টিউমার:
টিউমার অনেকের শরীরেই হয়। কারও কারও কপালে হয়, পিঠে হয়, হাতের আঙুলেও হতে পারে। টিউমার হলে সাধারণত কেউ চিন্তিত হয়ে পড়ে না। কারণ, অনেকেই ভাবে যে, টিউমার তেমন কোনো ক্ষতি করে না।
কিন্তু ব্যথাহীন টিউমার থেকে ক্যান্সার হতে পারে। তাই বলে এমন নয় যে, টিউমার হলেই ক্যান্সার হবে। তবে শরীরের কোন অংশে টিউমার দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করা উচিত।
টিউমার এর প্রকারভেদ:
সাধারণত টিউমার দুই ধরণের হয়। দুই প্রকার টিউমারের নাম হলো বেনাইন এবং ম্যালিগন্যান্ট। বেনাইন টিউমার জন্মের শুরু থেকেই শরীরে থাকতে পারে। এটা তেমন ক্ষতি করে না।
আরেকটি বিষয় খুব ভালো করে জেনে রাখবেন, বেনাইন টিউমার সাধারণত ক্যান্সার সৃষ্টি করে না। বেনাইন টিউমারে ক্যান্সার সৃষ্টির প্রবণতা থাকে না।
এই টিউমার শরীরের যেখানেই হোক কেবল সেখানেই স্থির থাকে। টিউমারের কোষ সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে পড়ে না। তারপরেও কিছু ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
বেনাইন টিউমার যদি শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন রক্ত কোষ অথবা স্নায়ুতে হয়ে থাকে তবে সেখান থেকে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বেনাইন টিউমার হলে সবসময় চিকিৎসার দরকার পড়ে না। অনেক সময় চিকিৎসা ছাড়াই এই টিউমার ভালো হয়ে যায়।
অন্যদিকে, ম্যালিগন্যান্ট টিউমার এর চিকিৎসা যদি শুরুতেই করা যায় তবে তা সেরে যায়। চিকিৎসকগণ সাধারণত এ জাতীয় টিউমার অপারেশনের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেন।
অপারেশন করে বের করে দিলে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার এর ফিরে আসার প্রবণতা কম। জেনে রাখা ভালো, বেশিরভাগ ক্যান্সার ম্যালিগন্যান্ট টিউমার থেকেই হয়ে থাকে।
শরীরে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার দেখা দিলে তা ধীরে ধীরে তার চারপাশের কোষ এবং শরীরের অন্যান্য অংশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।
টিউমার থেকে ক্যান্সার হলে বুঝবেন কিভাবে?
সাধারণত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার থেকেই ক্যান্সারের সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞান থেকে জানা যায় যে, ম্যালিগন্যান্ট টিউমারে পুরোপুরি কোষ বিভাজন হয়।
বাইরে থেকে কোন টিউমার ম্যালিগন্যান্ট কিংবা কোন টিউমার বেনাইন তা কিন্তু বোঝা যায় না। তাই আপনার শরীরে কোনো সময় যদি টিউমার দেখা দেয় এবং তা যদি বড় হতে থাকে তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আমাদের জীবনে নানা সময়ে ঘটে নানারকম ঘটনা। কখনো বিভিন্ন দূর্ঘটনায় পতিত হয়ে আমরা আঘাত বা চোট পাই। অনেক সময় কেটে যায়। আপনি জানলে অবাক হবেন যে, এই আঘাত বা চোট কিংবা কেটে যাওয়ার কারণেও ক্যান্সার হতে পারে।
কিছু ক্যান্সার আছে যা কেবল ত্বকের মাধ্যমে অনুভূত হয়। এই ধরণের ক্যান্সার শরীরের স্তন (মহিলাদের ক্ষেত্রে), অন্ডকোষ বা শুক্রাশয় এর নিঃসারক গ্রন্থি এবং নরম কলাগুলোতে হতে দেখা যায়।
ক্যান্সার হলেই যে আপনার টিউমার হতে হবে এমন কিন্তু নয়। বরং শরীরের কোথাও টিউমার বা মাংস পিণ্ড ফুলে যাওয়া ক্যান্সার এর পূর্ব লক্ষণ বা শেষ পর্যায়ের লক্ষণ হতে পারে।
ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের যে ধরণ তাতে কোনো ব্যথা অনুভূত হয় না। আর তাই ম্যালিগন্যান্ট টিউমার হলে শরীরে তেমন কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় না এমনকি বোঝাও যায় না।
তবে আপনার ওজন কমে যেতে পারে। শরীরে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে। আর যখন ক্যান্সার আক্রান্ত টিউমারের আকৃতি অনেকটা বাড়তে থাকে তখন আশেপাশের স্নায়ু এবং পেশিগুলোতে চাপ পড়ে। আর সেই সময় শরীরে ব্যথা বা যন্ত্রণা বোঝা যায়।
ক্যান্সার এর লক্ষণ বা উপসর্গ:
ফুসফুস ক্যান্সারের ক্ষেত্রে: শুকনো কাশি হবে। কাশি দীর্ঘ দিন থাকবে। অনেক সময় কাশির সঙ্গে রক্ত বের হয়। ওজন কমে যায়। প্রায় সময়ই শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
লিম্ফোমা ক্যান্সারের ক্ষেত্রে: শরীরের ওজন দ্রুত কমে যায়। প্রচণ্ড পরিমাণে দূর্বলতা দেখা দেয় এবং লসিকার আকৃতি বেশ বৃদ্ধি পায়।
স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে: কিছুদিনের মধ্যেই স্তনের আকার ও ধরণে বেশ পরিবর্তন আসে। স্তনে মাংসপিণ্ডের ন্যায় হতে পারে। স্তনের বোটা (বৃন্ত) থেকে রক্ত নিঃসরণ হতে পারে।
প্রস্টেট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে: এটি মূলত পুরুষের মূত্রসংক্রান্ত বিষয়। প্রথমাবস্থায় প্রস্রাবে খানিকটা সমস্যা দেখা দেয়। কোনো কোনো সময় তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কিন্তু ক্যান্সার যখন বেশ ছড়িয়ে পড়ে তখন ব্যথা বেড়ে যায়।
বোসাল সেল ক্যান্সারের ক্ষেত্রে: এই ক্যান্সারের ক্ষেত্রে মূলত মুখ ও গলার মতো অংশগুলোর যেখানে সূর্যের আলো পড়ে এমন জায়গায় সাদা টিউমার কিংবা বাদামী রঙের ছোপের মতো দেখা যায়।
মেলানোমা স্কিন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে: আঁচিল শরীরে সাধারণত এমনিতেই হয়। আঁচিল তেমন বড় হয় না। কিন্তু হঠাৎ যদি আঁচিলের অত্যাধিক বৃদ্ধি দেখতে পান তবে তা ক্যান্সারের পূর্ব লক্ষণ। তাছাড়া শরীরের যেকোন অংশে অস্বাভাবিক বৃদ্ধিই মূলত মেলানোমা স্কিন ক্যান্সার।
কোলন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে: কোলন ক্যান্সার হলে সাধারণত মল ত্যাগে সমস্যা দেখা দেয়। মলত্যাগ করতে গেলে মলের সঙ্গে রক্ত বের হয়। পেটে ব্যথা এবং অস্বস্তি বোধ হয়। তবে কোলন ক্যান্সার ক্যান্সারের স্থান এবং আকৃতির উপর নির্ভর করে।
লিউকিমিয়া ক্যান্সারের ক্ষেত্রে: জেনে রাখা ভালো এই ক্যান্সার খুব ধীরগতিতে বড় হয়। তাই অনেক সময় রোগী নিজেই কোনো কিছু বুঝতে পারে না।
সাধারণত শারিরীক দূর্বলতা, ওজন কমে যাওয়া, রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়া, প্রচুর মাথা ব্যথা হওয়া, ঘেমে যাওয়া, ক্লান্তিবোধ, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট, ত্বকে লাল লাল ফুস্কুড়ি এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত দেখা দেয়।
ম্যালিগন্যান্ট টিউমার থেকে বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার হতে পারে। শরীরে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার দেখা দেয়া মানেই বড় ধরণের বিপদের লক্ষণ।
সব ধরণের ক্যান্সারের কিছু পূর্ব লক্ষণ থাকে। যেমন- ওজন কমে যাওয়া, ক্ষুধা কমে যাওয়া, পায়খানার সাথে রক্ত পড়া সহ ইত্যাদি।
বেশিরভাগ নারীদের এইচপিভি ভাইরাস থেকে জরায়ুর ক্যান্সার হওয়ার আশংকা থাকে। তাই আপনার শরীরে যদি উল্লিখিত লক্ষণগুলো দেখা দেয় তবে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
ভয়ের কিছু নেই। উপরোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিলেই যে আপনার ক্যান্সার হয়েছে এমন কিন্তু নয়। অন্য কারণেও উপরোক্ত লক্ষণগুলো আপনার শরীরে দেখা দিতে পারে। তাই হতাশ হবেন না।
চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে যদি-
- মহিলাদের স্তনে কোনো ধরণের ফোলাভাব আসে কিংবা মাংসপিণ্ডের সূচনা হয়।
- স্তনের ত্বক বেশি লাল হয়ে গেলে এবং চুলকানি হলে।
- স্তনের মধ্যে লাল লাল ফুস্কুড়ির মতো দেখা দিলে।
- স্তনের কোনো অংশ যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভারী মনে হয়।
- স্তনের বোটা বা বৃন্ত থেকে যদি রক্ত নিঃসরণ হয়।
- হঠাৎ করে যদি স্তনের আকারের বেশ পরিবর্তন হয়ে যায়।
ক্যান্সার প্রতিরোধের কিছু উপায়:
- কোনো ধরণের তামাক জাতীয় দ্রব্য সেবন করবেন না।
- স্বাস্থ্যসম্মত জীবন-মান বজায় রাখার চেষ্টা করুন।
- গ্রিন টি পান করুন। চায়ের সাথে প্যাকেটজাত দুধ বেশি খাবেন না।
- প্রতিদিন তরকারিতে বাদেও পেয়াজ, রসুন খাওয়ার চেষ্টা করুন।
- বহুদিন থেকে ফ্রিজে রাখা খাবার খাওয়া বন্ধ করুন। এতে শুধু আপনার ক্যান্সার নয়, অন্য রোগও হতে পারে।
- বিভিন্ন প্রয়োজনে প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার কমিয়ে ফেলুন। আর ভুল করেও প্লাস্টিকের পাত্রে কিছু খাবেন না।
- নারীদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বয়সে অবশ্যই এইচপিভি ভাইরাসের টিকা নিতে হবে।
ক্যান্সার সম্পর্কিত কিছু ভুল ধারণা:
ক্যান্সার হলেই যে মৃত্যু হবে বিষয়টি এমন নয়। শুরুতেই যদি ক্যান্সার রোগ শনাক্ত করা যায় এবং চিকিৎসা নেয়া যায় তবে ক্যান্সার সেরে যায়। আর তাই সন্দেহ হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করতে হবে।
আপনি জানলে অবাক হবেন যে, প্রায় ৫% ক্যান্সার বংশগতভাবেই হয়। বংশে কারও যদি ক্যান্সার থাকে তবে অন্যদের হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আতংকিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
আরও পড়ুন: ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে যে ১০ বিষয়ের উপর সচেতন হওয়া জরুরী।
ক্যান্সার নাকি অপারেশন করা যায় না – ধারণাটি পুরোপুরি ভুল। আবার বায়োপসি করলে নাকি ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে – এই কথাটিও ভুল।
প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সারের উপসর্গ ধরতে পারলে এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা নিলে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়। তবে তা সময় এবং ব্যয়সাপেক্ষ।
শুধু ক্যান্সার নয়, শরীরে যাই হোক কখনো ভয় পাবেন না। জন্ম নিলে একদিন মারা যেতে হবে এটাই স্বাভাবিক ও সত্য। কিন্তু অবহেলা করবেন না।
শরীরে কোনো ধরণের বিরুপ প্রতিক্রিয়া কিংবা লক্ষণ দেখা দিলে সাধ্যানুযায়ী ভালো চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরামর্শ করুন, প্রয়োজনে চিকিৎসা নিন।