ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে জরুরী ১০ বিষয়:
ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যদি আপনি তা নিয়ন্ত্রণে না রাখেন তবে আপনার অনেক সমস্যা হতে পারে। ডায়াবেটিস একটি জটিল রোগের মধ্যে পড়ে। কারণ, এই রোগের কারণে আপনার শরীরে আরও নানারকম ব্যাধি বাসা বাঁধে।
কিছু নিয়ম-কানুন যদি মেনে চলেন এবং ঠিকমতো চিকিৎসা করেন তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর ডায়াবেটিস যখন নিয়ন্ত্রণে থাকে তখন আপনি নিজেকে সুস্থ্য ভাবতে পারেন।
আজ এই নিবন্ধে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ১০টি নির্দেশনা থাকবে। এই রোগটি নিয়ন্ত্রণের জন্য এই নির্দেশনাগুলো খুবই জরুরী। নিম্নে সেগুলো বর্ণিত হলো:
১। রক্তের সুগার পরীক্ষা করুন:
ডায়াবেটিস শনাক্ত করার জন্য রক্তের সুগার পরীক্ষা করতে হয়। সবচেয়ে সঠিক ও সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতিটি হলো ওরাল গ্লুকোজ টেস্ট বা ওজিটিটি পরীক্ষা।
এই পদ্ধতিতে প্রথমে খালি পেটে (সকালে) রোগীর রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করতে হবে। এরপর অন্তত ৭৫ মিগ্রা গ্লুকোজ এর শরবত পান করার দুই ঘন্টা পর আবার গ্লুকোজ পরীক্ষা করতে হয়।
তাহলে রক্তে কি পরিমাণ গ্লুকোজ আছে তা খুব সহজেই নির্ণয় করা যায়। ডায়াবেটিস হয়েছে কিনা এবং হলে তা কোন পর্যায়ে আছে তা বোঝা যায়।
২। ব্লাড প্রেসার বা রক্তচাপ:
হৃদপিণ্ড রক্তকে প্রতি মুহূর্তে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেয়। শরীরের লক্ষ-কোটি পরিমাণ কোষগুলোতে অক্সিজেন ও অন্যান্য নিউট্রিশন বহন করে রক্ত।
আর দূষিত পদার্থ, কার্বন ডাই অক্সাইড এগুলো বের করে দেয়। এই রক্ত যখন ধমনী বা শিরার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন পার্শ্ব দেয়ালগুলোতে চাপ সৃষ্টি করে । এই চাপের নামই রক্তচাপ।
ডায়াবেটিস হলে অবশ্যই আপনার রক্তচাপ সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। রক্তচাপ খুব কম বা বেশি হলে বিভিন্ন ধরণের জটিল সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন। তাই নিয়মিত রক্তচাপ মেপে নিন। অতঃপর চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৩। লিপিড প্রোফাইল:
কোলেস্টেরল নামক এক ধরণের চর্বি জাতীয় পদার্থ রক্তে থাকে। রক্তের কোলেস্টেরল মূলত দুই ধরণের। একটি হলো ক্ষতিকর এবং অন্যটি উপকারী। যেটি ক্ষতিকর সেটি রক্তনালীর ভেতরে জমা হয়ে থাকে এবং রক্ত চলাচলে বাধা দেয়।
ক্ষতিকর এই কোলেস্টেরলকে বলা হয় LDL (এল,ডি,এল)। আর HDL (এইচ,ডি,এল) কে বলা হয় ভালো কোলেস্টেরল। এই HDL ক্ষতিকর LDL কোলেস্টেরলকে রক্ত থেকে সরিয়ে ফেলতে সাহায্য করে।
রক্তের কোলেস্টেরল মাপার জন্য ফাস্টিং লিপিড প্রোফাইল নামের একটি পরীক্ষা করতে হয়। ১২ ঘন্টা পানি ছাড়া অন্য কোনো খাবার না খেয়ে থেকে পরীক্ষাটি করতে হয়। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের বছরে একবার এই পরীক্ষাটি করতে হয়।
৪। চোখের যত্ন নিন:
যদি আপনার টাইপ-২ কিংবা ইনসুলিন নিরপেক্ষ ডায়াবেটিস নির্ণীত হয় তবে অবশ্যই চোখের পরীক্ষা করতে হবে। প্রতি বছর অন্তত একবার চোখের পরীক্ষা করবেন।
তবে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে, রক্তচাপ যদি স্বাভাবিক থাকে এবং কোলেস্টেরল এর মাত্রা যদি স্বাভাবিক থাকে তবে চোখের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে।
৫। পায়ের যত্ন নিন:
ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ে যাতে আঘাত না লাগে সেদিকে নজর রাখতে হবে। বিশেষ করে খালি পায়ে হাঁটা যাবে না। জুতার তলা যাতে নরম হয় সেরকম জুতা পরতে হবে।
জুতা যাতে প্রশস্ত হয় সেদিকেও খেয়াল রাখবেন। চাপ লেগে থাকে এমন জুতা-মুজা ব্যবহার করা উচিত নয়।
নিয়মিতভাবে নিজের পায়ের দিকে নজর রাখতে হবে। যদি পা ফেঁটে যায় শুষ্কতার কারণে তাহলে ভেসলিন কিংবা আর্দ্রতা দেয় এমন মলম লাগাতে পারেন।
৬। কিডনির খেয়াল রাখুন:
ডায়াবেটিস রোগীদের সাধারণত কিডনীর সমস্যা হতে পারে। কিডনীতে নানা ধরণের রোগ হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ কিডনীর রক্তনালীগুলোর চরম ক্ষতি করে থাকে। তখন কিডনী ঠিক মতো কাজ করতে ব্যর্থ হয়।
কিডনীতে সমস্যা হলে শুরুর দিকে কোনো প্রকার লক্ষণ বা উপসর্গ নাও থাকতে পারে। তাই বসে থাকা যাবে না। অবশ্যই নিয়মিত কিডনীর পরীক্ষা করতে হবে।
কিডনী যাতে সুস্থ্য রাখা যায় তাই নিয়মিত কিডনী পরীক্ষা করতে হবে। কিডনী ঠিক মতো কাজ করছে কিনা তা জানার জন্য বছরে অন্তত দুটি পরীক্ষা করা উচিত। সেগুলো হলো প্রস্রাব পরীক্ষা এবং রক্ত পরীক্ষা।
এই পরীক্ষাগুলো করতে খুব বেশি টাকা খরচ হয় না। সব ধরণের ফ্যামিলির পক্ষেই বছরে দুই বার এই পরীক্ষাগুলো করা সম্ভব।
৭। মানসিক সহায়তা গ্রহণ করুন:
ডায়াবেটিস হলে অনেকেই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। মনে করেন, আমি আর মনে হয় বাঁচবো না। ডায়াবেটিস আসলে কোনো রোগ নয়। রোগের উপসর্গ মাত্র। তবে একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা নিয়ে জীবন-যাপন করাকে অনেকেই কঠিন মনে করবেন এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু তারপরেও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে এবং নিয়মিত চেক আপ করলে স্বাস্থ্য জটিলতাহীন একটি সুন্দর জীবন-যাপন করা সম্ভব।
৮। ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানুন:
যাদের ডায়াবেটিস হয় তাদের অধিকাংশই ডায়াবেটিস সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। বিশেষত; গ্রামে-গঞ্জে যারা থাকেন তাদের মধ্যে এই হার অনেক বেশি।
ডায়াবেটিস আপনার শরীরে কি করে এবং এটা নিয়ন্ত্রণের জন্য আপনার কি করা দরকার এসব ব্যাপারে অবশ্যই আপনার ধারণা থাকতে হবে।
আপনি ডাক্তারের কাছে গেলে এসব বিষয়ের সব জানতে পারবেন। প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছ থেকে একটি বুকলেট নিতে পারেন যেখানে ডায়াবেটিস সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য থাকবে। ডায়াবেটিস সম্পর্কে আপনি যখন জানবেন তখন আপনার মধ্যে সচেতনতা বাড়বে।
৯। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
এ রোগ হলে হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য উপকার নাও পেতে পারেন। আর তাই ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ কিংবা এন্ডোক্রাইন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।
ডায়াবেটিস হলে যেহেতু শরীরের অন্যান্য অঙ্গসমুহেও নানাবিধ রোগ হতে পারে সুতরাং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ারও প্রয়োজন আপনার হতে পারে।
১০। ধুমপান ত্যাগ করুন:
ডায়াবেটিস হলে সাধারণত হার্টের রোগ ও স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। আর যখন একজন ডায়াবেটিস রোগী ধুমপান করে তখন এই ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।
ধুমপান করার কারণে শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্ত চলাচলে বাঁধা সৃষ্টি হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার যতোগুলো কারণ রয়েছে তন্মধ্যে ধুমপান একটি। তাছাড়া, চোখের দেখার শক্তি কমে যায় এবং স্নায়ুর নানাবিধ ক্ষতি হতে পারে।
তাই ধুমপান করা যাবে না। ধুমপান ছাড়ার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন। প্রয়োজনে ওষুধ সেবন ও কাউন্সেলিং করতে পারেন। সব কিছুই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে করবেন এবং এতে করে প্রক্রিয়াটি আপনার কাছে খুব সহজ হয়ে উঠবে।
আরও পড়ুন: ডায়াবেটিস রোগ থেকে মুক্তির উপায় – গাছ-গাছড়ার ওষুধ।
ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীরা প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাবেন না। তবে সকালে এবং বিকেলে হাঁটার অভ্যাস করতে হবে।
কোভিড-১৯ এর এই সময় নিজের প্রতি কঠোর হোন। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলুন। আর যে ঘরে অবস্থান করবেন সেখানে যাতে আলো-বাতাসের সুব্যবস্থা থাকে।
চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ পরিবর্তন করবেন না। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনুন আপনার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী।
ডায়াবেটিস শুধু নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। তাহলেই একটি সুন্দর জীবন পাওয়া সম্ভব। কিছু নিয়ম-কানুন ও বিধি-নিষেধ মেনে চলার পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করে সুস্থ্য জীবন-যাপন করা সম্ভব।