কালা+জ্বর = কালা জ্বর। এই রোগে শরীরের রং কালো হয়ে যায় বলে একে কালা জ্বর বলে। কালা জ্বরের জীবাণু কিভাবে মানবদেহে প্রবেশ করে সেটার সঠিক তথ্য এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।
এই সংক্রামক রোগের কারণ হলো মূলত এক প্রকার প্রোটোজোয়া। আবিষ্কারকের এই পরজীবির নামকরণ করা হয় লিসম্যানিয়া ডোনভ্যানি। গ্রীষ্ম প্রধান দেশে সচরাচর কালা জ্বরের প্রাদুর্ভাব বেশি।
আজ থেকে ৪০ বা ৫০ বছর পূর্বে ব্যাপকহারে বাংলাদেশে কালা জ্বরের প্রাদূর্ভাব ছিল। বর্তমানে আমাদের দেশে এই রোগের প্রকোপ নাই বললেই চলে।
অনেকের মতে, স্যান্ডফ্লাই মাছি এই রোগে আক্রান্ত রোগীর দেহ হতে রক্ত চুষবার সময় রোগ জীবাণু বহন করে সুস্থ্য মানবদেহে ঐ রোগ জীবাণু প্রবেশ করিয়ে দেয়।
আবর্জনাযুক্ত স্থানে কিংবা পঁচা নর্দমাযুক্ত স্থানে এই মাছি ডিম পারে বলে সেই স্থানগুলোকে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখতে হয়।
কালা জ্বর হলে যেসব লক্ষণ দেখা দেয়:
১. কালা জ্বর হলে রোগীর দেহে প্রধান একটি লক্ষণ হলো জ্বর। পরবর্তীতে প্লীহা ও যকৃত দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
২. সকল সময় জ্বর কিংবা জ্বরের তাপমাত্রাও অধিক হয় না।
৩. জ্বর থাকা বা না থাকা উভয় অবস্থাতেই কেবল প্লীহা বৃদ্ধি পায়। তবে সেটা খুব নরম থাকে, শক্ত হয় না।
৪. অল্প অল্প জ্বর হয় এবং বহুদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
৫. দীর্ঘদিন ভুগে রোগী নিতান্তই দূর্বল এবং রক্তহীন হয়ে যায়। সর্দি, কাশিসহ প্রভৃতি নানাবিধ উপসর্গ দেখা দেয়। শরীরের চামড়া ধীরে ধীরে কালো রং ধারণ করে এবং চুল পড়ে যায়।
৬. হাত দিয়ে পেট টিপলে প্লীহা হাতে ঠেকে। তবে প্লীহাতে কোন ব্যথা থাকে না।
৭. টাইফয়েডের মতো জিহবা লেপাবৃত থাকে না। কয়েকদিন তাপ কম থেকে পরে আবার বৃদ্ধি পায়।
৮. অনেক সময় কালা জ্বরে আক্রান্ত রোগীর দাঁতের গোড়া এবং নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
৯. ক্ষুধা কমে যায় না বরং দিনে দিনে বৃদ্ধি পায়। এরূপ রাক্ষুসে ক্ষুধা অবশ্য বেশিদিন থাকে না। বেশি খেলে পেটে বদহজম দেখা দিতে পারে।
১০. বুক ধড়ফড় করে এবং শ্বাসকষ্ট হয়। রোগী সত্যিকার অর্থেই খুব দূর্বল হয়ে পড়ে।
১১. চামড়া খসখসে হয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে চামড়ায় ঘা হতে পারে।
১২. ফুসফুস আক্রমণে বেশিরভাগ রোগী মারা যায়। রোগ প্রথমে জটিল থাকে না। তবে জটিল রোগীর বাঁচার আশা নিতান্তই কম।
১৩. দিনে রাতে মাত্র ২ বার জ্বর বৃদ্ধি এই রোগের বিশেষ লক্ষণ।
রোগের লক্ষণ ও দেহ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত উপরোক্ত বিবরণী ছাড়া রোগ নির্ণয়ের অন্যান্য পন্থাবলী:
ক. রক্তে শ্বেতকণিকার (WBC/TC) ক্রম হ্রাসপ্রাপ্তি।
খ. ফরমাল জেল টেস্ট পজিটিভ হয়।
গ. চোপরা টেস্ট – জ্বর শুরু হওয়ার ৩ মাসের মধ্যেই এই টেস্ট পজিটিভ হয়।
ঘ. প্রায় সব রকম অস্থিমজ্জা থেকে প্রাপ্ত রস এবং কখনো রক্ত কালচার করে ফলাজেলা বিশিষ্ট লিসম্যানিয়া প্রদর্শন করা যেতে পারে।
কালা জ্বর এর প্রকারভেদ:
কালা জ্বর হলো মূলত ২ প্রকার। যথা- ক) অ্যাকিউট কালা জ্বর এবং খ) ক্রনিক কালা জ্বর।
চিকিৎসা:
এখানে শুধুমাত্র সেসব ওষুধ উল্লেখ করা হলো যেগুলো সচরাচর চিকিৎসকগণ ব্যবহার করে থাকেন। ওষুধের জেনেরিক নামগুলো তুলে ধরা হলো। তবে কখনোই নিজে নিজে এসব ওষুধ প্রয়োগ করতে যাবেন না। শুধুমাত্র জানার উদ্দেশ্যে এখানে উল্লেখ করা হলো:
Inj. Stibatin
Metronidazole
Tetracycline
Moxifloxacin
Doxycycline
Vitamin C
Metoclopramide
Domperidone & more.
উপরের ওষুধগুলোই যে চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট তা কিন্তু নয়। একেক জন্য রোগীর একেক রকম লক্ষণ থাকতে পারে। লক্ষণভেদে ওষুধও আলাদা হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কখনোই এসব ওষুধ ব্যবহার করবেন না।
পথ্য ও আনুষঙ্গিক চিকিৎসা:
১. ক্ষুধা বেশি হলে অল্প খাবার খাবে, বেশি খেলে পেট খারাপ হতে পারে।
২. তরল পথ্য হিসেবে বার্লি, এরারুট, ফলের রস এবং হরলিক্স জাতীয় খাবার দিতে হয়।
৩. কাগজী লেবুর রস খেলে উপকার হয়।
৪. স্যান্ডফ্লাই মাছি ধ্বংসের জন্য গ্যামাক্সিন পাউডার ছিটাতে হবে। ব্যবহারের পর কাপড়-চোপড় অবশ্যই পরিষ্কার করে নিতে হবে।
আরও পড়ুন: অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা – জিহবার ক্ষত, পেট ফাঁপা ও উদরাময়।
৫. বমি বন্ধের জন্য অ্যান্টি-ইমেটিক জাতীয় ওষুধ খাওয়াতে হবে।
৬. শরীর দূর্বলের জন্য ভিটামিন বি কমপ্লেক্স জাতীয় ওষুধ দিতে হবে।
৭. CFT for Kalazar Test করলে কালা জ্বর বুঝা যায়।
সূত্র: আধুনিক অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা নামক বই