এলার্জি রোগ:
এলার্জি হলো শরীরের ইমিউন সিস্টেমের একটি দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা যা পরিবেশের কোনো এলার্জেনের কারণে শরীরের মধ্যে যেকোন সময় হাইপারসেনসিটিভিটি দেখায় অথবা প্রত্যাশিত নয় এমন প্রতিক্রিয়া দেখায়।
আর এলার্জেন হলো ঐসব বস্তু বা উপাদান যারা এলার্জি তৈরী করে অর্থাৎ শরীরে প্রবেশ করে হাইপারসেনসিটিভিটি ইফেক্ট দেখায়। বস্তুত সব ধরণের এলার্জির জন্যই দায়ী কেবল বিভিন্ন ধরণের এলার্জেন।
যেসব কারণে এলার্জি হয়:
বায়ুবাহিত কারণে মানুষের এলার্জি বেশি হয়। এগুলো হলো খুবই সাধারণ বিষয়। কিছু মাইক্রোস্কোপিক পোকামাকড় আমাদের পরিবেশে রয়েছে যাদের ডাস্ট মাইটস বলে।
এগুলো প্রতিদিন আমাদের শরীর থেকে পড়ে থাকা লক্ষ লক্ষ মৃত ত্বকের কোষসমুহকে খায়। এলার্জির প্রধান একটি উপাদান হলো ঘরের ধুলা-বালি।
আপনি জানলে অবাক হবেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ অঞ্চলে সারা বছর ধুলোতে ‘মাইট’ নামক এলার্জেন এর উপস্থিতি থাকে এবং ঘরের বিছানায়, কার্পেটে ও গৃহ-সজ্জায় ‘মাইট’ এর উপস্থিতি দেখা যায়।
আবার, এলার্জির আরেকটি প্রধান কারণ হলো পরাগ। অন্য সব উদ্ভিদকে নিষিক্ত করার জন্য গাছ, আগাছা এবং ঘাস এই ক্ষুদ্র কণাগুলোকে (পরাগ) বাতাসে ছেড়ে দেয়।
পরাগ থেকে যে এলার্জি হয় তা মৌসুমী এলার্জি নামে পরিচিত। কারণ, এ ধরণের এলার্জি সারা বছর হয় না। পরাগের ধরণের উপর এলার্জির বিভিন্ন ধরণ নির্ভর করে।
এলার্জি আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভবিষ্যতে এলার্জির সমস্যা কেমন হবে, তারা কতটা ভালো কিংবা খারাপ অবস্থায় থাকবে তা বলে দেয়া সম্ভব যদি বাতাসে পরাগের পরিমাণ পরিমাপ করা হয়।
পরাগের সংখ্যা সাধারণত (বাতাসে) সকালের দিকে বেশি হয়। এছাড়া উষ্ণ বা শুষ্ক দিনেও বাতাসের পরাগের সংখ্যা বেশি হয়। অন্যদিকে ভেজা এবং ঠাণ্ডা পরিবেশে বাতাসে পরাগের সংখ্যা কমে যায়।
পোষা প্রাণীর এলার্জেন প্রাণী ডান্ডার যেটাকে শেডের চামড়ার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে বলা যায় তা দিয়ে হয়। পশুর লালা থেকেও এটা হতে পারে।
পোষা প্রাণী যখন চাটে তখন তাদের লোম বা পালকের উপর লালা পড়ে। লালা যখন রোদের তাপে শুকিয়ে যায় তখন সেখানে থাকা প্রোটিন কণা বাতাসে উড়ে যায় এবং কাপড়-চোপড়ে লেগে যায়।
জানলে অবাক হবেন যে, পোষা প্রাণীর প্রস্রাবও এইভাবে এলার্জি সৃষ্টি করতে পারে।
অন্যদিকে তেলাপোকাকে একটি প্রধান গার্হস্থ্য এলার্জেন বলা হয়। অভ্যন্তরীণ শহরগুলোতে এর উপদ্রব বেশি দেখা যায়। শিশুদের হাঁপানির মতো অবস্থা তৈরী করতে তেলাপোকার (এলার্জেন হিসেবে) ভূমিকা অনেক।
এলার্জির জন্য দায়ী খাবার:
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমেরিকায় ৮% শিশু খাদ্য এলার্জির মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশেও এই অবস্থা কোন অংশে কম নয়। আমরা প্রতিনিয়ত যেসব খাবার খাই সেগুলোর বেশিরভাগের মধ্যেই কারও কারও জন্য এলার্জেন উপস্থিত থাকতে পারে।
সাধারণত গরুর দুধ, ডিম, চিনাবাদাম, পুঁই শাক, কচু শাক, চিংড়ি মাছ, গম, সয়া সহ ইত্যাদি খাবারে এলার্জেন এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
গরুর দুধ: সাধারণত ৩ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের মধ্যে ২% এবং তিন বছরের বেশি বয়সী বাচ্চাদের মধ্যে ৩% বাচ্চার গরুর দুধে এলার্জিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। দুধ দিয়ে তৈরী খাবার থেকেও শিশুদের এলার্জি হতে পারে। তাই বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে সাবধান হোন যদি এলার্জিক প্রতিক্রিয়া থাকে।
ডিম: অনেকের ডিম থেকেও এলার্জি হতে পারে। সবার হয় না। সাধারণত হাঁসের ডিম খেলে বেশি হয়। ডিম থেকে তৈরী খাবারগুলো থেকেও এলার্জিক লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। অন্যদিকে, বাচ্চার বয়স বাড়ার সাথে সাথে ডিম শরীরে এলার্জিক প্রতিক্রিয়া বাড়িয়ে তুলতে পারে।
বিভিন্ন প্রকার বাদাম: সব ধরণের বাদামেই (চিনা বাদাম, আখরোট, পেকান, হ্যাজেলনাট, কাজু বাদাম) কম বেশি এলার্জি রয়েছে। সাধারণত গাছে ধরে এমন বাদাম কিংবা কাজু বাদাম এলার্জি বাড়ায় না। কিন্তু এলার্জি হতে পারে।
বিভিন্ন প্রকার মাছ এবং ঝিনুক: মাছ এবং ঝিনুক থেকে যেসব এলার্জিক প্রতিক্রিয়া হয় তা সাধারণত বড়দের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। সব মাছে সবার এলার্জিক প্রতিক্রিয়া হয় না। ইলিশ মাছের মধ্যে এলার্জেন রয়েছে যা অনেকের মধ্যেই প্রতিক্রিয়া তৈরী করতে সক্ষম।
গম: গম খুব পরিচিত একটি শস্য দানা। দেশের গ্রামাঞ্চলে এবং বড় বড় কৃষি খামারে এর ব্যাপক উৎপাদন লক্ষ্য করা যায়। এলার্জির জন্য গম অনেকটা দায়ী। গমের এলার্জি সাধারণত সিলিয়াক রোগের মতো।
কিন্তু তবুও সিলিয়াক রোগের সাথে গমের এলার্জির অনেক তফাৎ রয়েছে। গমের এলার্জি কারও জীবনকে বিপন্ন পর্যন্ত করতে পারে।
সয়া: বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের এলার্জি বেশি হয় এই সয়া’র কারণে। যাদের গরুর দুধে এলার্জিক প্রতিক্রিয়া আছে তাদের সয়া’তেও এই ধরণের প্রতিক্রিয়া হবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ, গরুর দুধের প্রোটিন আর সয়া’র প্রোটিন একই।
আরও যেসব কারণে এলার্জি হয়:
বিভিন্ন ধরণের পোকামাকড়: পোকামাকড় থেকেও এলার্জিক প্রতিক্রিয়া শুরু হতে পারে অর্থাৎ পোকামাকড়ের কামড়ের কারণে। পোকামাকড় কামড় দেয়ার ফলে কামড়ানোর স্থানটি ফুলে যায়, লাল হয়ে যায়, চুলকায়। এটাই এক ধরণের এলার্জি।
তবে পোকার বিষে কারও যদি এলার্জিক প্রতিক্রিয়া থাকে তবে তা তার জন্য আরও মারাত্মক। তবে পোকামাকড় না কামড়ানো পর্যন্ত তা বোঝা যায় না। সাধারণত মৌমাছি, ভেমরুল কিংবা বিশেষ জাতের পিপড়া কামড়ালে খুব তাড়াতাড়ি সবার জন্যই এক প্রকার এলার্জিক বিরুপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়।
বিভিন্ন ধরণের ওষুধ: বাজারে বিভিন্ন ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ পাওয়া যায় যা সাধারণত ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে। তবে শুধু অ্যান্টিবায়োটিক-ই নয়, অন্যান্য সাধারণ ওষুধসমুহ (ওটিসি ড্রাগ) বিশেষ সময়ে এলার্জির মতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।
রাসায়নিক পদার্থ: পৃথিবীতে জানা অজানা বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। রাসায়নিক পদার্থগুলোও এলার্জির মতো প্রতিক্রিয়া তৈরী করতে পারে।
সাধারণত বিভিন্ন ধরণের প্রসাধনী, লন্ড্রিতে ব্যবহৃত জিটারজেন্ট, গাছপালায় ব্যবহৃত রং, গৃহস্থালি কিংবা ঘরবাড়ি পরিষ্কারক এবং কীটনাশক বিভিন্ন প্রকার এলার্জির জন্য দায়ী।
যেসব পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরের এলার্জি টেস্ট করা যায়:
সাধারণত কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরের এলার্জি টেস্ট করা যায়। আর বিশেষ ক্ষেত্রে সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করার জন্য অবশ্যই পরীক্ষাগুলো করা উচিত। নিম্নে পরীক্ষার নামগুলো উল্লেখ করা হলো:
- রক্ত পরীক্ষা
- সিরাম আই,জি,ই এর মাত্রা নির্ণয়
- বুকের এক্সরে
- স্কিন প্রিক টেস্ট
- স্পাইরোমেট্রি
এলার্জিজনিত রোগ:
এলার্জির কারণে অনেক রোগ হতে পারে। প্রত্যেকটি রোগের লক্ষণের মধ্যে কিছুটা মিল ও অমিল থাকবে। কি কি রোগ হতে পারে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
- খাবারে এলার্জি
- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জনিত এলার্জি
- এলার্জিজনিত সর্দি বা এলার্জিক রাইনাইটিস
- আর্টিকেরিয়া
- অ্যাজমা বা হাঁপানি
- এলার্জিক কন্টাক্ট ডারমাটাইটিস
- একজিমা ইত্যাদি
এলার্জির চিকিৎসা:
এলার্জির বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসা রয়েছে। তবে এলার্জি কেন হয়েছে তা আপনাকে আগে বের করতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেতে হয়।
যেসব খাবারে এলার্জি রয়েছে (আপনার জন্য) সেগুলো পরিহার করুন। অনেক সময় এলার্জির জন্য ভ্যাকসিনও নেয়া যায়।
এলার্জি থেকে রেহাই পেতে হলে আপনাকে সব নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। মনে রাখবেন, এলার্জি থেকে পরিত্রাণ একটা দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি।
অনেকে বলে থাকেন যে, এটা পুরোপুরি নির্মূল হয় না। কিন্তু তথ্যটি ভুল। এ রোগ শরীরে দেখা দেয়া মাত্রই যদি খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা হয় এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাওয়া যায় তবে তা নির্মূল হবে অবশ্যই।
আরও পড়ুন: নিম ও হলুদের নানা ধরণের ভেষজ উপকারিতা।
আর যদি বছরের পর বছর কোনো চিকিৎসা না করা হয়, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন না আনা হয় তবে তখন তা জটিল রোগে পরিণত হয়ে যায়। তখন এত সহজে তা দূর করা যায় না।
এলার্জি দূর করার ঘরোয়া উপায়:
এলার্জির কি যন্ত্রনা তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। এলার্জি দূর করার জন্য অনেকে অনেক রকম চেষ্টা করেন। ভালো ভালো খাবার সামনে রেখেও খেতে পারেন না এলার্জির ভয়ে। তবে একটা উপায় আছে যা মেনে চললে সারাজীবনের জন্য সহজেই এলার্জি দূর করতে পারবেন। চলুন তা জেনে নেই –
যে ব্যক্তির এলার্জি সংক্রান্ত সমস্যা থাকে তিনিই বোঝেন এর কি জ্বালা। অনেকেই বিভিন্নরকম পদ্ধতিতে এটি দূর করার চেষ্টা করেন।
ভালো ভালো খাবার সামনে রেখেও খেতে পারেন না কেবল এলার্জির ভয়ে। তবে কিছু উপায় আছে যা মেনে চললে এলার্জি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। চলুই জেনে নিই:
- প্রথমে এক কেজি নিমপাতা ভালো করে রোদে শুকিয়ে নিন।
- শুকনো পাতা পাটায় পিষে গুঁড়ো করে একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কৌটায় ভরে রাখুন।
- ১ চা চামচের ৩ ভাগের ১ ভাগ নিম পাতার গুঁড়া এক গ্লাস পানিতে আধ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন।
- আধ ঘন্টা পর চামচ দিয়ে ভালো করে নেঁড়ে নিন।
- প্রতিদিন সকালে খালি পেটে, দুপুরে ভরা পেটে এবং রাতে শোয়ার আগে খেয়ে ফেলুন।
উপরে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই তৈরী করবেন। তারপর নিয়মিত সেবন করুন। ইনশাআল্লাহ উপকার পাবেন নিশ্চিত।
প্রকৃতপক্ষে এলার্জি সমস্যা নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর ব্যাপার। কম বেশি সবার মধ্যেই এলার্জি দেখা যায়। বছরের পর বছর কেউ যদি চিকিৎসা না করেন তবে মারাত্মক সমস্যা হতে পারে।
এলার্জি আছে এমন ব্যক্তির অবশ্যই খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে। প্রয়োজনে কিছু ওষুধ খেতে হবে। তবেই সুস্থ্যভাবে জীবন-যাপন করা সম্ভব।