মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তার মন্ত্রিসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এর খসড়া অনুমোদন পায় ২০১৮ সালে। পরবর্তীতে এই আইন চূড়ান্ত অনুমোদন পায়।
আমরা বেশিরভাগ মানুষই বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করি। সেই হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে আমাদের সবারই জানা দরকার।
কারণ, সবার নিরাপত্তার স্বার্থেই এটা করা হয়েছে। কেউ যেন কাউকে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় হেনস্থা করতে না পারে এবং করলেও যেন যথেষ্ট শাস্তি ভোগ করে।
যদি আইনই না থাকে তবে তার বিচার কিভাবে হবে? তাই এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তো চলুন জেনে নিই – ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আদ্যোপান্ত।
জানা প্রয়োজন যে, এই আইন কার্যকর হলে বিলুপ্ত হবে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারাসহ কয়েকটি ধারা।
তার বদলে এসব ধারার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে অপরাধের প্রকৃতি অনুযায়ী শাস্তির বিধান রাখা হচ্ছে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
নতুন আইনে মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা, ধর্ম অবমাননা, মানহানির মতো সাইবার অপরাধের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে সাজার বিধান রাখা হয়েছে।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল ও নিরাপত্তা এজেন্সি গঠনের কথা বলা হয়েছে যেটা খুব শীঘ্রই হয়তো হয়ে যাবে।
আইনের ২১ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা, প্রচারণা ও মদদ দিলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
এর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের সাজার পাশাপাশি জরিমানা দিতে হবে ৫০ লাখ টাকা।
২৮ ধারায় বলা হয়েছে, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত দিলে ভোগ করতে হবে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড।
অন্যদিকে, ২৯ ধারায় মানহানিকর কিছু প্রচার বা প্রকাশ করলে সাজা হবে তিন বছরের।
৩০ ধারা অনুযায়ী- কোনো ব্যাংক, বীমা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন বহির্ভূতভাবে ই-ট্রানজেকশন করলে সর্ব্বোচ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
এছাড়া হ্যাকিং, কম্পিউটারের সোর্স কোড ধ্বংস ও সরকারি তথ্য বে-আইনিভাবে ধারণ, প্রেরণ ও সংরক্ষণ করলে আছে নানা শাস্তি ও জরিমানার বিধান।
নতুন আইনের বেশিরভাগ ধারাই জামিন অযোগ্য। তবে এর মধ্যে মানহানির ২৯ ধারাসহ ২০, ২৫ ও ৪৮ ধারার অপরাধে জামিনের বিধান আছে।
আইন বাস্তবায়নে থাকছে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি। আর তদারকিতে থাকবে উচ্চ পর্যায়ের ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল। আর এর প্রধান হবেন প্রধানমন্ত্রী।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব দাবি করেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা সাংবাদিকদের জন্য নিপীড়নমুলক কোনো ধারা যুক্ত হয়নি।
আইনটির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো এক নজরে তুলে ধরা হলো:
বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ:
১. ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি গঠন করা হবে। ডিজি হবেন সংস্থার প্রধান। তিনি ক্ষতিকর তথ্য অপসারণ ও ব্লক করার জন্য বিটিআরসিকে অনুরোধ করবেন।
২. ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত বা এর কোনো অংশ যদি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্য করে বা জাতিগত বিদ্বেষ বা ঘৃণার সৃষ্টি করে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উক্ত তথ্য অপসারণ বা ব্লক করার জন্য বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে।
৩. ইমার্জেন্সী রেসপন্স টিম গঠন করা যাবে। সার্বক্ষণিক মনিটরের জন্য জাতীয় কম্পিউটার মনিটরিং টিম থাকবে।
৪. ১১ সদস্যের ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব। এর প্রধান হবেন প্রধানমন্ত্রী।
অপরাধ ও দণ্ড:
১. ১৭ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোয় বে-আইনি প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন, বিনষ্ট বা অকার্যকরের চেষ্টা করে, তাহলে অনধিক সাত বছরের জেল, জরিমানা ২৫ লাখ টাকা। ক্ষতি সাধন করলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদন্ড। জরিমানা এক কোটি টাকা।
২. ১৮ ধারা অনুযায়ী- ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা কম্পিউটার সিস্টেমে বেআইনি প্রবেশ বা সহায়তা করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা ১০ লাখ টাকা।
৩. ১৯ ধারা মতে, বেআইনিভাবে যদি কোনো ব্যক্তি কোনো কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম হতে কোনো উপাত্ত, উপাত্ত ভাণ্ডার, তথ্য বা উদ্বৃতাংশ সংগ্রহ করেন বা কোনো উপাত্তের অনুলিপি সংগ্রহ করেন, তাহলে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা ১০ লাখ টাকা।
৪. ২০ ধারা অনুযায়ী, কম্পিউটার সোর্স কোড পরিবর্তন বা ধ্বংস করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের সাজা সাথে জরিমানা তিন লাখ টাকা।
৫. ২১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা, প্রচারণা ও মদদ দিলে সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা ৫০ লাখ টাকা।
৬. ২৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করে এবং জনগণের মাঝে ভয়-ভীতি সঞ্চারের জন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে বৈধ প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বা করায়, তাহলে সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছর কারাদণ্ড সাথে জরিমানা এক কোটি টাকা।
৭. ২৮ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো কিছু ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচার করে, তাহলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের সাজা এবং জরিমানা ২০ লাখ টাকা।
৮. ২৯ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে পেনাল কোডের ৪৯৯ ভঙ্গ করে কোনো অপরাধ করেন তাহলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করবেন এবং জরিমানা পাঁচ লাখ টাকা।
৯. ৩০ ধারা অনুযায়ী- কোনো ব্যাংক, বীমা বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আইন বহির্ভূতভাবে ট্রানজেকশন করলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং সাথে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা।
১০. ৩২ ধারা মতে, যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ ও সংরক্ষণ করেন বা সহায়তা করেন, তাহলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা এবং ২৫ লাখ টাকা জরিমানা।
১১. ৩৪ ধারা অনুযায়ী- যদি কোনো হ্যাকিং করেন তাহলে সর্ব্বোচ ১৪ বছরের সাজা এবং জরিমানা এক কোটি টাকা।
পরিশেষে বলা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সবার জন্য দরকারি ছিল। কারণ, বর্তমান যুগে ডিজিটাল পদ্ধতিতে মানুষ বেশি অপরাধ করছে।
তাই এসব অপরাধীকে শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা উচিত। আমরা ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছি এবং বাংলাদেশও এদিক থেকে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। তাই ডিজিটাল আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই স্বচ্ছতা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন: ফেসবুক আইডি হ্যাক হলে যা করবেন জেনে নিন।