চোখের রোগ হলে অনেকেই অযত্ন করে যদিও চোখ আমাদের জন্য অমূল্য সম্পদ। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য আমরা এই এই চোখ দিয়েই অবলোকন করি। এই পৃথিবীতে যে অন্ধ তার মতো হতভাগা আর কেউ নাই। সুতরাং চোখের যত্ন নিতে শিখুন।
চোখের কোনো রোগে ভুলেও আলসেমি করবেন না। যেকোন প্যাথিতে চিকিৎসা করুন – আপনার যেটা ভালো লাগে। তবে আমরা এখানে মূলত হোমিওপ্যাথির দিকটা তুলে ধরবো।
পুরো লেখাটা পড়লে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন চোখের সাধারনত কি কি রোগ হয় এবং হোমিওপ্যাথি অনুযায়ী এই রোগগুলোর চিকিৎসা কি। আর দেরি নয়, চলুন মূল আলোচনায় যাই-
চোখের নানা রকমের রোগ হয়ে থাকে। যেমন – চোখ ওঠা, চোখে ছানি পড়া, অঞ্জনি, ঝাপসা-দৃষ্টি, রাত-কানা, দিন-কানা প্রভৃতি। ঠাণ্ডা লাগা, দুর্বলতা, কঠিন রোগে দীর্ঘদিন ধরে ভোগা, স্নায়ুর দুর্বলতা, রজঃবন্ধ, আঘাত লাগা প্রভৃতি কারণে এসব রোগ হয়।
চোখ মানুষের মহা-মূল্যবান সম্পদ। তাই রোগ হলেই কোনো রকম বিলম্ব না করে চিকিৎসা করানো দরকার। এখানে চোখের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা প্রণালী বর্ণনা করা হচ্ছে। সঠিক লক্ষণ মিলিয়ে রোগীকে ওষুধ খাওয়ালে রোগ তাড়াতাড়ি সেরে যাবে। আনুষঙ্গিক চিকিৎসা প্রণালীও সেই সঙ্গে মেনে চলা উচিত।
চোখের রোগ – ছানি পড়া:
সাধারনত মানুষ বুড়ো হলে চোখে ছানি পড়ে। অবশ্য আঘাত লাগার কারণেও এমন হতে পারে। রোগটা হলো তারকামণ্ডলের ওপরে পাতলা আঁশের মতো এক রকম পর্দা পড়ে।
রোগটা এক চোখেও হতে পারে, আবার দু’চোখেও হতে পারে। পাতলা আবরণে তারকামণ্ডল ঢাকা পড়ে থাকে বলে রোগী স্পষ্ট কিছু দেখতে পায় না। মনে হয়, সামনে যেন কি ছায়ার মতো রয়েছে।
এ রকম হলে রোগীর খাবার ওষুধ- ক্যালক্যারিয়া ফ্লোরেটা ১২x।
উপরের ওষুধে কাজ না হলে দিতে হবে- ক্যানাবিস ইন্ডিকা ৬ (প্রথমে), ফ্লোরিক অ্যাসিড ৬ (পরে)।
চোখে লাগাবার ওষুধ- সিনেরেরিয়া মেরিটিমা সাক্কাস। দিনে ৩/৪ বার ১ ফোঁটা করে আক্রান্ত চোখে দিলে উপকার পাওয়া যায়।
চোখ ওঠার চিকিৎসা:
চোখে অতিরিক্ত রোদ লাগা, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা লাগা, ধোঁয়া লাগা, ধুলো পড়া, উপদংশ-জনিত কারণ প্রভৃতির জন্য এ রোগ হয়। চোখ প্রথমে কর-কর করে বা কিট-কিট করে, লাল হয়।
চোখের পাতা বেশ ফুলে ওঠে। যন্ত্রণা হয়, হুল ফোটার মতো ব্যথা হয়, আবার কখনো বা চুলকানি থাকে। রোগী রোদ বা আলোর দিকে তাকাতে পারে না। মাথা ধরে থাকে; মাথার যন্ত্রণা থাকে। অনেক সময় নাক দিয়ে কাঁচা পানি গড়ায় ও হাঁচি হয়।
এ অবস্থায় কোনো রকম গোলমাল বা চেঁচামেচি সহ্য করতে পারে না রোগী। অনেক সময় চোখে পিচুটি পড়ে ও চোখ জুড়ে যায়। এ রোগ হলে রোগীর থাকা উচিত অন্ধকার ঘরে। বাইরে বেরুবার দরকার হলে চোখে কালো কাঁচের চশমা পরা দরকার।
রোগীর উত্তেজিত হওয়া মোটেও উচিত নয়। দিনে অন্ততঃ দু’বার ঈষৎ গরম পানির সঙ্গে দুধ মিশিয়ে চোখ ধোওয়া উচিত; তাহলে যন্ত্রণার কিছুটা উপশম হবে। রোগীকে রোগের লক্ষণ মিলিয়ে ওষুধ খাওয়ানো দরকার।
আলো বা রোদ অসহ্য মনে হলে, বেদনা থাকলে- বেলেডোনা ৩।
বাতের জন্য চোখ উঠলে- রাসটক্স ৬।
চোখের পাতা জুড়ে যাওয়া, চোখে পিচুটি পড়া, চোখের পাতা ফোলা ও লাল হওয়া, চোখে কি যেন কাঁটার মতো ফুটছে মনে হয়, এসব লক্ষণে- ক্যালক্যারিয়া কার্ব ৬।
প্রমেহ, উপদংশ প্রভৃতি কারণে চোখ উঠলে- মার্ক সল ৬।
বেদনা, কিছু ফুটে যাওয়ার মতো মনে হলে- ইউফ্রেসিয়া ১x।
বেদনা, জ্বালা ও চুলকানি থাকলে- সালফার ৩০।
শিশুদের এ রোগ হলে- সালফার ৩০ বা আর্জ নাই ৬।
ঠাণ্ডা লাগার জন্য এ রোগ হলে- অ্যাকোনাইট ৩x।
রোগের শুরুতে ভালো কাজ করে- পালসেটিলা ৬।
চোখের রোগ – ক্ষীণ দৃষ্টি:
অনেক সময় বয়স বাড়লে অর্থাৎ বুড়ো বয়সে দৃষ্টির ক্ষীণতা দেখা দেয়। অবশ্য কম বয়সেও এ রকম হতে পারে। অতিরিক্ত নেশা সেবন, স্নায়ুর দুর্বলতা, অল্প বা অত্যুজ্জ্বল আলোতে লেখাপড়ার কাজ করা, অতিরিক্ত শুক্রক্ষরণ প্রভৃতি এ রোগের কারণ।
চশমা ব্যবহার করে কৃত্রিম উপায়ে অনেকে সাধারণ দৃষ্টির মতো সব কাজ চালান। রোগটা কিন্তু থেকেই যায়। রোগের প্রথম মুখে চিকিৎসা করলে দৃষ্টির ক্ষীণতা দোষ দূরীভূত হতে পারে। অনেকে বলেন, সঠিক ওষুধ প্রয়োগ করতে পারলে ক্ষীণ-দৃষ্টি স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ফিরে আসে।
হস্তমৈথুন-জনিত কারণে দৃষ্টির ক্ষীণতা দেখা দিলে- অ্যাসিড ফস ৬।
রক্তাল্পতা বা ধাতু-দুর্বলতার জন্য এ রকম হলে- চায়না ৬ বা সালফার ৩০।
রজঃবন্ধের কারণে এ রকম হলে- পালসেটিলা ৬ বা ৩০।
রক্তের আধিক্য বশতঃ এ রোগ হলে- বেলেডোনা ৬।
হজমের গোলমালের জন্য দৃষ্টি-ক্ষীণতায়- নাক্সভমিকা ৩x।
মাদকদ্রব্য সেবনের জন্য এ রোগ হলে- নাক্সভমিকা ৩x।
চোখ দিয়ে বেশি পানি পড়ে ও দৃষ্টি-ক্ষীণতায়- ইউফ্রেসিয়া ১x।
রক্তস্রাব হেতু দৃষ্টি-ক্ষীণতা দেখা দিলে- সালফার ৩০।
এক্ষেত্রে আর একটি ওষুধও ব্যবহার করা চলে- চায়না ৬।
অঞ্জনি রোগের চিকিৎসা:
চোখের পাতার নিচে বা ওপরে এক রকম ফুস্কুড়ি হয়। পাতা লাল হয় ও ব্যথা হয়। কখনো কুট-কুট করে, কখনো বা জ্বালা করে। চোখে পানি পড়ে, পিচুটি পড়ে, চোখ জুড়ে যায়।
এ রোগ হলে রোদের দিকে বা আলোর দিকে তাকাতে অসুবিধা হয়। ফুস্কুড়ি পেকে পুঁজ বেরিয়ে গিয়ে ঘা শুকোলে তবে ব্যথা-যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। অঞ্জনি হয় ঠাণ্ডা লাগার ফলে, শারীরিক দুর্বলতার জন্য বা ধাতুঘটিত দোষে।
খুব বেদনা থাকলেও যন্ত্রণা হলে- হিপার ৩০ (প্রথমে), সাইলিশিয়া ৬ (পরে)।
চোখের নিচের পাতায় অঞ্জনি হলে- ফসফরাস ৬ বা রাসটক্স ৬।
চোখের উপরের পাতায় অঞ্জনি হলে- সালফার ৩০ বা পালস ৬ বা অ্যাসিড ফস ৬।
অঞ্জনির একটি উৎকৃষ্ট ওষুধ- পালসেটিলা ৬। ওষুধটি যেকোন অবস্থায় খাওয়ানো চলে।
ব্রণ খুব শক্ত, দেরিতে পাকে অর্থাৎ সহজে পাকতে চায় না, খুব প্রদাহ হয়, এসব লক্ষণে- মারকিউরিয়াস ৩।
ব্রণ হয়, ভালো হয় – আবার হয়, এভাবে ক্রমাগত হতে থাকলে- স্ট্যাফিস্যাগ্রিয়া ৬ (প্রথমে), সালফার ৩০ (পরে)।
অঞ্জনিতে গরম সেঁক লাগালে বেশ আরাম বোধ হয়। এতে ঠাণ্ডা পানি না লাগানোই ভালো। চোখ ধোবার সময় পানি ফুটিয়ে অল্প গরম করে ধোয়া উচিত।
দূর-দৃষ্টির চিকিৎসা:
কোনো জিনিস কাছে থাকলে দেখা যায় না, কিন্তু কিছুটা দূরে সরালে দেখা যায়।
এ রোগের ওষুধ- মারকিউরিয়াস ৩ বা নেট্রাম মিউর ১২x বিচূর্ণ বা হায়োসায়েমাস ৩০।
নিকট দৃষ্টির চিকিৎসা:
কোনো জিনিস কাছে থাকলে দেখা যায়, কিন্তু কিছুটা দূরে সরালে দেখা যায় না।
এ রোগের ওষুধ- সালফার ৩০ বা ফসফরাস ৬ বা ক্যালক্যারিয়া কার্ব ৬।
চোখের রোগ – ঝাপসা দৃষ্টি
এ রোগ হলে রোগী কোনো জিনিস স্পষ্ট দেখতে পায় না, সবকিছু ঝাপসামতো দেখে। স্নায়ুর দুর্বলতা, রক্তাল্পতা প্রভৃতি কারণে রোগটা হয়।
এর ওষুধ- ফসফরাস ৬ বা পালস ৬।
জাল দৃষ্টির চিকিৎসা:
রোগীর দৃষ্টিতে সবকিছু জালের মতো মনে হয়। রক্তাল্পতা, স্নায়বিক দুর্বলতা, অতিরিক্ত শুক্রক্ষরণ, কঠিন পরিশ্রম, রোদে ভ্রমণ প্রভৃতি কারণে রোগটা দেখা দেয়।
এ রোগের ওষুধ- ফেরাম ৬ বা পালস ৬ বা অ্যাসিড ফস ৩০ বা চায়না ৬। যেকোন একটি ওষুধ সেব্য।
আংশিক দৃষ্টির চিকিৎসা:
এ রোগে আক্রান্ত হলে রোগী কোনো জিনিসের সম্পূর্ণ অংশ দেখতে পায় না। খানিকটা অংশ দেখতে পায় মাত্র।
এ রোগের ওষুধ- লাইকোপোডিয়াম ৬ বা অরাম-মেট ৬।
চোখের রোগ – দিন কানা:
দিনের বেলা কম দেখতে পায়, কিন্তু রাত্রিকালে আলোতে বেশ স্পষ্ট দেখতে পায়।
এ রোগের ওষুধ- সিলিকা ৩০ বা ফসফরাস ৬।
রাত-কানা রোগের চিকিৎসা:
রাতের বেলা আলো থাকলেও ভালো দেখতে পায় না, কিন্তু দিনের বেলা বেশ স্পষ্ট দেখতে পায়।
এ রোগের ওষুধ- চায়না ৬ বা নাক্সভমিকা ৩০।
চোখের রোগ – ট্যারা দৃষ্টি:
রোগীর চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় না সে কোনদিকে তাকিয়ে আছে। যাদের কৃমি থাকে, এ রোগটা তাদের বেশি হয়।
এ রোগের উৎকৃষ্ট ওষুধ- অ্যালুমিনা ৬।
কৃমির জন্য রোগ হলে- হায়োসায়েমাস ৩ বা সিনা ৩x।
শিশুদের পক্ষে উপকারী ওষুধ- বেলেডোনা ৬।
দৃষ্টিক্লান্তির চিকিৎসা:
কোনো জিনিসের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, কিছুক্ষণ তাকানোর পরেই কষ্টবোধ হতে থাকে।
এ রোগের ওষুধ- নেট্রাম মিউর ৩ বা ক্যালক্যারিয়া কার্ব ৬।
চোখের রোগ – চোখের পাতা নাচা:
মাঝে মাঝে চোখের পাতা নাঁচে। কখনো এক চোখে, কখনো বা দু’চোখেই। এ রকম হলে রোগী অস্বস্তি বোধ করে।
এর ওষুধ- ইগ্নেসিয়া ৬ বা পালস ৬।
চোখের পাতায় আকুঞ্চনের চিকিৎসা:
চোখের পাতা বাইরের দিকে কুঁকড়ে যেতে পারে, ভেতরের দিকে ঢুকে যেতেও পারে। এ রকম হলে ওষুধ খাওয়ালে রোগটা সেরে যায়।
বাইরের দিকে কুঁকড়ে গেলে- নাইট্রিক অ্যাসিড ৬ বা এপিস ৬।
ভেতরের দিকে ঢুকে গেলে- লাইকোপোডিয়াম ৩০ বা বোরাক্স ৩ বা ক্যালক্যারিয়া কার্ব ৬।
পানি সহ বাহ্য প্রয়োগের ওষুধ- হ্যামামেলিস (মাদার)। ৮/১০ গুণ পানির সঙ্গে মিশিয়ে ওষুধ লাগানো উচিত। অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
চোখের রোগ – তারকামন্ডলে প্রদাহ:
আঘাত লাগা, বাত, প্রমেহ, উপদংশ, শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা প্রভৃতি কারণে রোগটা হয়। এ রকম হলে রোগী আলোর দিকে বা রোদের দিকে তাকাতে পারে না।
যন্ত্রণা অনেক সময় অসহ্য হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় রোগীর কোনো কিছুই ভালো লাগে না, মেজাজ হয়ে ওঠে তিরিক্ষে।
প্রমেহ-জনিত কারণে এমন হলে- আর্জেন্টাম নাইট্রিকাম ৬ বা অ্যাসিড ফস ৬।
উপদংশ-জনিত কারণে এমন হলে- ক্লিমেটিস ৬।
বাতের কারণে এমন হলে- ইউফ্রেসিয়া ৬ (প্রথমে), কেলিবাইক্রোম ৬ (পরে)।
আঘাত লেগে এমন হলে- আর্নিকা ৩।
প্রদাহ যদি বেশি হয় এবং তার সঙ্গে জ্বর থাকে তাহলে রোগীকে খাওয়ানো উচিত- অ্যাকোনাইট ৩x।
মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে চোখ ভালো করে ধুয়ে ফেললে একটু আরাম বোধ হয়। এ রকম হলে চোখে গরম সেঁক দেওয়া উচিত নয়।
রোগীকে অন্ধকার ঘরে অথবা কালো কাঁচের চশমা পরিয়ে রাখলে ভালো হয়। এ অবস্থায় রোগীকে উত্তেজিত বা বিরক্ত করা উচিত নয়।
আরও পড়ুন: কিডনী ভালো রাখার কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
চোখের রোগ হলে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। যাদের চোখ নাই বা চোখে দেখতে পায় না শুধু তারাই জানে এর কষ্ট। বর্তমানে অ্যালোপ্যাথির পাশাপাশি হোমিওপ্যাথিতেও চোখের রোগ সারানোর জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়।
তাই রোগ লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্রই নিকটস্থ অভিজ্ঞ একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করুন। নিজে নিজে কোনো ড্রপ ব্যবহার করতে যাবেন না। পরিণামে ক্ষতি হতে পারে।