ওষুধ কোম্পানী সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি। বাংলাদেশে প্রায় ২৫০টিরও বেশি ওষুধ কোম্পানী আছে। এই সেক্টরে কাজ করছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। কিন্তু অনেকেই আবার এই সেক্টর সম্বন্ধে তেমন কিছু জানে না।
আজ তাদের জন্যই আমার এই লিখা। আমার অভিজ্ঞতা থেকে যা জানি এবং যা দেখেছি তার সবই আপনাদের জানাবো। কোনো সেক্টর সম্বন্ধে না জেনে হঠাৎ করে সেই সেক্টরে চাকরি নেয়া বা কাজ করা উচিত নয়।
যাই হোক, ওষুধ কোম্পানীতে সবচেয়ে সহজে চাকরি পাওয়া যায়। অন্যান্য জায়গায় আপনি চাকরি নিতে গেলে যতোটা না কাঠ-খড় পোহাতে হয় এখানে আপনাকে তেমন কিছুই করতে হবে না।
প্রথমেই যোগ্যতার কথা বলি। অন্তত অনার্স বা ডিগ্রী পাস হতে হবে। তবে নরমাল কিছু কোম্পানী আছে যারা এসএসসি কিংবা এইচএসসি পাসেও নিয়োগ দেয়। তবে সেগুলোকে আমরা ওষুধ কোম্পানী হিসেবে গণ্য করতে পারি না।
এক থেকে দশ ক্রমিক পর্যন্ত যেসব কোম্পানী রয়েছে এগুলোর বেশিরভাগই সাইন্স ব্যাকগ্রাউন্ড চায়। অর্থাৎ মেট্রিকে অন্তত সাইন্স থাকতে হবে এবং ইন্টারে থাকলে তো কোনো কথাই নেই।
আপনি কত জিপিএ বা গ্রেড নিয়ে পাস করেছেন সেটা দেখার বিষয় নয়। তবে কয়েকটি কোম্পানী আছে যেগুলোতে আপনি সাধারন বিষয় থেকে অনার্স বা ডিগ্রী করে চাকরি নিতে পারবেন না। সেই কোম্পানীগুলোর মধ্যে রয়েছে রেডিয়েন্ট, হেলথকেয়ার ইত্যাদি।
তবে ভবিষ্যতে এরকম রিকুয়ারমেইন্টস চেঞ্জও হতে পারে। যাই হোক, আমি বোঝাতে চাইলাম যে, আপনি যদি অনার্স বা ডিগ্রী পাস করে থাকেন তবে আপনি ওষুধ কোম্পানীতে চাকরি করতে পারবেন। তবে মান সম্মত কোম্পানীতে চাকরি নিতে গেলে আপনার মেট্রিক বা ইন্টারে যেকোন ১টি বা দুটোতেই সাইন্স ব্যাকগ্রাউন্ড থাকতে হবে।
মনে রাখবেন, শুধুমাত্র ওষুধ কোম্পানীতে চাকরির জন্য কোনো তদবির লাগে না। কোনো টাকা পয়সা কিংবা ঘুষ লাগে না। কারও প্ররোচনায় পড়ে কাউকে কোনদিন চার আনা পয়সা দিতে যাবেন না। তাহলে বোকামি করবেন।
সার্কুলার হওয়ার পরে সাধারণত কোনো আবেদন করতে হয় না। তবে কোনো কোনো কোম্পানীর নিয়ম অনুযায়ী নিজে হাতে লিখা আবেদনপত্র কিংবা অনলাইনে ইমেইল এর মাধ্যমে আবেদনপত্র পাঠানোর প্রয়োজন পড়তে পারে। তবে আপনার কাজ হবে, আপনি অবশ্যই সার্কুলারটি ভালোভাবে ও মনোযোগ সহকারে পড়বেন আগে। তারপর আপনি নিজেই বুঝবেন যে কি করতে হবে।
বেশিরভাগ কোম্পানীই সার্কুলার দেয়ার পর নির্দিষ্ট কয়েকটা তারিখে ওয়াক ইন ইন্টারভিউ Walk in Interview) এর আয়োজন করে। সেখানে আপনার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো নিয়ে গিয়ে সরাসরি ইন্টারভিউ দিতে হয়।
কাগজপত্রগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো- আপনার এসএসসি, ইন্টার ও অনার্স বা ডিগ্রী পাসের (সবগুলোর) মূল সার্টিফিকেট ও সাথে সত্যায়িত ফটোকপি, চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত পরিচয়পত্র, ভোটার আইডি কার্ড, দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবিসহ ইত্যাদি।
আপনি বিজ্ঞপ্তিতে আগে ভালো করে দেখবেন। সেখানে যা যা নিতে বলা হয়েছে ওগুলোই নেবেন। একেক কোম্পানীতে একেক রকম কাগজপত্র চায়। তাই আগেই সব বলা সম্ভব না। তবে উপরে যেসব কাগজপত্রের কথা বলেছি সেগুলো প্রায় সব কোম্পানীতেই চায়।
ওয়াক ইন ইন্টারভিউ এ আপনি একা গেলেই হবে। কাউকে সাথে না নিয়ে গেলেও হবে। সেখানে আপনাকে সাধারন কিছু প্রশ্ন করবে। কয়েকটি ট্রান্সলেশন ধরতে পারে। হাতের লিখা দেখতে চাইতে পারে। জীব বিজ্ঞান থেকে সাধারন কিছু প্রশ্ন করে।
সমসাময়িক বিষয় থেকে প্রশ্ন করতে পারে। তবে খুব কঠিন প্রশ্ন করে না। আপনার ইন্টারভিউ সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যেই শেষ হবে। সেখানে ভয় না করলে টিকে যাওয়ার গ্যারান্টি ১০০% থাকে।
ইন্টারভিউ এর জন্য একটু পড়াশোনা করে যাবেন। আমি যদি পারি পরবর্তীতে কিছু সাজেশন্স দেয়ার চেষ্টা করবো। তাহলে সবার উপকার হবে।
ইন্টারভিউ-এ সফলভাবে আপনি টিকে গেলে তখন আপনার লিখিত পরীক্ষা হতে পারে। এরকমটা সব কোম্পানী করে না। বিশেষত বেক্সিমকো, ইনসেপ্টা ও স্কয়ার এরকম করে থাকে।
লিখিত পরীক্ষায় আপনি টিকে গেলে তবেই আপনি সফল। তখন আপনার ট্রেনিং শুরু হবে। তবে কোনো কোনো কোম্পানী লিখিত পরীক্ষা আগে নিয়ে পরে ভাইভা পরীক্ষা নেয়।
তবে বিশেষভাবে মনে রাখবেন, ভাইভা আর লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমেই যে আপনার বাছাই পর্ব শেষ তা কিন্তু নয়। আপনাকে নিয়োগ দেয়ার আগে পর্যন্ত গোপনে আপনার প্রতি লক্ষ্য তারা রাখবেই। কোনো ধরণের মেজর ত্রুটি পেলেই আপনাকে ছাটাই করে দেবে। তাই নিয়োগ পাওয়ার আগে পর্যন্ত খুব সাবধানে থাকবেন।
এখন ট্রেনিং এর কথা বলি। ট্রেনিং সাধারনত ঢাকায় হয়। ৩৫ দিন থেকে শুরু করে ৪৫ দিন পর্যন্ত ট্রেনিং হয়। করোনার সময়ে অনলাইনে ট্রেনিং নিয়েছে সব কোম্পানী। কিন্তু বর্তমানে অফলাইনে অর্থাৎ ঢাকায় সরাসরি ট্রেনিং হয়।
ট্রেনিং এর সময় আপনাকে সকাল ৮.৩০ মিনিট এর মধ্যে অফিসে পৌছতে হবে এবং বিকাল ৫.০০ টায় ছুটি পাবেন। মাঝখানে দুপুরে খাওয়ার জন্য ১ ঘন্টা সময় দেয়। কোনো কোনো কোম্পানী নিজ থেকেই অফিসে খাওয়ায় আবার কোনো কোম্পানী খাওয়ায় না। তখন আপনাকে বাইরে খেতে হবে।
ট্রেনিং এর সময় সারাক্ষণ পড়াশোনা চলে। ক্লাসেই পড়া দেবে এবং পড়া নেবে। কোনো ধরণের ত্রুটি করা যাবে না। কোনো ফল্ট করা যাবে না। পরীক্ষায় নকল করা যাবে না। তবেই আপনি টিকতে পারবেন।
এভাবে একটানা ৪৫ দিনের ট্রেনিং শেষ হলে আপনাকে নিয়োগ দেবে। এর মধ্যে কোনো ছুটি পাবেন না। শুধু শুক্রবার এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শনিবার ছুটি পেতে পারেন।
নিয়োগের সময় আপনার কাছে কিছু অতিরিক্ত কাগজ-পত্র নেবে। বিশেষ করে যেগুলো ক্রেডিট কোম্পানী সেগুলোতে এই ধরণের কাগজপত্র গুলো লাগবেই। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো – আপনার নামের অ্যাকাউন্টের ব্ল্যাংক চেক, স্ট্যাম্প ইত্যাদি।
কারণ, ঐ ধরণের কোম্পানীতে বাকিতে ওষুধ বিক্রি করতে হয়। আবার, সেই টাকা আপনাকেই উঠাতে হবে। এস.আর আপনাকে হেল্প করবে। যদি আপনি কখনো বেশি পরিমাণ টাকা নিয়ে চলে আসেন। তাই এসব কাগজপত্র আপনার কাছে থেকে নিয়ে রাখে কোম্পানী।
যাই হোক, এসব প্রক্রিয়া শেষ হলে আপনাকে ফাইনালী নিয়োগ পত্র দেবে ওষুধ কোম্পানী। আপনি বাংলাদেশের কোথায় পড়বেন সেটা বলতে পারবেন না। কোনো আরজিও জানাতে পারবেন না। তারা যেখানে দেবে সেখানেই ফাইনাল। তবে কোম্পানীতে আপনার কাছের কেউ যদি কোনো বড় পদে থাকে তবে একটু সুপারিশ করার অধিকার রাখে।
আপনাকে যখন জানিয়ে দেবে যে, আপনার নিয়োগ হয়েছে অমুক জায়গায় তখন আর তেমন ছুটি আপনি পাবেন না। আপনাকে সব কিছু রেডি করে সর্বোচ্চ চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে আপনার কাজের জায়গায় আসতে হবে।
যেদিন আপনার মার্কেটে আপনি আসবেন সেদিন হয়তো এরিয়া ম্যানেজার কিংবা কোনো সিনিয়র কলিগ আপনাকে রিসিভ করবে। রিসিভ করে নিয়ে যাবার পরে আপনাকে আর রেস্ট নিতে দিবে না।
আপনি হয়তো ভাববেন, অনেক দূর থেকে জার্নি করে এসেছি – হাফ বেলা জিরিয়ে নেই, কিন্তু অসম্ভব। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনটা হতে পারে যদি এরিয়া ম্যানেজার খুব ভালো প্রকৃতির মানুষ হয়।
আপনি হয়তো সকাল ৭ টায় আপনার মার্কেট এরিয়ায় নামছেন কিন্তু রিসিভ করে নিয়ে যাবার পর আপনাকে সকাল ৮.৩০ কিংবা ৯.০০ টার মধ্যে মার্কেটে বের হতে হবে।
সেদিন থেকে সেই মূহুর্ত থেকে আপনার কাজ শুরু। আর কোনো রেস্ট করার সুযোগ নেই। হয়তো শুক্রবার আসলে আপনি একটু বেশি ঘুমাতে পারবেন। তাছাড়া সপ্তাহের ৬ দিনই আপনাকে সকাল ৯ টা থেকে রাত ১১ টা কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১২ টা ১ টা পর্যন্ত মার্কেটে কাজ করতে হবে।
তবে দুপুর বেলা আপনি রেস্ট নিতে পারবেন। তবে প্রতিদিন পারবেন না। আবার কোনো কোনো শুক্রবারেও কাজের পাশাপাশি মিটিং এর ব্যবস্থা রাখা হয়।
যাই হোক, মার্কেটে আপনার কাজ শুরু হলো। ওষুধ কোম্পানীর চাকরি যেমন সহজ মনে হয় তেমন সহজ আসলে নয়। মেনে নিতে পারলে করা যায় কিন্তু না মেনে নিতে পারলে চাকরি করা অসম্ভব।
মার্কেটের যে কাজ তার মধ্যে প্রধান হলো ডাক্তার ভিজিট করা। এই ক্ষেত্রে আপনাকে কোম্পানী কিছু প্রোমো ম্যাটেরিয়ালস দেবে। সেটা হতে পারে ওষুধের স্যাম্পল, বিভিন্ন প্রকার গিফ্ট এবং লিটারেচার।
কিছু কোম্পানী আছে শুধু গিফ্ট দেয় আবার কিছু কিছু কোম্পানী স্যাম্পল ও গিফ্ট দুটোই দেয়। আবার কিছু কোম্পানী সবই দেয়। আপনি যে কোম্পানীতে জয়েন করবেন সেই কোম্পানীর নিয়ম অনুযায়ী সব কিছুই পাবেন।
আপনার আন্ডারে যতজন ডাক্তার থাকবে তাদের সবাইকে সিরিয়ালি আপনার ভিজিট করতে হবে। ভিজিট করার সময় ডাক্তারের রুমে লিটারেচার নিয়ে যেতে হয় এবং কোনো গিফ্ট বা গেজেট নিয়ে যেতে হয়। লিটারেচারে থাকা তথ্য ডাক্তারকে বলতে হয়। সেটা হতে কয়েক সেকেন্ড কিংবা ১ বা ২ মিনিট।
আসলে আপনাকে ট্রেনিং দেয়ার সময় যেভাবে ভিজিট করা শেখাবে সেটা বাস্তবে আপনি প্রয়োগ করতে পারবেন না। বাস্তবটা আসলে একেবারেই ভিন্ন। যে ডাক্তারের সাথে যেভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলবেন সে ডাক্তারের সাথে সেভাবেই ভিজিট আপনি করতে পারবেন। এখানে আপনার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে।
আপডেট চাইলে কমেন্ট করে জানান…