জন্ডিস রোগ:
জন্ডিস (Jaundice) নামটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। রক্তশুন্যতা যেমন কোনো রোগ নয় তেমনি জন্ডিস কোনো রোগ নয়। এগুলো হলো রোগের উপসর্গ মাত্র।
জন্ডিস হলে সম্পূর্ণ শরীর হলুদাভাব ধারণ করে। মূলত বিলিরুবিন নামক এক প্রকার রঞ্জক পদার্থ বেড়ে যায় শরীরে। আর তাই এমন হয়।
শরীরে বিলিরুবিনের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা আছে যেটাকে স্বাভাবিক বলা হয়। সাধারণত ১ থেকে ১.৫ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার হলো স্বাভাবিক। এর বেশি হলেই সমস্যা সৃষ্টি হয়।
জন্ডিস হলে প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হলুদ হয়ে যায়। গায়ের চামড়া ফ্যাকাশে হয়ে যায় আর তাই এই রোগটিকে পান্ডু বা ন্যাবা রোগও বলা হয়।
বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জন্ডিসের খুব প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। তন্মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস এর কারণে জন্ডিস বেশি হয়।
জন্ডিসের প্রকারভেদ:
বেশ কয়েক প্রকার জন্ডিস রয়েছে। এগুলোকে সাধারণত তিনভাগে ভাগ করা হয়। নিম্নে তিন প্রকার জন্ডিস বর্ণিত হলো:
- প্রি-হেপাটিক – রক্তের লোহিত রক্ত কণিকা বেশি বেশি ভাঙলে হয়। যেমন- হিমোলাইটিক অ্যানেমিয়া, ম্যালেরিয়া, থ্যালাসেমিয়া।
- হেপাটিক – লিভারের মধ্যে যদি কোন সমস্যা থাকে সেই ক্ষেত্রে হয়। যেমন- ভাইরাল হেপাটাইটিস, অতিরিক্ত মদ্যপান এবং লিভার ক্যান্সার হলে।
- পোস্ট হেপাটিক – পিত্ত লিভারে তৈরী হওয়ার পর বের হবার রাস্তায় কোনো ধরণের সমস্যা থাকলে। যেমন- পিত্তথলির রাস্তায় পাথর, পিত্তনালীতে ক্যান্সার ইত্যাদি।
জন্ডিস হওয়ার কারণসমুহ:
সাধারণত বিলিরুবিন এর মাত্রার তারতম্যের কারণেই জন্ডিস হয়। এছাড়াও আরো কিছু কারণ আছে। নিচে কারণগুলো উল্লেখ করা হলো:
- হেমাটোমা’র কারণে (হেমাটোমা হলো আংশিকভাবে ত্বকের নিচে রক্তের জমাট বাঁধা)
- হেমোলাইটিক অ্যানেমিয়া
- হেপাটাইটিস ভাইরাস আক্রমণ করলে (ভাইরাসের ধরণ- হেপাটাইটিস এ, বি এবং সি)
- অত্যাধিক অ্যালকোহল সেবনের কারণে
- অটো ইমিউন ডিজিজ (Auto Immune Disease) হলে (শরীর যখন নিজের কোষগুলোকে বহিরাগত শত্রু ভেবে আক্রমণ করে)
- বিরল জেনেটিক বিপাকীয় ত্রুটি হলে
- বিভিন্ন প্রকার ওষুধ সেবন যেমন- এসিটামিনোফেন বিষাক্ততা, পেনিসিলিন, মৌখিক গর্ভনিরোধক, ক্লোরপ্রোমাজিন ইত্যাদি
- পিত্তথলিতে পাথর, ক্যান্সার কিংবা কোনো ধরণের প্রদাহ হলে
- অগ্ন্যাশয়ে টিউমার বা ক্যান্সার হলে
- বিশেষ ধরণের এনজাইম (G6PD) এর ঘাটতি হলে
- সিকেল সেল অ্যানেমিয়া হলে
- হলুদ জ্বর হলে
জন্ডিস হলে যেসব লক্ষণ দেখা দেয়:
জন্ডিস রোগের উপসর্গ হলেও এর অনেকগুলো লক্ষণ রয়েছে। এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে আপনাকে বুঝতে হবে যে আপনি জন্ডিসে আাক্রান্ত হয়েছেন কিংবা আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন। নিম্নে প্রধান প্রধান লক্ষণগুলো উল্লেখ করা হলো:
- জ্বর হওয়া
- পেট ও পায়ে পানি আসা
- ঠাণ্ডা লাগা
- পেট ব্যথা
- ফ্লু এর মতো উপসর্গ
- গায়ের রঙ এ বিশেষ পরিবর্তন
- প্রস্রাব এর রঙ গাঢ় হলুদ ও মল এর রঙ মাটির রঙ এর মতো হওয়া
- লিভারের প্রদাহ বা দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস
- শরীরের জয়েন্টগুলোতে প্রদাহ হওয়া
- চর্মরোগ হওয়া
- অতিরিক্ত ক্লান্তি লাগা
- বমি-বমি ভাব বা বমি হওয়া
- খাবারে অরুচি
জন্ডিস হয়েছে কিভাবে বুঝবেন?
উপরে উল্লিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে আপনাকে বুঝতে হবে আপনার সম্ভবতো জন্ডিস হয়েছে। কিন্তু কিছু পরীক্ষা করার মাধ্যমে এ ব্যাপারে স্পষ্ট হওয়া যায়।
সাধারণত বিভিন্ন ক্লিনিক বা হাসপাতালে আপনি আপনার রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা টেস্ট করার মাধ্যমে জন্ডিস হয়েছে কিনা বুঝতে পারবেন।
রক্তে বিলিরুবিনের স্বাভাবিক মাত্রা: ১.২ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার।
সুপ্ত জন্ডিস হলে বিলিরুবিন এর মাত্রা: ১.২ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার বা এর চেয়ে বেশি।
পূর্ণ জন্ডিস হলে বিলিরুবিন এর মাত্রা ২.০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার বা এর চেয়ে বেশি।
যদি কখনো আপনার রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা ২.০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার এর চেয়ে বেশি হয় তবে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
চিকিৎসা ও পরামর্শ:
জন্ডিসে আক্রান্ত হলে কিছু নিয়ম-কানুন আপনাকে মেনে চলতে হবে। খাবার-দাবারে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। জন্ডিস থেকে বাঁচার মূলমন্ত্র হলো জীবাণুমুক্ত খাবার খাওয়া, স্বচ্ছ পানীয় গ্রহণ এবং পরিষ্কার-পচ্ছিন্ন থাকা।
রাস্তাঘাটের কোনো দোকানে কিছু খেলে সাবধানে খেতে হবে। বিশেষ করে ফলের জুস, শরবত, কোমল পানীয় হরহামেশাই আমরা খেয়ে ফেলি। পরিষ্কার কিনা সে ব্যাপারটি খেয়াল রাখতে হবে।
অবশ্যই সময় মতো হেপাটাইটিস এ এবং বি ভাইরাসের টিকা নিতে হবে। টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে জানা দরকার – হেপাটাইটিস বি এর ক্ষেত্রে প্রথম মাসে একটি নিতে হবে, দ্বিতীয় মাসে আরেকটি বা ছয়মাসের মধ্যে আরেকটি টিকা নেয়া যায়।
অন্যদিকে, হেপাটাইটিস এ এর ক্ষেত্রে একটি ডোজ নিতে হয়। দুটি নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে হেপাটাইটস এ এবং বি উভয়ের ক্ষেত্রেই পাঁচ বছর পরপর বুস্টার ডোজ দিতে হবে।
এই টিকাগুলো বেসরকারিভাবে দিতে গেলে যথেষ্ট টাকা খরচ করতে হবে। বেসরকারিভাবে বা ব্যক্তি মালিকানায় এই টিকার দাম সাধারণত ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।
কিন্তু মনে রাখবেন, জন্ডিস যদি হয়েই যায় আর তারপর যদি আপনি টিকাগুলো নেন তবে তেমন উপকার হয়না। তাই সুস্থ্য অবস্থায় টিকা নিয়ে নেওয়া হলো বুদ্ধিমানের কাজ।
জন্ডিস যেহেতু রোগের উপসর্গ মাত্র তাই জন্ডিসের কিন্তু কোনো ওষুধ নেই। সাধারণত রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা যদি ২৮ দিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যায় তবে জন্ডিস কোনো রোগ সৃষ্টি করতে পারে না অর্থাৎ জন্ডিস ভালো হয়ে যায।
জন্ডিসে আক্রান্ত হলে রোগীকে সাধারণত বিশ্রামে থাকতে হয়। পুরোপুরি বিশ্রামে থাকাটা বেশি উপকারী। লিভার এর প্রতি যত্নবান হতে হবে।
ভিটামিন সি যুক্ত খাবারের পাশাপাশি বেশি করে শর্করাজাতীয় খাবার খেতে হবে। সাধারণত গ্লুকোজ, আনারস, আখের রস ইত্যাদি জন্ডিস রোগীর জন্য খুবই উপকারী হিসেবে বিবেচ্য।
আরও পড়ুন: হেপাটাইটিস রোগ কি এবং কেন হয় জেনে নিন।
জন্ডিসে আক্রান্ত হলে অনেকেই প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন কিংবা ঘুমের ওষুধ খায়। কিন্তু এটা মোটেও উচিত নয়। আর প্রতিদিন অবশ্যই অন্তত একবার পায়খানা করতে হবে। কারণ এতে করে পরিপাকতন্ত্রে থাকা জীবাণুগুলো কোনো ধরণের প্রদাহ তৈরী করতে পারে না।
জন্ডিস কোনো রোগ নয় বলে এটা নিয়ে বসে থাকলে আপনার মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। কখনোই অবহেলা করবেন না। আমাদের দেশে জন্ডিসের চিকিৎসা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে।
জন্ডিসে আক্রান্ত হলে দেখা যায় মাথায় তেল রেখে ঝাড়-ফুক করে, রোগীকে অতিরিক্ত হলুদ দিয়ে রান্না করা খাবার খাওয়ায়, আবার বিভিন্ন গাছের শেকড়ের রস খাওয়ানো হয়।
এগুলো কোনোটাই ঠিক নয়। এগুলো সব কুসংষ্কার। তাই এসব ভুলেও করতে যাবেন না। তাই জন্ডিসে আক্রান্ত হলে নিকটস্থ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিন অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাড়িতে বসেই চিকিৎসা নিন।