ডায়রিয়া এমন একটি রোগ যার নাম সবাই শুনেছে। জীবনে সবাই একবার হলেও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। মারাত্মক আকারের ডায়রিয়া জীবন নাশও করতে পারে।
বাচ্চাদের জন্য ডায়রিয়া খুবই মারাত্মক। সেক্ষেত্রে চরম সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। আজ আমরা ডায়রিয়া নিয়ে আলোচনা করবো। আশা করি, আলোচনাটি কাজে আসবে। তো আর কথা নয় – সরাসরি যাচ্ছি মূল আলোচনায়।
বাচ্চা বা নবজাতকের ডায়রিয়া:
নবজাতক, বয়স ১০ দিন। বারবার পাতলা পায়খানা করছে অর্থাৎ ডায়রিয়া। সে শুধু মায়ের দুধ খাচ্ছে। মা-বাবা উদ্বিগ্ন, মায়ের দুধ খাওয়া সত্ত্বেও শিশুর কেন ডায়রিয়া?
যে শিশু শুধু মায়ের দুধ খায় তাদের অনেকেরই এ রকম সমস্যা দেখা দেয়। মায়ের দুধই শিশুর সেরা খাবার, এটা আমরা সবাই জানি।
মায়ের দুধ শিশুকে অনেকভাবে ভালো রাখে। তবে তার পাশাপাশি মায়ের দুধে এমন কিছু আছে, যা খেলে শিশুর বারবার পাতলা পায়খানা হতে পারে।
কখনো পানি বেশি থাকে, কখনো সবুজ বা ফেনা ফেনা পায়খানা হয়। এমনকি দিনরাত ২৪ ঘণ্টায় ২৪ বারও পায়খানা হতে পারে।
শিশুর ডায়রিয়া হচ্ছে ভেবে অনেক মা-বাবাই নিজে নিজে মায়ের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেন অথবা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের অনেক চিকিৎসকও এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেন। শিশুর পায়খানা পরীক্ষা করান এবং রিপোর্টে গ্লুকোজ যাচ্ছে কি না দেখেন।
মায়ের দুধের গ্লুকোজ বা শর্করাজাতীয় খাদ্য শিশুর সহ্য হচ্ছে না-এ কথা বলে বুকের দুধ খাওয়ানোয় মাকে নিষেধ করেন বা নিরুৎসাহিত করেন এবং গুঁড়ো দুধ খাওয়ানোর জন্য লিখে দেন।
এ ক্ষেত্রে মাকে বলছি, এ নিয়ে আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে থাকুন, আস্তে আস্তে এ সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে।
তবে যদি পাতলা পায়খানার পাশাপাশি পানিশূন্যতা থাকে, শিশু নিস্তেজ বা দুর্বল হয়ে যায় বা জ্বর থাকে, তাহলে চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে নিয়ে যান।
আবারও বলছি, মায়ের দুধই শিশুকে ভালো রাখবে। ভালো থাকুন আপনি, ভালো থাকুক আপনার শিশু-সব সময়।
উৎস: প্রথম আলো
রোটা ভাইরাসে শিশুর ডায়রিয়া:
শিশুরা বিভিন্ন কারণে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ রোগে অনেক শিশুকে অকালেই মৃত্যুবরণ করতে হয়। রোটা ভাইরাস ডায়রিয়া বিশ্বের একটি অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ১১১ মিলিয়ন শিশু রোটা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ছয় লাখ শিশুর মৃত্যু হয়।
এদের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশে শিশুমৃত্যুর হার শতকরা ৮২ ভাগ। উন্নত দেশে মৃত্যুর হার অবশ্য অনেক কম। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় বিলম্ব এবং পুষ্টির অভাবই শিশুমৃত্যুর হার বেশি হওয়ার কারণ।
রোটা ভাইরাস কী:
চারপাশে বিভিন্ন ধরনের রোগ-জীবাণু ও ভাইরাস বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এগুলো সংক্রমিত হলে রোগাক্রান্ত হয়ে থাকে।
রোটা ভাইরাস হচ্ছে রিওভাইরাইড পরিবারের একটি ভাইরাস। দেখতে চাকার মতো। ‘রোটা’ লাতিন শব্দ, অর্থ হচ্ছে ‘চাকা’।
পরিসংখ্যান:
শতকরা ৯৫ ভাগ শিশুর তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে ডায়রিয়া হয় রোটাভাইরাসে। আক্রান্ত শিশুরা মারাত্মক পানিশূন্যতায় ভোগে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম এমন শিশু, যারা ডায়ারিয়ার আক্রান্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ ছিল রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত।
কীভাবে সংক্রমিত হয়?
রোটা ভাইরাস মল ও মুখগহ্বর দিয়ে খাদ্যনালিতে প্রবেশ করে। এই ভাইরাস আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে এবং একজনের কাছ থেকে অন্যজনের শরীরে প্রবেশ করে।
সংক্রমিত পানি, খাবার, খেলনা ও আসবাবপত্রের মাধ্যমেও এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। রোটা ভাইরাসে সংক্রামিত হওয়ার ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মানুষের শরীরে এর প্রতিক্রিয়া শুরু হয়।
কী হয়?
প্রথমে শুরু হয় বমি। এরপর আস্তে আস্তে পানির মতো পাতলা পায়খানা। খুব কম সময়ের মধ্যে ডায়রিয়া তীব্র আকার ধারণ করে।
পানিশূন্যতা এত বেশি হয় যে সময়মতো চিকিৎসা দেওয়া না গেলে জীবননাশের আশঙ্কাও দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া জ্বর ও পেটব্যথাও থাকতে পারে। নয় দিন পর্যন্ত থাকতে পারে বমি ও জ্বর। ডায়রিয়া থাকতে পারে ২১ দিন।
রোটা ভাইরাস বোঝার উপায়:
সংক্রামিত মল পরীক্ষা করলে এ ভাইরাস দেখা যায়। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করলে এটি দেখা যায়। এর আকৃতি চাকার মতো।
চিকিৎসা:
পানিশূন্যতা পূরণ করার জন্য ঘন ঘন খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। পানিশূন্যতা বেশি হলে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে স্যালাইন দিয়ে পানিশূন্যতা পূরণ করতে হবে।
ইলেকট্রলাইট বা রক্তে খনিজ লবণ কমে গেলে তা পূরণ করতে হবে। কোনো অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন নেই। রোটা ভাইরাসের জন্য কোনো অ্যান্টিভাইরাস ওষুধ নেই।
প্রতিষেধক:
রোটা ভাইরাস ডায়রিয়া থেকে মুক্ত থাকার জন্য দুভাবে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। প্রথমত, যেসব স্থানে রোটা ভাইরাস অবস্থান করে, সেগুলো পরিষ্কার করা।
যেমন ডায়েপার, খেলনা, মল; যেসব জায়গায় ডায়েপার বদলি করা হয় (বাসায় বা ডে-কেয়ার সেন্টারে), হাত পরিষ্কার করার স্থানে, এমনকি খাবার তৈরি করার স্থানেও এই ভাইরাস পাওয়া যায়।
এটি অনেক দিন বেঁচে থাকে। এসব স্থান ও খেলনা প্রতিদিন অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। অ্যান্টিসেপটিক সাবান দিয়ে হাত ও মলদ্বার পরিষ্কার করা দরকার।
দ্বিতীয়ত, টিকা দিয়ে রোটা ভাইরাস ডায়রিয়া থেকে দূরে থাকা যায়। প্রতিষেধক হিসেবে রোটা ভাইরাসের টিকাও রয়েছে।
কখন রোটা ভাইরাসের টিকা দিতে হবে:
শিশুর দেড় থেকে ছয় মাস বয়সের মধ্যে। এই টিকা মুখে খাওয়ানো হয়। প্রথম ডোজ দেওয়ার পর দ্বিতীয় ডোজ এক মাস পর দিতে হয়।
টিকা দিলে রোটা ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়া হবে না। তাই শিশুকে রোটা ভাইরাস ডায়রিয়া থেকে মুক্ত রাখতে সময়মতো টিকা দিতে ভুলবেন না।
উৎস: প্রথম আলো
ডায়রিয়া প্রতিরোধ ও প্রতিকার:
গরমের এই শুরুর সময়টায় ডায়রিয়া হওয়ার ঘটনা সাধারণত বেশি ঘটতে দেখা যায়। সাধারণত চিকিৎসা চলার পরও ডায়রিয়া না কমলে এবং তা যদি ১৪ দিনের বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন তাকে ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া বলে।
শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণত রোটা ভাইরাসের আক্রমণে ডায়রিয়া হয়। বড়দের ক্ষেত্রে বাইরের খোলা খাবার খেলে, দূষিত পানি পান করলে ডায়রিয়া হয়ে থাকে। রোটা ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়া ও ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে কলেরা হয়।
ডায়রিয়ার লক্ষণ:
১. ২৪ ঘণ্টায় তিনবার বা এর বেশি পানিসহ পাতলা পায়খানা হওয়া।
২. শরীর দুর্বল হওয়া।
৩. খাওয়ায় রুচি কমে যাওয়া।
৪. ডায়রিয়া শুরুর প্রথম দিকে বমি হয়। পরে অনেক ক্ষেত্রে বমি কমে যায়।
৫. জ্বর এলেও তা খুব একটা তীব্র হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শরীর হালকা গরম থাকে।
ডায়রিয়া প্রতিরোধে যা করবেন:
বড়দের পাশাপাশি শিশুদেরও খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। নখ কেটে সব সময় ছোট রাখতে হবে।
বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। তারা বাইরে খেলাধুলা করে, ঘরের ছোট ছোট জিনিস হাতে নিয়ে মুখে দেয়। তাই সব সময় হাত পরিষ্কার রাখা উচিত।
নিজেদেরও তা করতে হবে। শিশুদের দায়িত্বও নিতে হবে। খাবার সব সময় ঢেকে রাখা উচিত। পরিষ্কার স্থানে খাবার রাখতে হবে।
তা না হলে মাছি বা অন্যান্য রোগবাহিত কীটপতঙ্গ খাবারে বসতে পারে। এগুলোর মাধ্যমে রোগ ছড়াতে পারে। শৌচাগার থেকে আসার পর সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে।
হাতের কাছে সাবান না থাকলে ছাই দিয়ে হাত ধুতে হবে। তখন বেশি পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত। প্রতিটি বাসাবাড়িতে খাওয়ার স্যালাইন ও জিংক ট্যাবলেট সব সময় রাখা উচিত।
জিংক ট্যাবলেট খেলে অনেক সময় শিশুদের বমি হয়। তখন তা খাওয়ানো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। বমি বন্ধ হলে ১০ দিনের মধ্যে ওষুধের কোর্স সম্পন্ন করা উচিত। তাতে ভবিষ্যতে ডায়রিয়া হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।
চিকিৎসা:
ডায়রিয়ার সবচেয়ে বড় ওষুধ খাওয়ার স্যালাইন। বড়দের ক্ষেত্রে চালের স্যালাইন খাওয়ানো যেতে পারে। এতে শরীরে খাবারের ঘাটতি পূরণ হয়।
ডায়রিয়া হলে যেহেতু শরীরে লবণ-পানির স্বল্পতা হয়, তাই তা পূরণ করাই হবে প্রধান লক্ষ্য। অনেকে মনে করেন, ডায়রিয়া হলে স্বাভাবিক খাবার খাওয়া যাবে না। ব্যাপারটা ঠিক নয়।
রোগীর সব সময় শুধু স্যালাইন খেতে ভালো না-ও লাগতে পারে। তাই রোগীর রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী খাবার খেতে দিতে হবে। তবে স্বাভাবিক খাবার একটু নরম করে খাওয়ানো উচিত।
খাওয়ার স্যালাইনের পাশাপাশি ডাবের পানি ও যেকোনো ফলের রস খাওয়ানো যায়। ডায়রিয়া হলে চিকিৎসকেরা অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন।
অল্প আকারে ডায়রিয়া হলে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া উচিত নয়। এতে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। বেশি অ্যান্টিবায়োটিক খেলে কোনো রোগ হলে তা আর কাজ করবে না। অবশ্য ডায়রিয়া বেশি হলে তা যেন আর না ছড়ায়, সে জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যেতে পারে।
আজিথ্রো মাইসিন ৫০০ মিলিগ্রামের দুটো ক্যাপসুল আধা ঘণ্টা পর পর খাওয়ানো যায়। তবে খালি পেটে খাওয়ানো উচিত নয়। বমি হতে পারে।
বমির সঙ্গে ওষুধ বেরিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি ট্যাবলেট খাওয়ানো উচিত। অনেক ক্ষেত্রে সিপ্রোসিন দেওয়া হয়। তিন দিন ১২ ঘণ্টা পর পর এই ওষুধ খাওয়ানো হয়ে থাকে।
তবে পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় কথা, নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সব কাজ করতে হবে।
পানি যেভাবে বিশুদ্ধ করবেন:
১. পানি পান করার আগে ভালোভাবে ফুটিয়ে নিতে হবে।
২. কমপক্ষে ১০ মিনিট পানি ফোটালে তাতে রোগজীবাণু থাকে না।
৩. এরপর পাত্রে পানি কিছুক্ষণ রেখে দিন। যদি কোনো ময়লা থাকে তবে নিচে পড়ে যাবে।
৪. পরে ওপরের অংশের পানি ছেঁকে আলাদা পাত্রে ঢেলে নিতে হবে।
৫. এ ছাড়া বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়েও পানি বিশুদ্ধ করা যায়।
৬. বেশির ভাগ সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পানি বিশুদ্ধকরণট্যাবলেট বিনা মূল্যে পাওয়া যায়।
৭. এসব ট্যাবলেট পানি সংরক্ষণ ট্যাংকে দিয়েও পানি বিশুদ্ধ করা যায়।
উৎস: প্রথম আলো
ডায়রিয়ার কারণে কি প্যারালাইসিস হয়?
শুভর বয়স ২০ বছর। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। হঠাৎ একদিন রাতে শোবার সময় মনে হতে লাগল পায়ের নিচে কেমন যেন একটু কামড়াচ্ছে।
ভাবলেন, আজকে হয়তো একটু বেশি হাঁটাচলা হয়েছে, সে জন্য এমনটি হচ্ছে। পাত্তা না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে দেখেন পা যেন অবশ হয়ে গেছে এবং কেমন যেন ঝিনঝিন করছে।
পা দুটো খুব একটা নাড়াতে পারছেন না। মাকে ডাকতে লাগলেন। মা-বাবা তখনই হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। চিকিৎসক শুভকে পরীক্ষা করে জিজ্ঞাসা করলেন, দু-চার সপ্তাহখানেক আগে শুভর কোনো পাতলা পায়খানা হয়েছিল কি না।
মা বললেন, দুই-তিন সপ্তাহ আগে পাতলা পায়খানা হয়েছিল। কিন্তু এত সামান্য ছিল যে ওষুধ পর্যন্ত লাগেনি। চিকিৎসক ছোট্ট একটা হাতুড়ি দিয়ে হাত ও পায়ে হালকা বাড়ি দিয়ে দেখলেন শুভর কোনো রিফ্লেক্স নেই।
তারপর বললেন, শুভর জিবিএস হয়েছে। অর্থাৎ ডায়রিয়া থেকে প্যারালাইসিস। শুভর মা-বাবা কোনো দিন এই রোগের নাম শোনেননি বা রোগ দেখেননি।
এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করায় চিকিৎসক বললেন, জিবিএস রোগটি নার্ভের রোগ। সাধারণত এই রোগ হওয়ার দুই থেকে চার সপ্তাহ আগে রোগীর ডায়রিয়া বা হালকা ঠান্ডা, জ্বর, কাশি হতে পারে। তারপর ডায়রিয়া ভালো হয়ে যায়।
ডায়রিয়া হওয়ার দুই থেকে চার সপ্তাহ পর হঠাৎ করে শুভর মতো প্যারালাইসিস হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পা থেকে প্যারালাইসিস ওপর দিকে উঠতে থাকে।
প্যারালাইসিস যখন বুকে ধরে, তখন রোগী শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে না। হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হতে হয় এবং মেশিনের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হয়।
নতুবা রোগী মারা যায়। আমাদের শরীরের নার্ভকে তুলনা করা যেতে পারে ইলেকট্রিক তারের সঙ্গে। অর্থাৎ ইলেকট্রিক তারের বাইরে যেমন প্লাস্টিক আছে তেমনি নার্ভের বাইরে একটা আবরণ আছে, তাকে মাইলিন বলে।
এটা নষ্ট হলে আবার তৈরি হয়। ইলেকট্রিক তারের ভেতরে যেমন ধাতু আছে, তেমনি নার্ভের ভেতরও আছে। তাকে বলে এক্সজোন। এটা নষ্ট হলে তৈরি হয় না।
যখনই ডায়রিয়া হয়, তার পরপরই শরীরে একটা রি-অ্যাকশন হয়। এই রি-অ্যাকশনটা নার্ভের ভেতরের এক্সজোন বা বাইরের মাইলিনের ওপর হতে পারে।
এক্সজোনের মধ্যে হলে খুবই খারাপ, ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু মাইলিনের ওপর হলে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব।
আমাদের দেশে ডায়রিয়া একটা কমন রোগ।
এই ডায়রিয়া বিভিন্ন জীবাণু দিয়ে হতে পারে। এসব জীবাণুর মধ্যে কেমফাইলো জেজুনি দ্বারা একটা বিরাট অংশ হয়। সাধারণত পানিবাহিত বা খাদ্যের মধ্য দিয়ে এই জীবাণু শরীরে ঢোকে।
এই জীবাণু দিয়ে ডায়রিয়া হলেই জিবিএস বা প্যারালাইসিস হতে পারে। ঢাকা কলেরা হাসপাতালের (আইসিডিডিআরবি) মাধ্যমে নেদারল্যান্ড থেকে কিছু চিকিৎসক বাংলাদেশে আসেন এই জিবিএস রোগের ওপর রিসার্চ করার জন্য।
তারা বাংলাদেশি চিকিৎসকদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এই জিবিএস রোগী সংগ্রহ করে তাঁদের রক্ত, সিএসএফ ও নার্ভ পরীক্ষা করে।
এতে প্রকাশ পায় যে ৫৭ শতাংশ জিবিএস এই কেমফাইলো জেজুনি জীবাণু দিয়ে হয়েছে। এই জিবিএসের ২৫ শতাংশ আইসিইউতে ভর্তি হয়েছে, ৬৭ শতাংশ এক্সজোনাল জিবিএস।
অর্থাৎ নার্ভের ভেতরের ধাতুতে ধরে, অর্থাৎ তাদের ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার। ১৪ শতাংশ রোগী মারা যায়। ২৯ শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসেবে বেঁচে থাকে।
সুতরাং কেমফাইলো জেজুনি জীবাণু একটু সামান্য ডায়রিয়ায় কী সাংঘাতিক রোগের সৃষ্টি করে! এই জিবিএসের চিকিৎসার কোনো বিশেষ ওষুধ নেই।
আইভিআইজি বা প্লাজমা এক্সচেঞ্জ অর্থাৎ শরীরের সব রক্তের পানি ফেলে দিয়ে নতুন করে রক্তের পানি শরীরে ঢোকানো হয়। এগুলো আমাদের দেশে আছে, তবে খুবই ব্যয়বহুল, যা সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের বাইরে।
ওই নেলারল্যান্ডের স্টাডিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এক্সজোনাল ভ্যারাইটির জিবিএসটা খুব বেশি হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওই কেমফাইলো জেজুনি দিয়ে হয়। এই জিবিএস রোগীর মৃত্যুহারও বেশি এবং যারা বেঁচে থাকছে তারা শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে বাঁচছে।
পরামর্শ:
১. নিরাপদ পানি ও খাদ্যের দিকে খেয়াল করুন।
২. হাত খুব ভালো করে ধুয়ে খাবার ধরুন।
সেলিনা ডেইজী
সহযোগী অধ্যাপক, নিউরোলজি বিভাগ ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা। সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৮, ২০১০
উৎস: প্রথম আলো
আরও পড়ুন: পিরিয়ড বা মাসিক দেরীতে হয় কেন? এমন সমস্যা হলে যা করবেন।