গলায় কিছু আটকে গেলে করণীয়:
গলায় কিছু আটকে গেলে বিশেষ করে কোনো খাবার তা যে কারও জন্য খুবই বিপদজনক। জেনে রাখা দরকার যে, গলার ভেতরে খাদ্যনালী ও শ্বাসনালী পাশাপাশি এবং খুব কাছাকাছি থাকে।
সাধারণত শুকনো খাবার যেমন- বিস্কুট, মুড়ি, চিড়া, খই ইত্যাদি যদি কেউ তাড়াহুড়ো করে খেতে যায় তখন গলায় তা আটকে যেতে পারে অর্থাৎ খাবার খাদ্যনালীতে না গিয়ে শ্বাসনালীতে চলে যেতে পারে।
আবার, কোনো কিছু খাওয়ার সময় যদি আরেকজনের সাথে কথা বলে কিংবা অন্য কোনো কাজ করে, ছুটোছুটি করে খায় তাহলে সেই ক্ষেত্রেও তা গলায় আটকে যেতে পারে।
খাবার খাদ্যনালীতে না গিয়ে শ্বাসনালীতে গেলে সাধারণত নিঃশ্বাস নেয়া যায় না। তখন দ্রুত ঐ ব্যক্তিকে গলায় আঙুল দিয়ে বমি করানো প্রয়োজন। কিন্তু অনভিজ্ঞ ব্যক্তি যদি এ কাজটি করতে যায় তবে রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
তাই যে ব্যক্তির বেসিক লাইফ সাপোর্ট সম্বন্ধে জানা আছে এমন ব্যক্তি দিয়ে কাজটি করানো যেতে পারে। খুব অল্প সময়ের কাজটি সঠিকভাবে করতে না পারলে রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত।
গলায় যেসব জিনিস আটকে যেতে পারে:
- কাচা টাকা পয়সা
- বিভিন্ন ধাতব ছোট টুকরা
- ছোট আকৃতির ফল যেমন বড়ই, আমলকি
- বাচ্চাদের খেলনার ছোট ছোট অংশ
- মাছের কাটা
- মাংসের হাড়-হাড্ডি
- সুই বা সেপ্টিপিন
- বাঁধানো দাত সহ ইত্যাদি
গলায় খাবার আটকে গেলে যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে:
প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছে রোগীকে নিয়ে আসার পর রোগীর যেকোন স্বজন ডাক্তারকে রোগীর কথা বলবে। গলায় কিভাবে কি আটকে গেছে তা বলতে হবে। গলায় কিছু আটকে গেলে সাধারণত নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে:
- ঢোক গিলতে প্রচণ্ড অসুবিধা হবে।
- গলায় প্রচুর পরিমাণে ব্যথা হতে পারে। ব্যথা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে।
- মুখ দিয়ে অতিরিক্ত লালা বের হতে পারে।
- বমি-বমি ভাব হতে পারে।
গলায় খাবার আটকে গেলে যেভাবে প্রতিরোধ করবেন:
হেইমলিচ ম্যানইউভার পদ্ধতি: বিখ্যাত আমেরিকান ইএনটি স্পেশালিস্ট হেনরি হেইমলিচ ১৯৭৪ সালে বিশেষ একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তার নামানুসারে এই পদ্ধতির নাম রাখা হয়েছে হেইমলিচ ম্যানইউভার পদ্ধতি।
এ পদ্ধতিতে খুব সহজেই গলায় কিছু আটকে গেলে তা বের করে আনা যায়। এই পদ্ধতিটি বেশ কার্যকর। কেউ যদি খুব সাবধানে হেনরি হেইমলিচ এর আবিষ্কৃত পদ্ধতি অনুসরণ করেন তাহলে বহু দূর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব।
কারও গলায় খাদ্য আটকে গেলে যা করবেন:
কারও গলায় খাবার বা অন্য কিছু আটকে গেলে মাথা ঠাণ্ডা রেখে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে সাহস দিতে হবে। কারণ এরকম ঘটনার ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি ভয়ে অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।
শুরুতেই আক্রান্ত ব্যক্তির পেছনে একদম সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে। তারপর পেছন থেকে খুব শক্ত বা জোরালোভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিকে জড়িয়ে ধরে তার বুক আর পেটের মাঝখানে জোরে চেপে ধরতে হবে।
চাপ এমনভাবে দিতে হবে তা যেন উপরের দিকে সঞ্চালিত হয়। এতে করে আক্রান্ত ব্যক্তির কাশির সৃষ্টি হতে পারে। ফলশ্রুতিতে গলায় আটকে যাওয়া খাবার কাশির মাধ্যমে বেরিয়ে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
শিশুর গলায় আটকে গেলে যা করবেন:
ছোট বড় সবার জীবনে এমন দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। সুতরাং শিশুদের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক কিছু নয়। যদি এমন দূর্ঘটনা ঘটেই যায় তাহলে খুব সাবধানে ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রথমে যা করবেন তা হলো আক্রান্ত শিশুকে বাম হাতে ধরবেন। তারপর শিশুর পিঠ যাতে উপরের দিকে এবং মুখ যাতে নিচের দিকে থাকে এমন করে ধরবেন।
এবার খুব সাবধানে ডান হাতের তালু দিয়ে শিশুটির পিঠের দিকে কাঁধের উপর তিন থেকে চারটি চাপড় মারবেন। এতে করে মুখ দিয়ে গলায় আটকানো খাবার বা বস্তু বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে।
উপরের পদ্ধতিতে কাজ না হলে খুব দ্রুত শিশুটিকে চিত করে শোয়াবেন। তারপর আপনার দুই আঙুল দিয়ে সামান্য চাপ প্রয়োগ করে বুকের মাঝখানে মালিশের মতো করে মুখের দিকে চাপ সঞ্চালন করবেন।
তারপর আবার বাম হাত দিয়ে আগের মতো করে তিন থেকে চারটি চাপড় মারবেন। ফলশ্রুতিতে শিশুটির মুখ দিয়ে আটকে যাওয়া খাবার বা বস্তু বেরিয়ে আসার খুবই সম্ভাবনা রয়েছে।
নিজের গলায় আটকে গেলে যা করবেন:
নিজেই যদি আক্রান্ত হন তবে আলাদাভাবে কোনো কিছু করার নিয়ম নেই। উপরে যেভাবে বলা হয়েছে ঠিক সেভাবেই কাজ করতে হবে।
হ্যা, যদি আপনার আশেপাশে কেউ না থাকে তবে আপনাকে নিজের ব্যবস্থা নিজেরই করতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনি খুব দ্রুত একটি চেয়ার সংগ্রহ করবেন।
তারপর ঐ চেয়ারের (যেদিকে হেলান দেয়া হয়) পেছন দিকে পেট আর বুকের মধ্যস্থল রাখুন। এরপর যথেষ্ট চাপ রেখে উপরের দিকে চাপ সঞ্চালিত করতে থাকুন।
এতে আপনার কাশির সৃষ্টি হতে পারে। আর কাশির সৃষ্টি হলে আটকে যাওয়া খাবার বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
কিছু সতর্কতা ও পরামর্শ:
ভয়াবহ এই দূর্ঘটনা এড়াতে খাবার খাওয়ার সময় অহেতুক কথা-বার্তা বলা থেকে বিরত থাকুন। এক জায়গায় বসে স্থির অবস্থায় খান। টেবিলে বসে খাবার খাওয়ার চেষ্টা করবেন।
সবসময় খাবার খাওয়ার সময় পাশে পানি রাখুন। খাবার ভালো মতো চিবিয়ে খান। আর পানির প্রয়োজন না পড়লেও মাঝে মাঝে একটু করে পানি পান করুন।
যাদের শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা আছে (হাঁপানি) তারা অনুগ্রহ করে শুকনো খাবার যেমন- চিড়া, মুড়ি, খই, চাউল ভাজা, বিস্কুট ইত্যাদি এড়িয়ে চলুন।
শিশুদের বেলায় এরকম ঘটনা যদি ঘটেই যায় তবে বমি করানোর খুব বেশি চেষ্টা করবেন না। প্রথমে আরো কিছু পরিমাণ পানি পান করাবেন আর তারপরেই চেষ্টা করবেন।
আপনার শিশুকে যেকোন খাবার খাওয়ানোর সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন। তাড়াহুড়ো করতে যাবেন না। না খেতে চাইলে জোর করে খাবার মুখে ঠেসে দেবেন না। পরিণতি মারাত্মক হতে পারে।
কাচা টাকার কড়ি, মার্বেল বা ছোট টুকরা জাতীয় জিনিস যা শিশুরা মুখে নিতে পারে এমন জিনিসগুলো শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন।
আরও পড়ুন: কিডনী ভালো রাখার কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় জেনে নিন।
যারা অতিরিক্ত মোটা আকৃতির লোক কিংবা যাদের গলায় চর্বি আছে তাদের এমন সমস্যা বেশি হয়। এমন সমস্যা যাতে না হয় তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা শ্রেয়।
বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, এটি একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সী অবস্থা। তাই উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে কোনো উপকার না হলে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়ে আসতে হবে।
খাদ্য বা কোনো বস্তু যদি শ্বাসনালীতে আটকে যায় তবে ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে রোগীর দম বন্ধ হয়ে মারা যেতে পারে। তাই ভুল করেও হেলা করবেন না।
এমন কিছু ঘটলে তাৎক্ষনিক হাসপাতালে নিয়ে আসুন যদি হাসপাতাল খুব কাছেই থাকে। আর দূরে হলে সেটা আলাদা ব্যাপার। সর্বোপরি খাবার খাওয়ার সময় সচেতন থাকুন যেন এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনা কখনোই না ঘটে।