গাজর (Carrot) যার বৈজ্ঞানিক নাম Daucus carota হলো একপ্রকার মূল জাতীয় সবজি। গাজর গাছ Apiaceae পরিবারভুক্ত।
এর আদি নিবাস দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া এবং ইউরোপ। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক গাজরই চীন দেশে উৎপাদিত হয়। নানা প্রকার খাদ্য তৈরিতে গাজর ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে সালাদে এর ব্যবহার ব্যাপক। একে সাধারণত গৃহের বাগানের সবজি উৎপাদিত করা হয়।
আজ আমরা আলোচনা করবো গাজর খাওয়ার উপকারিতা নিয়ে। আশা করি, তথ্যগুলো আপনাদের কাজে লাগবে। তো আর কথা নয় – সরাসরি যাচ্ছি মূল আলোচনায়।
প্রথমেই জেনে নেব গাজরে কি পরিমাণ পুষ্টিগুণ রয়েছে। নিচে উপাদান অনুযায়ী পরিমাণ উল্লেখ করা হলো।
১০০ গ্রাম কাঁচা গাজরে প্রধান উপাদানের পাওয়া দীর্ঘ তালিকাটি নিম্নরূপ:
কার্বোহাইড্রেট – ৯ গ্রাম;
চিনি – ৬ গ্রাম;
ডায়েটারি ফাইবার – ৩ গ্রাম;
ফ্যাট – ০.২ গ্রাম;
প্রোটিন – ১ গ্রাম;
ক্যালসিয়াম – ৩৩মিলিগ্রাম;
ম্যাগনেসিয়াম – ১৮মিলিগ্রাম;
ফসফরাস – ৩৬ মিলিগ্রাম;
পটাসিয়াম – ২৪০ মিলিগ্রাম;
সোডিয়াম – ২.৪ মিলিগ্রাম;
ভিটামিন বি – ০.০৪ মিলিগ্রাম;
ভিটামিন বি – ২০.০৬ মিলিগ্রাম;
ভিটামিন বি – ৩১.২ মিলিগ্রাম;
ভিটামিন বি – ৬২.০১মিলিগ্রাম;
ভিটামিন সি – ৭ মিলিগ্রাম;
এখন জেনে নেবো গাজরের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে:
নিয়মিত ভিটামিন এ খাচ্ছেন, ভুলে যান বাইরের ভিটামিনের কথা। খেয়ে নিন একটি লাল রঙের গাজর। কারণ একটি গাজর আপনাকে দিতে পারবে ভিটামিন এছাড়া নানা উপকার থাকে।
শক্তিশালী খাদ্য উপাদান শুধু ভিটামিন এ পাওয়া যায় তাই নয়, গাজরে আছে নানাবিধ উপকারী এটি আপনাকে উপহার দেবে সুন্দর ত্বক থেকে শুরু করে ক্যানসারের থেকে সুরক্ষা। গাজরের উপকারিতাগুলো ক্রমিক আকারে নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে
আগে গাজর না খেয়ে থাকলে এখন থেকে গাজর খাওয়া শুরু করুন কারণ গাজের মধ্যে আছে বেটা ক্যারোটিন দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
বিটা ক্যারোটিন যা আমাদের লিভারে গিয়ে ভিটামিন A-তে বদলে যায় যা পরে চোখের রেটিনায় গিয়ে পৌঁছে চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
সেই সাথে রাত্রে বেলায় অন্ধকারের ভালো দেখার জন্য দরকারি এমন এক ধরনের বেগুনি পিগ্মেট এর সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে গাজর।
২. ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে
গাজর ক্যান্সারের ঝুঁকি কম করতে সাহায্য করে। কারণ গাজরে আছে falcarinol এবং falcarindiol যা আমাদের শরীরে এন্ট্রিক্যান্সার উপাদানগুলিকে রিফিল করে।
গাজর খেলে ফুসফুস ক্যান্সার, কলোরেক্টাল ক্যান্সার এবং প্রোস্টেট ক্যান্সারে হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। বেশিরভাগ সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিদিন দেড় কাপ গাজরের রস পান করলে ক্যান্সারে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
৩.লিভারের জন্য গাজর
গাজরের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন A রয়েছে।যা শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ অপসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, এটি লিভারের পিত্ত এবং হিমায়িত ফ্যাট কম করতে সাহায্য করে।
গাজরে দ্রবণীয় ফাইবার প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, যা আপনার লিভার এবং কোলনকে মলত্যাগের প্রক্রিয়াটিকে উদ্দীপনা দিয়ে পরিষ্কার করতে সহায়তা করে।
প্রতিদিন একটি করে গাজর সেবন করলে লিভারে প্রদাহ, ফোলাভাব ও সংক্রমণ কমে যায়। লিভারের হেপাটাইটিস, সিরোসিস এবং কোলেস্টেসিসের মতো সমস্যা থেকে লিভারকে রক্ষা করে ।
৪.অ্যান্টি এজিংয়ের জন্য গাজর
শুধু আমাদের শরীরের জন্য ভালো তাই নয় এটি আমাদের জন্য অ্যান্টি এজিং উপাদানে হিসেবেও কাজ করে। এতে যে বেটা ক্যারোটিন আছে তা আমাদের শরীরের ভিতরে গিয়ে অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।
আমাদের শরীরে ক্ষয়প্রাপ্ত সেলগুলিকে ঠিকঠাক করে যা সাধারণ মেটাবলিজমের কারণে হয়ে থাকে। এছাড়াও এটি এজিং সেলগুলোর গতি ধীর করে দিতে সাহায্য করে। এর ফলে আপনি ধরে রাখতে পারবেন আপনার যৌবনকে অধিক সময়ের জন্য।
৫.সুন্দর ত্বকের জন্য গাজর
সুন্দর ত্বকের জন্য গাজর খেতে পারেন এটা আপনার ত্বককে ভেতর থেকে সুন্দর করে তুলতে সাহায্য করে। কাজের মধ্যে ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আপনার ত্বকের রোদে পোড়া পোড়া ভাব দূর করতে সাহায্য করবে।
এছাড়া ভিটামিন এ ত্বকের ভাঁজ পড়া ,কালো দাগ, ব্রণ ইত্যাদি দূর করতে সাহায্য করবে। যার ফলে আপনার ত্বক সুন্দর দেখাবে।
৬. অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে কাজ করে
গাজর একটু ভালো অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে কাজ করে। ইনফেকশন হওয়া থেকে রক্ষা করে। সব কেটে গেলে বা পুড়ে গেলে সেখানে লাগিয়ে দিন গাজরের রস। ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা আর থাকবে না।
৭. হৃদরোগের জন্য গাজরের উপকারিতা
এছাড়া হৃৎপিণ্ডের নানান অসুখে এটা খুব ভালো কাজ করে। এর কেরাটিন ক্যারোটিনয়েড হৃৎপিণ্ডের নানা অসুখের ওষুধ ওষুধ হিসাবে কাজ করে।
যেসব খাবারে যেমন-গাজর এর মধ্যে উচ্চমাত্রায় এই পাওয়া যায়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিদিন একটি গাজর খেলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ৬৮% পর্যন্ত অনেক ঝুঁকি কমে যায়।
৮. ওরাল স্বাস্থ্যের জন্য গাজরের উপকারিতা
আপনি সুন্দর ও সুস্থ সবল দাঁত চান? তবে এখনই গাজর খাওয়া শুরু করুন। গাজর মুখের লালা উত্পাদন বাড়ায় এবং প্রাকৃতিকভাবে এটি ক্ষারীয় কারণে মুখের মধ্যে অ্যাসিডের প্রভাবকে ভারসাম্যহীন করে তোলে।
ক্ষারীয় প্রভাব মুখের ব্যাকটিরিয়ার প্রতিরোধ করে, যার ফলে গহ্বর, মুখের গন্ধ এবং অন্যান্য মুখের স্বাস্থ্য সমস্যা দূরে রাখে।
গাজরের মধ্যে ভিটামিন সি থাকে।এর ফলে যা সংযোজক টিস্যু, দাঁত এবং মাড়ির জন্য ভাল রাখতে সাহায্য করে। গাজর আপনার দাঁত ও মুখ পরিষ্কার করে। গাজরের মিনারেলস গুলো দাঁত মজবুত থাকতে সাহায্য করে।
৯. স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে গাজরের উপকারিতা
এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা মানব শরীরের স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের মতে জানা গেছে যে যারা ৬টির গাজর খেয়েছেন বা খাচ্ছেন তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি এর থেকে কম পরিমাণে কম একটি গাজর খাচ্ছেন তাদের তুলনায় অনেক কম হয়েছে। স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে এখন থেকে খাদ্যতালিকায় গাজর যোগ করুন।
১০.কানের ব্যথার জন্য গাজরের উপকারিতা
সর্দি-কাশি বা কোনও অসুস্থতার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসাবে যদি কানে ব্যথা হয়। তবে গাজরকে ব্যবহার করার মাধ্যমে জন্য স্বস্তি দেয়।
কলা, গাজর, আদা এবং রসুনের খোলা উষ্ণ গরম জল করে কানে ১-২ ফোঁটা লাগলে কানের ব্যথা কমে যায়।
১১.দাঁতের রোগের জন্য গাজর
গাজর রক্ত পরিষ্কার করে। এর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে। তামাক চিবিয়ে গাজর সেবন করলে দাঁতগুলিও শক্ত, পরিষ্কার এবং উজ্জ্বল এবং মাড়িও শক্ত হয়।
পরিশেষে বলা যায়, গ্রামে গাজর খাওয়ার তেমন অভ্যাস মানুষের নেই। এর মূল কারণ গ্রামের মানুষ গাজর এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানে না।
তাই গাজর নিয়মিত খাওয়ার অভ্যাস তৈরী করতে হবে। গ্রামে এটা যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায় এবং দামও অনেক কম (শহরের তুলনায়)। সবজি হিসেবেও গাজর অনেক বেশি সুস্বাদু।
আরও পড়ুন: তেজপাতা শুধু মসলা হিসেবে নয় – আরও নানাবিধ উপকার করে।