ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে বর্তমানে সবাই একটু ভীতই বলা চলে। কারন, যে হারে ডেঙ্গু বাড়ছে তাতে হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার’রা চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
সাধারন জ্বর হলেও মানুষ ডেঙ্গু আতঙ্কে আগেই পরীক্ষা করে নিচ্ছে। তবে এ কথা সত্য যে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
যাই হোক, ডেঙ্গু এবং ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে আজ আমরা জানবো। ডেঙ্গু হলে কিভাবে ঘরোয়াভাবেই চিকিৎসা সম্ভব সেটাও জানবো। তো আর কথা নয় – সরাসরি যাচ্ছি মূল আলোচনায়।
ডেঙ্গু জ্বর কি?
ডেঙ্গু জ্বর হলো একটি মশাবাহিত রোগ। এডিস নামক মশার কামড়ে এ রোগ ছড়ায়। আর এটা গ্রীষ্মকালেই সবচেয়ে বেশি হয়। এডিস মশা যদি কামড়ায় তাহলে তিন থেকে পনের দিনের মধ্যে সাধারন উপসর্গগুলো দেখা দেয়।
যেসব উপসর্গ দেখা দেয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মাথা ব্যথা, জ্বর, বমি হওয়া, পেশিতে ও গাঁটে বা গীড়ায় ব্যথা হওয়া এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি সহ ইত্যাদি।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণসমূহ:
ডেঙ্গু (Deng-gey) জ্বর হলো একটি মশাবাহিত ভাইরাস ঘটিত রোগ। যারা ডেঙ্গুতে ১ম বার আক্রান্ত হয় তাদের তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
শুধুমাত্র অল্প কিছু ক্ষেত্রেই রোগের প্রভাব গভীরভাবে পরিলক্ষিত হয়। ডেঙ্গু জ্বর হলে সাধারন যেসব উপসর্গ দেখা দেয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. উচ্চ মাত্রায় জ্বর;
২. তীব্র মাথার যন্ত্রণা;
৩. চোখের পিছনে ব্যথার অনুভূতি;
৪. মাংস পেশি এবং অস্থি সন্ধি-তে যন্ত্রণা হওয়া;
৫. বমি বমি ভাব হওয়া;
৬. মাথা ব্যথা এবং মাথা ঘুরানো;
৭. গ্রন্থিসমূহ ফুলে যাওয়া;
৮. শরীরের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ফুসকুড়ি বের হওয়া সহ ইত্যাদি।
উপরের এই লক্ষণগুলো ডেঙ্গু জ্বরে সংক্রমণের ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই দেখা দিতে পারে। আর এসব উপসর্গ ২ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
তবে ১ম বার আক্রান্ত হওয়ার পরে আবার যদি কেউ আক্রান্ত হয় তবে তখন ভয়াবহতা অনেক বেশি হয়। তাই পূর্বে যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
ডেঙ্গু জ্বরের গুরুতর উপসর্গসমূহ:
১. পেটে প্রচন্ড ব্যথা হওয়া;
২. ক্রমান্বয়ে বমি হতেই থাকা;
৩. নাক দিয়ে রক্তপাত;
৪. প্রস্রাবে এবং মলের সাথে রক্ত যাওয়া;
৫. পায়খানা নিয়ন্ত্রিত না হওয়া;
৬. ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ হওয়া;
৭. শ্বাস-প্রশ্বাস খুব দ্রুত হওয়া;
৮. খুব ক্লান্তি ক্লান্তি লাগা;
৯. বিরক্তি এবং অস্থিরতা প্রচণ্ড পরিমাণে বেড়ে যাওয়া;
মনে রাখবেন, ডেঙ্গু জ্বর হলে শরীরের রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই জন্য রক্তনালীতে ছিদ্র তৈরী হতে পারে। প্লাটিলেট সংখ্যা দ্রুত কমে যায়।
এই জন্য মানুষের শরীরে শক লাগা, শরীরের যেকোন অংশ হতে রক্তপাত এবং শেষ পর্যায়ে এসে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। উপরে উল্লিখিত গুরুতর লক্ষণগুলোর কোন একটি যদি দেখা দেয় তাহলে অতি দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে নেয়া উচিত।
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা:
ডেঙ্গুর জন্য আসলে নির্দিষ্ট কোন ঔষধ নেই। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হয়। তবে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। আশা করা যায়, খুব দ্রুতই এর কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়ে যাবে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘরোয়া চিকিৎসাতেই ডেঙ্গু রোগ ভালো হয়ে যায়। ডাক্তার’রা প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ দিয়েই জ্বরের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেন।
নন-স্টেরয়ডাল প্রদাহ প্রতিরোধী ঔষধের রক্ত ক্ষরণের সম্ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তবে রোগের মাত্রা যদি অতিরিক্ত বেড়ে যায় তাহলে রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে এবং ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা করাতে হবে।
জেনে রাখা দরকার, হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরের রোগীদের শিরায় (IV) ইলেকট্রোলাইট (লবণ) তরল দেওয়া হয়। এতে শরীরে প্রয়োজনীয় জল এবং লবণের ঘাটতি পূরণ থাকে।
ডেঙ্গু জ্বরের রোগীদের যা যা খাওয়া উচিত:
ডেঙ্গু জ্বরের রোগীদের জন্য আসলে ঐভাবে কোন খাবার নির্দিষ্ট করা নাই। তবে কিছু কিছু খাবার বিশেষ ভাবে উপকারী হতে পারে। যেমন-
- ভিটামিন সি (সাইট্রাস ফল, বেরি এবং বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজিতে পাওয়া যায়);
- জিঙ্ক (সামুদ্রিক খাবার, মটরশুটি এবং বাদামে পাওয়া যায়);
- আয়রন (মটরশুঁটি এবং মাংস-তে পাওয়া যায়);
- ওটমিল (সহজপ্রাচ্য কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ);
- নারিকেলের জল অর্থাৎ ডাবের জল;
- পেঁপে;
উপরের খাবারগুলো খাওয়ার সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। শরীরে যাতে পানির ঘাটতি না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। আর আপনারা তো জানে, শরীরকে হাইড্রেট করার জন্য পানি প্রয়োজন।
ডেঙ্গু জ্বর হলে যেসব খাবার খাওয়া অনুচিত:
ডেঙ্গু জ্বর হলে সহজে হজম হয়না এমন খাবারগুলো খাওয়া নিষিদ্ধ। যেমন-
- আমিষযুক্ত খাবার;
- চর্বি জাতীয় খাবার;
- তেলে ভাজা এবং তৈলাক্ত খাবার;
- যেকোন প্রকার ভাজা-পোড়া;
ডেঙ্গু জ্বর হলে ঘরোয়া চিকিৎসা:
১. যেহেতু ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত রোগ তাই অবশ্যই মশারী ব্যবহার করুন। যিনি রোগী তিনিও মশারী ব্যবহার করবেন এবং যারা রোগী নয় তারাও ব্যবহার করবেন।
২. বাড়ির আশপাশে কোথাও জল জমতে দেয়া যাবে না। জল জমে থাকলে মশার বংশবিস্তার খুব সহজ হয়। জল জমে থাকতে পারে এমন জায়গাগুলো সপ্তাহে অন্তত একদিন করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
৩. সারা শরীর ঢাকা থাকে এমন জামা-কাপড় পরিধান করুন। যেমন- ফুল হাতা শার্ট, লম্বা প্যান্ট এবং জুতা ও মোজা।
৪. ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশা ভোর থেকে সন্ধ্যা বেলা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। তাই এই সময়টাতে সবাই একটু বেশি সজাগ থাকবেন।
৫. রাতে শোয়ার সময় অবশ্যই মশারী ব্যবহার করুন।
৬. মশা নিরোধক কেমিক্যাল যেমন পারমেথ্রিন ব্যবহার করতে পারেন।
পরিশেষে বলা যায়, ডেঙ্গু জ্বর একটি সাধারন রোগ। এই রোগ হলে লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করলেই হয়। শহরে যেমন এই রোগের প্রকোপ বেশি তাই শহরের মানুষের একটি বেশি সতর্ক থাকা উচিত।
আর জ্বর হলে আপাতত সাধারন চিকিৎসা নিন। লক্ষণগুলো মারাত্মক পর্যায়ে চলে আসলে দ্রুত সময়ের মধ্যে আপনার নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসা নিন। সবার সুস্থতা কামনা করছি।
আরও পড়ুন: ১ দিনে ৯০০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি – রেকর্ড