দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনি বা বৃক্ক যা সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর হয়ে গেলে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। পরিপূর্ণ বিকল হওয়া ছাড়াও কিডনির রোগ নানা ধরণের হয়ে থাকে।
কিডনি রোগের ধরন, কারণ বর্ণনা করে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ।
কিডনি নিজস্ব কোনো রোগে আক্রান্ত হলে কিংবা অন্য কোনো রোগে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিডনির কার্যকারিতা লোপ পায়। কিডনি রোগ সাধারণত দুই ধরনের। যথা: অ্যাকিউট ও ক্রনিক।
ক. অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি (একেআই):
অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি (একেআই) হলো সাময়িক কিডনির সমস্যা যা স্টেজ ওয়ান কিডনি রোগ। ডায়রিয়া, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ প্রভৃতি কারণে হঠাৎ কারো হয়তো কিডনির কার্যকারিতা কমে যেতে পারে বা বিনষ্ট হতে পারে।
আবার কেউ হয়তো ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিল। এরপর দেখা গেল তার হঠাৎ অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি হয়ে গেছে। এ ছাড়া ১৫-২০ শতাংশ কিডনি রোগের কারণ হতে পারে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ওষুধের ব্যবহার।
ডায়রিয়া কিংবা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ার পর দ্রুত যথাযথ চিকিৎসা নিলে কিডনি আবার ভালো অবস্থানে ফিরে আসে। অবহেলা করলে বরং কিডনি স্থায়ীভাবে বিকল হতে পারে।
খ. ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (সিকেডি):
ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (সিকেডি) একটি দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস বা কিডনির প্রদাহ হলো এই রোগের অন্যতম কারণ।
বংশগত বা জন্মগত অসুখ যেমন পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি কিডনির অসুখ হতে পারে। আবার মাতৃগর্ভে কিডনির গঠনগত অস্বাভাবিকতার জন্যও হতে পারে।
এই রোগের মূল সমস্যা হলো, কোনো রকম লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই ধীরে ধীরে কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট হয় এবং রোগের শেষ পর্যায়ে অসুস্থতা প্রকাশ পায়।
কিছু লক্ষণ হলো- শারীরিক দুর্বলতা, ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেওয়া, প্রস্রাব কম হওয়া, ইনফেকশন ইত্যাদি। সিকেডিতে আক্রান্ত হলে পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব হয় না তবে রোগের জটিলতা থেকে রোগীকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা হয়। পরিপূর্ণ কিডনি বিকল হলে ডায়ালিসিস, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করাতে হয়।
দৈনিক আট থেকে ১০ গ্লাস পানি পান, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম করা ও অ্যালকোহল পরিত্যাগ করাসহ ইত্যাদির মাধ্যমে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ প্রতিরোধ করা যায়।
কিডনি রোগের প্রধান প্রধান কারনসমূহ:
কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা স্থায়ীভাবে কিডনি বিকল হয় নানা কারণে। তবে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নেফ্রাইটিসের কারণে ৪৬ শতাংশ, ডায়াবেটিসের কারণে ৩৮ শতাংশ ও উচ্চ রক্তচাপের কারণে ১১ শতাংশ কিডনি বিকল হয়। এ ছাড়া বংশগত, ওষুধের প্রভাব ইত্যাদি কারণ রয়েছে।
ক. নেফ্রাইটিস:
নেফ্রাইটিস হলো কিডনির প্রধান একটি রোগ। যেকোনো বয়সে এ রোগ হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে রোগটি ৯০ শতাংশ নিরাময়যোগ্য। জটিলতা বাধে বড়দের বেলায়। সংক্রামক ও অসংক্রামক এ দুই ধরনের নেফ্রাইটিস হতে পারে।
২০ শতাংশ সংক্রামক ও ৮০ শতাংশই অসংক্রামক কারণে নেফ্রাইটিস হয় যার কারণ সম্পূর্ণ অজানা। সংক্রামক কারণগুলো প্রতিরোধ বা প্রতিকার করা যায়। কিন্তু অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা বেশ জটিল।
নেফ্রাইটিসে শরীর ফুলে যায়, রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় এবং প্রস্রাবে আমিষ নির্গত হয়। এমনকি প্রস্রাবে লোহিতকণিকা, কাস্ট বা শ্বেতকণিকা যেতে পারে।
রক্তে ক্রিয়েটিনিন নামের যৌগিক পদার্থ বেড়ে যেতে পারে। রক্তে চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। কিডনি থেকে সুঁচের মাধ্যমে টিস্যু বের করে তা অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষার মাধ্যমে (বায়োপসির) এই রোগ শনাক্ত করা যায়।
প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসার মাধ্যমে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই জাতীয় ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (সিকেডি) নিরাময় করা সম্ভব। আশঙ্কার কথা হলো চিকিৎসা সত্ত্বেও ১০-১৫ বছরের মধ্যে ৬০ শতাংশ রোগীর কিডনির কার্যকারিতা লোপ পায় এবং কিডনি সম্পূর্ণ অকেজো হয়।
খ. ডায়াবেটিস:
ডায়াবেটিস তেমন কোনো মারাত্মক ব্যাধি নয়। তবে নিয়ম না মেনে চলা ও সঠিক চিকিৎসার অভাবেই এটা মারাত্মক হয়। টাইপ ওয়ান অর্থাৎ কম বয়সের ডায়াবেটিস হলে ইনসুলিনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায়।
বেশি বয়সীদের টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগ হলে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ট্যাবলেট বা ইনসুলিন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ৯৮ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগী হচ্ছে টাইপ টু।
তবে ডায়াবেটিস প্রতিকার এমনকি প্রতিরোধ করাও সম্ভব। সচেতন হয়ে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, ওষুধের নিয়মতান্ত্রিক ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের অভ্যাস ডায়াবেটিক রোগীকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে।
আশঙ্কাজনক তথ্য হলো, ৪০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগী কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়। এটা ডায়াবেটিস রোগ শনাক্ত করার পর থেকে যেকোনো সময়ে হতে পারে।
তাই কেউ কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়েছে কি না তা জানা প্রতিটি ডায়াবেটিক রোগীর জন্য জরুরি। শুধু প্রস্রাব পরীক্ষা করে এবং রক্তের ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা দেখে বোঝা যায়, কেউ ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগে আক্রান্ত কি না।
বিশেষ করে চল্লিশের বেশি বয়সী ডায়াবেটিক রোগীর এবং যাদের বংশে ডায়াবেটিক রোগী রয়েছে তাদের এই পরীক্ষা করা জরুরি।
গ. উচ্চ রক্তচাপ:
কিডনি রোগের তৃতীয় প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। উন্নত বিশ্বে ২০-২৫ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপ রোগের কারণে কিডনি নষ্ট হয়। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপের কারণে ব্রেনস্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক তো আছেই। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না থাকলে তা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের ধারণা, উচ্চ রক্তচাপে উপসর্গ বা লক্ষণ প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসার দরকার নেই। আবার অনেকের ধারণা, সামান্য উচ্চ রক্তচাপের জন্য ওষুধ না খাওয়াই ভালো।
অথবা ওষুধ সেবন করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ হয়ে গেলে আর ওষুধের দরকার নেই। আবার অনেকে মনে করেন, সারা জীবন এই ওষুধ খেতে থাকলে শরীরের অনেক ক্ষতি হতে পারে।
মূলত এসবই ভুল চিন্তা যা থেকেই উচ্চ রক্তচাপ সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়। এর প্রবণতায় পরবর্তী সময়ে কিডনি অকেজো হয়। তখন কিছু উপসর্গ প্রকাশ পায় বটে কিন্তু চিকিৎসকের আর কিছুই করার থাকে না।
তাই কারো উচ্চ রক্তচাপ থাকুক আর না থাকুক নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত। বিশেষ করে চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী যাঁরা এবং বংশে যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে অথবা কিডনি রোগ রয়েছে তাঁদের অবশ্যই বছরে এক-দুবার রক্তচাপ পরীক্ষা করে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।
আর রক্তচাপের পূর্বাভাস পাওয়া গেলে তখন থেকে চিকিৎসা শুরু করা উচিত। একই সঙ্গে জীবনযাত্রার নিয়ম পরিবর্তন, লবণ পরিহার, প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা বা ব্যায়াম করা ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।
ঘ. বংশগত:
অনেক সময় বংশগত কারণে বা পরিবারের কারো কিডনি রোগ থাকলে সে ক্ষেত্রে অন্য কারো কিডনি রোগ হতে পারে। ২-৩ শতাংশ রোগ বংশগত কারণে হয়। তবে একক জেনেটিক কারণে সহজে হয় না।
উত্তরাধিকার সূত্রে কিডনি রোগের প্রধান কারণ পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ যা ওষুধের মাধ্যমে নিরাময় হতে পারে। এতে জন্মগতভাবে কিডনির কার্যকারিতা কম থাকে অথবা কিডনির আকার ছোট বা বেশি বড় থাকে।
এতেও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে। তাই যাদের বংশে কিডনি রোগী ছিল বা আছে তাদের একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
মনে রাখা উচিত, যেকোনো ধরনের কিডনি রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে মারাত্মক নয়। বরং শুরুতে শনাক্ত করা গেলে বেশির ভাগ কিডনি রোগই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
জেনে রাখা ভালো:
১. মানুষের দুটি কিডনিতে প্রায় ২০-২৫ লাখ নেফ্রন বা ছাঁকনি রয়েছে যা প্রতিদিন প্রায় ১৭০ লিটার রক্ত পরিশোধন করে শরীরকে সুস্থ রাখে।
২. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, রক্তস্বল্পতা দূর করা ও অস্থিগুলোকে শক্তিশালী করতে কাজ করে কিডনি।
৩. প্রস্রাবে প্রদাহ কিডনির একটি সাধারণ রোগ হলেও শিশুদের ক্ষেত্রে তা মারাত্মক হতে পারে।
৪. দুটি কিডনি ৮৫-৯০ শতাংশ অকেজো হওয়ার পরই শুধু ডায়ালিসিস বা কিডনি সংযোজনই হলো বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।
৫. কিডনি রোগ ছোঁয়াচে নয় তবে বংশানুক্রমিক হতে পারে।
৬. বাংলাদেশে প্রায় ৪০ হাজার রোগী ধীরগতিতে কিডনি অকেজো হয়ে প্রতিবছর অকালে মৃত্যুবরণ করে।
৭. কিডনি নষ্ট হলে ডায়ালিসিস করে চিকিৎসা করার সামর্থ্য বাংলাদেশের ১০ শতাংশেরই নেই। তাই কিডনি রোগ সম্পর্কে জানুন, সতর্ক থাকুন এবং প্রতিরোধ করুন।
পরিশেষে বলা যায়, কিডনির রোগ নিয়ে অবহেলা নয়, কিডনির যত্নে অবহেলা নয়। কাঁচা লবণ এবং ব্যথার ঔষধ যতোটা সম্ভব পরিহার করুন। নিজেই নিজের চিকিৎসক হতে যাবেন না। সবার সুস্থতা কামনা করছি।
আরও পড়ুন: চোখের ব্যথা থেকে বাঁচার উপায়