্তু নিকৃষ্ট ঐতিহাসিকদের ষড়যন্ত্রমূলক এবং তাদের স্বার্থবাদী পলিসি দ্বারা বানোয়াট তথ্য পড়েই তাঁর বিকৃত চরিত্র সম্পর্কে অবগত হই আমরা।
স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এবং ইতিহাস পড়ুয়ারা প্রায় সবাই সে তথ্যই জানে। ফলে ইতিহাসের আর্টিফিশিয়াল ফেস প্রচার করে। এমনকি তাঁর বিকৃত নামই অধিকাংশ মানুষ জানে।
পাঠ্যপুস্তকে ওপার বাংলার এজেন্টরা তাঁর আসল নাম না লিখে নকল নামে পরিচিত করে শ্রুতিমাধুর্যতা নষ্ট করে। অবশ্য তৎকালীন মুসলিমদের মধ্যে কেউ এমন নামে ডাকেনি।
তাঁর পিতা ছিলেন মীর হাসান আলি এবং মাতা আবেদা খাতুন। তিঁনি জন্মগ্রহণ করেন ১৭৮২ সালে চব্বিশ পরগনার চাঁদপুরে। তাঁর হেয়কৃত নিকৃষ্ট নাম “তিতুমীর”।
তেতো থেকে তিতু + মীর অথচ তিঁনি ছিলেন একজন কুরআনের হাফেয এবং তিতু-মীর নামে ডাকলে সাড়া দিতেন না। তাঁর পিতা-মাতার দেওয়া নাম মীর নিসার আলি বা সৈয়দ মীর নিসার আলি।
এটা কেবল তাঁর নাম বিকৃতির একটি রূপ বটে। কিন্ত নিকৃষ্ট ঐতিহাসিকেরা তাঁর চরিত্র বিকৃতি সাধন করেছে। গুগলে যদি সার্চ করেন- (বাংলা বা ইংরেজীতে)” বাংলায় ওহাবি আন্দোলন কার্যক্রম পরিচালনা করেন কে? উত্তর হিসেবে আসবে নিসার (কিন্তু বানানো নাম তিতুমীর)।
কিন্ত এটা বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মিথ্যা। গুগলের রেফারেন্সে গেলে ইংলিশে যে তথ্য দেওয়া তার বাংলা কপি বা নকল হলো- “১৮২২ সালে মীর নিসার আলি মক্কায় গিয়ে ওহাবি দীক্ষা নেন” (এই ফালতু রেফারেন্স)! জনৈক হিন্দু ঐতিহাসিক।
একজন সামর্থ্যবান মুসলিম হজ্বে যাবেন। জীবনে একবার পবিত্র কাবা তাওয়াফ করবেন এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু গুগল, উইকিপিডিয়া বা অন্য কেউ উনি ওহাবি এই রেফারেন্স দিতে অক্ষম!
উনি ওহাবি নন এটার প্রমাণ:
“১৮২২ সালে সৈয়দ মীর নিসার আলির সাথে সৈয়দ আহমদের দেখা হয়। নিসার আলি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর আন্দোলন এবং আগামী পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত হন। (ঐতিহাসিক অমেলবিন্দু দেব:বাঙ্গালি বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ।পৃষ্ঠা নং- ৯৯);
কিন্ত আমাদের পাঠ্য বইয়ে সেই নিকৃষ্ট কথাই বলা আছে। (বিশেষ দ্রষ্টব্য: আমি ওহাবিদের হেয় করার জন্য নিকৃষ্ট লিখিনি।লিখেছি শতাব্দি সেরা মিথ্যার জন্য।)
আবার সৈয়দ আহমদ, শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র:) এর সংস্কারবাদী আন্দোলনের পতাকা বাহক ছিলেন। তাঁকেও ওহাবি বলা হয়।সংস্কারবাদী আন্দোলন একই সাথে আরবে ও ভারতে হওয়ায় রাজনৈতিক স্বার্থে ওহাবি ট্যাগ লাগায় বৃটিশরা (বৃটিশ নীতি);
কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সৈয়দ আহমদ তালিম নেন এক উসমানীয় হানাফি আলেমের কাছে মক্কায়। পড়া চালিয়ে যান, সামনে আরও পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
ওহাবিরা তো হানাফি ছিল না পাশাপাশি তাসাউফপন্থীও না। এখান থেকে সুস্পষ্ট তাঁদেরকে ওহাবি নামক মিথ্যা ট্যাগ দেওয়া হয়।
আর নিসার আলি বেরেলভী (রহ:) থেকে ৪ বছরের বড় ছিলেন। মূলত তিঁনি শাহওয়ালিউল্লাহের আন্দোলনে যোগ দেন।(ইমাম মালেক ইমাম হানাফীর ১৩ বছরের ছোট ছিলেন।
এমনকি ইমাম হানাফীর জীবদ্দশায় ইমাম মালেক কোনদিন তাঁর বাড়ির দিকে পা বিছিয়ে বসেননি!) তাই এখানে মীর নিসার বেরেলভী (রহ:) এর ৪ বছরের বড় হলেও শিষ্যত্ব গ্রহণ করাটা স্বাভাবিক।
মূল বিষয়ে আসা যাক; যা পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হয়। মীর নিসার কিশোর বয়সে ধর্ম বিমুখ কুসংস্কারবাদীদের ইসলামের দিকে ডাকতেন।
যৌবনে এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামেন যার ফলে তাঁকে ওহাবি ট্যাগ দেওয়া হয়। তিঁনি অত্যাচারি হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে সারা জীবন প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করেছেন। ব্রিটিশ তাড়াতে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
“এদিকে গুরু সৈয়দ আহমদ লড়াই করছেন সীমান্ত প্রদেশে আর এদিকে নিসার আলি কাজ শুরু করেছেন অবিভক্ত বাংলায়।
ইংরেজের বিরুদ্ধে তখন প্রকাশ্য জিহাদ না করলেও যুদ্ধে প্রাণ দেওয়ার জন্য প্রচুর নওজোয়ানকে পাঠিয়ে দিতেন সাথে প্রচুর টাকা-পঁয়সা দিয়ে।
সৈয়দ নিসারের একটি বড় সম্বল ছিল তাঁর অগ্নিবর্ষক জ্বালাময়ী সৃজনশীল বক্তৃতা। নিসার আলি নিজেও একজন ব্যায়াম ও কুস্তিগীর ছিলেন এবং তাঁর শিষ্যদের নিজেই ট্রেনিং দিতেন।” ( সূত্র: ঐতিহাসিক আব্দুল গফুর সিদ্দিকী; বই- ‘শহীদ তিতুমীর’)।
এদিকে ব্রিটিশরা প্রচার করে তিঁনি নতুন ধর্মমত প্রচার করছেন। আলেমদের ঘুষ দিয়ে প্রচার করা হল “এসব ওহাবিদের কাজ, আমরা এতদিন যা করছিলাম তাই করব।
কেউ তার কথায় ভ্রুক্ষেপ করিবে না”। বাংলার সকল জমিদার তাঁকে হত্যা করার আদেশ জারি করে এবং আইন জারি করে। তন্মধ্যে কতিপয় আইন ছিলো নিম্নের মতো;
১. যারা নিসারের দীক্ষা নিবে তারা ওহাবি ইসলামবিরোধী। যারা তার কথায় দাঁড়ি রাখবে তাদের প্রত্যেকের ফি আড়াই টাকা!
২. মসজিদ তৈরী করলে কাঁচা মসজিদের জন্য ৫০০ এবং পাকা মসজিদের জন্য ১০০০ টাকা দিতে হবে।
৩. আরবি নাম রাখলে ৫০ টাকা জরিমানা দিতে হবে।
৪. গোহত্যা করলে হাত কেটে নেওয়া হবে।
৫. নিসারের লোকদের আশ্রয় দিলে ভিটে ছাড়া করা হবে।
(সূত্র: এ.আর মালিক; দ্য ব্রিটিশ পলিসি এন্ড দ্য মুসলিম বেঙ্গল, পৃষ্ঠা নং- ৭৮)।
মীর নিসার তাদের সবাইকে পরাজিত করতে পারতেন কিন্ত এতে পরে হিন্দুদের ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধে পাশে পেতেন না (মূলত হিন্দুদের প্রতি সদয় ছিলেন তিনি)।
জবাবে তিঁনি এক জমিদারকেপত্র লেখেন। সেটি হলো এরকম যথা: “জনাব, বাবুকৃষ্ণদের মহাশয়, আমি আপনার প্রজা না হলেও এদেশের মানুষ।
আমি লোকমুখে জানতে পারলাম যে আপনি আমাকে ওহাবি বলে মুসলিমদের প্রতি হেয় করছেন। আমি আপনার কোন ক্ষতি করি নাই। যদি কেউ আপনাকে প্ররোচিত করে আপনার উচিত সত্যের সন্ধান করা।
আমি ইসলাম ধর্মে কায়েমের চেষ্টা করছি। এতে আপনার অসন্তোষ কেন? যার ধর্ম সেই বোঝে। আপনি এখানে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।
মুসলিমদের দাঁড়ি রাখা, গোফ খাট রাখা, ঈদুল আযহা-আকিকাতে কুরবানি করা আল্লাহর-রাসুলের নির্দেশ। মসজিদ প্রস্তুত করে উপাসনা করাও আল্লাহর হুকুম। আপনি আমাদের বিধি-বিধানে হস্তক্ষেপ করবেন না। আশা রাখি হুকুম প্রত্যাহার করবেন।” ( সূত্র: ঐতিহাসিক অমেল বিন্দু দে)।
এ পত্রবাহক নিসারের প্রিয় আমিনুল্লাহকে জেলে বন্দি করে এবং পরে খাবার পানি না দিয়ে সীমাহীন প্রহার করে হত্যা করে।এতে নিসার দুঃখগ্রস্থ হয়ে বলেছিলেন “আমার আজাদি আন্দোলনের প্রথম শহিদ আমিনুল্লাহ”।
নিসারকে রোধ করতে সমগ্র বাংলার সব জমিদার এবং ব্রিটিশ গোলামদের একত্র করে কলকাতায় ষড়যন্ত্র করা হয় তা ঐতিহাসিক সত্য।
মুসলিমদের ওপর তারপর সকল জমিদারেরা সম্মিলিতভাবে মঙ্গোলীয় অত্যাচারের স্টিমরোলার চালায়। কেউ জরিমানা দিয়েও রেহাই পেল না আবার কেউ গ্রাম ত্যাগ করল।
এরপর জমিদারদের সৈন্যরা মসজিদ পোড়ানো এবং মুসলিমদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা শুরু করল পাইকারিভাবে। (বহু ঐতিহাসিক দলিল থাকলেও ছাপানো হয় না।)
ঐতিহাসিক অমলবেন্দু দে এর মতে “সৈন্য-বাহিনীসহ সরফরাজ গ্রামে হামলা করে নিসারের সমর্থকদের হত্যা ও উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু নিসার সাহেব এতে ধৈর্যধারণ করে কোর্টে কেস করেন।
এত বড় গণহত্যা এবং গ্রাম শশ্মানে পরিণত করার পরও বিচার না পেয়ে তিঁনি কলকাতায় আপিল করেন এবং বিচার না পেয়ে ক্ষুব্ধ হলেন এবং বুঝলেন সুবিচার চাইলে অবিচারই প্রাপ্য” (সূত্র: এ.আর মালিক; পৃষ্ঠা নং- ৮১)।
এবার শাহাদাত না হয় স্বাধীনতার আন্দোলনে নেমে নারকেলবাড়িয়ায় বাঁশেরকেল্লা নির্মাণ করেন তিনি। সেনাপতি মাসুম আলি এবং শেখ মিসকিন সমগ্র বাহিনী সমবেত করেন।
সৈয়দ নিসার ঘোষণা করেন “এমন ৫ জনের প্রয়োজন যারা আজ আজাদী আন্দোলনে প্রাণ দিতে প্রস্তুত” সাথে সাথে হাজার হাজার সেনা আল্লাহু আকবর ধ্বনির মাধ্যমে হাত উত্তোলন করে।
প্রথম টার্গেট কৃষ্ণবাবুর জমিদারি। কারণ- আমিমুল্লাহ এবং মুসলিম গণহত্যা। মাসুম আলির আক্রমণে জমিদারের সেনা,পাদ্রিদের সৈন্য, কোম্পানির সৈন্য আর অফিসাররা হতভম্ব হয়ে যান তাঁদের সামরিক কৌশল দেখে। (সূত্র: অমল বিন্দু দে)।
এরপর নিসার আলি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। ব্রিটিশ সরকার একদল উন্নত অশ্বারহি দল পাঠায় কিন্ত মাসুম আলির সামনে দাঁড়াতে পারেনি তাঁদের সুপ্রশিক্ষিত আধুনিক সৈন্যরা।
ফলাফল- আহত, মৃত এবং পরাজিত। এবার ক্রুদ্ধ ব্রিটিশরা তাদের দুর্ধর্ষ এক জেনারেলের সাথে বিপুল সংখ্যক কামান পাঠালো।
এবার তিঁনি ঘোষণা করলেন “আমাদের কামান নেই, মৃত্যু সুনিশ্চিত। যাদের ইচ্ছা এই যুদ্ধ ত্যাগ করতে পারো। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী একজন দূর্বল সৈন্যও পিছিয়ে যায়নি যে প্রাণ দিতে কুন্ঠিত।
যুদ্ধ শুরু হতেই বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিসারের সৈন্যরা। মাসুম আলি তড়িৎগতিতে পৌঁছালেন কামান ঠেকাতে এবং লাফিয়ে পড়লেন কামানের ওপর।
যদি কয়েক সেকেন্ড আগে তিঁনি পৌঁছাতেন তাহলে যুদ্ধের মোড় পাল্টে গিয়ে কামান মুসলিমদের হয়ে যেতো। তাঁকে বন্দি করা হয়। একে একে সকল কামান গর্জনের সাথে সাথে মুসলিম সৈন্যদের দেহ চারদিকে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
ব্রিটিশরা উল্লাস করতে থাকে। তিতুমীর ও তার বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয়ে যায়। নিসার আলি, বাংলার অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ বীর শহিদ হন এই কামানের গোলায়। বিচারে অন্য সেনাদের এবং সাহসী মাসুম আলির ফাঁসির রায় হয়।
আর ইতিহাসের এই মহান বীরদের (তিতুমীর এর মতো যারা) নিয়ে আমাদের মূল্যায়ন কেমন তা আপনাদের কাছে প্রশ্ন। তাঁর বিকৃত ইতিহাস সম্পর্কে প্রতিবাদ করা আমাদের সবার কর্তব্য।
আরও পড়ুন: উত্তরাধিকার সম্পত্তি না দিতে চাইলে যেভাবে আদায় করবেন।