কিডনি রোগের অনেক লক্ষণ রয়েছে। সব লক্ষণ সম্পর্কে আমাদের জানা সম্ভব নয়। তবে কমন যে লক্ষণগুলো রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে আমরা আজ জানবো।
তবে বলে রাখি, লক্ষণগুলোর মধ্যে কয়েকটা দেখা দিলেই ভয়ের কিছু নেই। আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। তবে লক্ষণগুলো যখন আপনার কাছে সন্দেহজনক মনে হবে কিংবা আপনি নিজেকে অসুস্থ বোধ করবেন তখন অবশ্যই একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
কিডনি রোগের লক্ষণসমূহ:
ক. সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে চোখ ফুলে যাওয়া;
খ. মুখ এবং পা ফুলে অস্বাভাবিক ফুলে যাওয়া;
গ. ক্ষুধামান্দ্য , বমি ভাব এবং দূর্বল ভাব;
ঘ. বার বার প্রস্রাবের বেগ, বিশেষ করে রাত্রে বেশি হওয়া;
ঙ. কম বয়সে উচ্চ রক্তচাপ;
চ. শারীরিক দুর্বলতা এবং গায়ের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া;
ছ. অল্প হাঁটার পরে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বা তাড়াতাড়ি ক্লান্তি অনুভব করা;
জ. ৬ বছর বয়সের পরেও রাত্রে বিছানায় প্রস্রাব করা;
ঝ. প্রস্রাব কম আসা;
ঞ. প্রস্রাব করার সময় জ্বলন অনুভব করা এবং প্রস্রাবে রক্ত বা পুঁজের উপস্থিতি;
ট. প্রস্রাব করার সময় কষ্ট হওয়া এবং ফোঁটা ফোঁটা করে প্রস্রাব হওয়া;
ঠ. পেটের মধ্যে গিট হওয়া, পা আর কোমরের যন্ত্রণা হওয়া;
উপরে যেসব লক্ষণের কথা বলা হয়েছে এগুলো সাধারনত কিডনি রোগের লক্ষণ। তবে দুই একটি লক্ষণ দেখা দিলেই আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। তবে দুই এর অধিক লক্ষণ দেখা দিলে এবং নিজের মধ্যে অসুস্থ্যতা দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং প্রয়োজনে চেকআপ বা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করতে হবে।
কিডনি রোগ যেভাবে নির্ণয় করা হয়:
কিডনি রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। সমষ্টিগতভাবে জটিল কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাময় হয় না। দুর্ভাগ্যবশত অনেক গভীর কিডনির রোগের লক্ষণ শুরুতে কম দেখা যায়।
এই জন্য যখনই কিডনির রোগের আশঙ্কা হয়, তখনই বিনা বিলম্বে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন যদিও বিষয়টি আর্থিক সামর্থে্যর উপর নির্ভর করে।
কিডনি রোগের পরীক্ষা কাদের করা উচিত?
১. যে ব্যক্তির কিডনির রোগের লক্ষণ ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে;
২. ডায়াবেটিস হয়েছে এমন ব্যক্তির;
৩. উচ্চ রক্তচাপ ব্যাধি রয়েছে এমন ব্যক্তি (High Blood Pressure);
৪. পরিবারে বংশানুগতিক কিডনি রোগের ইতিহাস থাকলে;
৫. অনেক দিন ধরে যন্ত্রণা নিবারক (Pain Killer Tablets) ঔষধ সেবন করলে;
৬. রেচনতন্ত্রে জন্মগত রোগ থাকলে;
৭. ২-৫ বছর অন্তর নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা (সবার জন্য);
কিডনি রোগ নির্ণয়ের জন্য যেসব পরীক্ষা করা হয়:
১. প্রস্রাবের পরীক্ষা:
কিডনি রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রস্রাব পরীক্ষা অতি প্রয়োজনীয়। এটা সর্বপ্রথম পরীক্ষা করা হয় এবং এখান থেকেই টের পাওয়া যায় যে, কিডনি রোগ আছে কিনা।
জেনে রাখুন-
ক. প্রস্রাবের মধ্যে পুঁজের (Pus) উপস্থিতি মূত্রনালিতে সংক্রমণের নিদর্শন এবং
খ. প্রস্রাবের প্রোটিন বা রক্তকণিকার উপস্থিতি গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস এর নিদর্শন বহন করে।
২. মাইক্রোঅ্যালবুমিনেবিয়া:
প্রস্রাবের এই পরীক্ষাটি ডায়াবিটিসের কারনে কিডনি খারাপ হবার সম্ভাবনা থেকে সর্বপ্রথম এবং সবথেকে তাড়াতাড়ি নির্ণয়ের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
প্রস্রাবের অন্য পরীক্ষাগুলি হল:
১. প্রস্রাবের টি.বি রোগের জীবাণুর (Bacteria) পরীক্ষা, টি.বি. নির্ণয়ের জন্য।
২. ২৪ ঘণ্টার মূত্রে প্রোটিনের মাত্রা (কিডনির ফোলাভাব আর তার চিকিৎসার প্রভাব জানার জন্য)।
৩. প্রস্রাব কালচার আর সেনসিটিভিটি পরীক্ষা (প্রস্রাব সংক্রমণের জন্য দায়ী ব্যাকটিরিয়া বিষয়ে জানতে আর তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যাপারে জানতে)।
প্রস্রাবের পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনির বিভিন্ন রোগের ব্যাপার জানা যায় কিন্তু প্রস্রাব পরীক্ষার রিপোর্ট স্বাভাবিক (Normal) হওয়া সত্ত্বেও কিডনিতে কোনও রোগ নেই সেটা বলা যায় না। তাই অন্যান্য পরীক্ষা করাটাও জরুরি।
রক্তের পরীক্ষা নিরীক্ষা:
ক. রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা:
রক্তে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি (রক্তাল্পতা বা ইংরেজীতে অ্যানিমিয়া) কিডনি ফেল হবার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। রক্তাল্পতা শরীরের অন্য কোনও রোগের নিদর্শনও হতে পারে সেজন্য এই পরীক্ষা সর্বদা কিডনির রোগের জন্যই করা হয় এমন নয়।
খ. রক্তে ক্রিয়েটিনিন এবং ইউরিয়ার মাত্রা:
এই পরীক্ষা কিডনির কার্যদক্ষতার পরীক্ষা। ক্রিয়েটিনিন আর ইউরিয়া হল শরীরের অনাবশ্যক বর্জ্য পদার্থ, কিডনির দ্বারা শরীরের বাইরে নিষ্কাশিত হয়।
শরীরের ক্রিয়েটিনিন এর ধারাণ মাত্রা ০.৬ থেকে ১.৪ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার আর ইউরিয়ার সাধারণ ত্ৰা ২০ থেকে ৪০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার। কিডনিযুগল বিকল হলে দুটিরই ত্ৰা বাড়ে। এই পরীক্ষাটিও কিডনি রোগের নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রক্তের অন্যান্য পরীক্ষা:
কিডনির বিভিন্ন রোগের নির্ণয়ের জন্য রক্তের অন্যান্য পরীক্ষাগুলি হল কোলেস্টোল, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্লোরাইড, ক্যালসিয়াম, ফসফেটস, কমপ্লিমেন্টস ইত্যাদি।
রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষা:
ক. কিডনির সনোগ্রাফি:
এটি একটি সরল, সুরক্ষিত, শীঘ্র পদ্ধতি যার দ্বারা কিডনিরর অবস্থান, মূত্রপথের অবরোধ, পাথর (Stone) ইত্যাদি ব্যাপারে জানা যায়।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ক্রনিক কিডনি ফেইলর হলে রোগীর কিডনির সংকোচন এই পরীক্ষার দ্বারা বোঝা যায়। কিডনির Size ছোট হয়ে যায়।
খ. পেটের এক্স-রে:
এই পরীক্ষা সাধারনত কিডনির স্টোন (পাথর) নির্ণয়ের জন্য করা হয়।
ইন্ট্রাভেনাস পাইলোগ্রাফি (আইভিপি):
এই পরীক্ষাতে রোগীকে এক বিশেষ ধরনের আয়োডিনযুক্ত (রেডিও কনট্রাস্ট পদার্থ) ঔষধের ইনজেকশন দেওয়া হয়। ইনজেকশন দেবার পরে অল্প অল্প সময়ের অন্তরালে পেটের (X-Ray) নেওয়া হয়। এই X-Ray তে ঔষধ কিডনির মধ্য দিয়ে মূত্রনালিকা দ্বারা মূত্রাশয়ে জমা হতে দেখা যায়।
আইভিপির দ্বারা কিডনির কার্যক্ষমতা আর মূত্রনালিকার অবস্থানের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যায়। এই পরীক্ষা বিশেষ করে স্টোন, মূত্রনালিতে অবরোধ (Obstacle) গীট-এর নির্ণয় করা যায়।
যখন কিডনি খারাপ হবার পরে কম কাজ করে তখন এই পরীক্ষা কার্যকরী হয় না। রেডিও কনট্রাস্ট ইনজেকশন খারাপ কিডনিকে আরও খারাপ করতে পারে।
এই কারণে কিডনি বিকল রোগীদের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা ক্ষতিকারক হতে পারে। আই.ভি.পি একটি X-Ray পরীক্ষা হবার কারন, গর্ভাবস্থায় থাকা বাচ্চার জন্য হানিকারক হতে পারে। সেজন্য গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা করা হয় না।
অন্য রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষা:
কিছু বিশেষ প্রকার কিডনির রোগের জন্য ডপলার, মিক্সইউরেটিং সিস্টোইরেথ্রোগ্রাম রেডিও নিউক্লিয়ার স্টাডি, রেনাল অ্যানজিওগ্রাফি, সি. টি. স্ক্যান, অ্যানটিগ্রেড আর রেট্রোগ্রেড পাইলোগ্রাফি ইত্যাদি পরীক্ষার দ্বারা নির্ণয় করা হয়।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা:
কিডনি বায়োপসি , দূরবিন দ্বারা মূত্রনালিকার পরীক্ষা , এবং ইউরোডাইনামিক্সের মতো বিশেষ প্রকারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিডনির অনেক প্রকার রোগের নির্ণয়ের জন্য বিশেষ প্রয়োজন।
পরিশেষে বলা যায়, কিডনি রোগ জটিলতম রোগগুলোর মধ্যে একটি। এ রোগ হলে মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। তবে শুরুতেই যদি চিকিৎসা নেয়া যায় এবং নিয়ম-কানুন মেনে চলা যায় তাহলে অনেক বছর সুস্থভাবে বাঁচা যায়।
আরও পড়ুন: কিডনির রোগ যেসব কারনে হয়ে থাকে