উত্তরাধিকার সম্পত্তি বলতে বোঝায়, বাবার সম্পত্তি ছেলে-মেয়ের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া। সম্পত্তির মালিকানা ব্যক্তি যখন মারা যায় তখন উত্তরাধিকার সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা হয়।
কিন্তু এটা নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়। বিভিন্ন পরিবারে ভাই তার বোনকে সম্পত্তি দিতে চায় না। নানারকম সমস্যার সৃষ্টি হয়। আজ আমরা এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
আশা করি, আলোচনাটি কাজে লাগবে। উত্তরাধিকার সম্পত্তি হতে কেউ আপনাকে বঞ্চিত করতে পারবে না। আপনি শুধু ভালো মতো পুরো লিখাটি পড়ুন। তারপর যা বোঝার নিজেই বুঝে যাবেন।
জমি বন্টনের মামলা যেভাবে করতে হয়:
আপনার ভাই, বোন, চাচা বা কোন উত্তরাধিকার আপনাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে তখন কি করণীয় বা কি করবেন?
অনেক সময় ওয়ারিশদের সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে নিয়ে ঝগড়া, ফ্যাসাদ বা মারামারি লেগে যায় এমনকি খুনাখুনি পর্যন্ত হয়ে যায়।
আবার অনেক সময় ওয়ারিশদের সম্পত্তি সঠিভাবে বণ্টন হয় না। যেমন- এক ভাই বেশীমূল্যের জমিজামা নিয়ে অন্য ভাইকে বা বোনকে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের জমি দেয়।
তো এসব ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে সবচেয়ে উপযুক্ত উপায় হল আদালতে উক্ত সম্পত্তির বণ্টন চেয়ে মামলা করা। এতে আদালত সকল ওয়ারিশদের সঠিকভাবে সম্পত্তি বুঝিয়ে দেয়।
কোন মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যুর পর যদি তার সম্পত্তি থেকে থাকে, অর্থাৎ যদি তিনি কোন সম্পত্তি রেখে মারা যান, তবে ঐ সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারদের মধ্যে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বা ফারায়েজ অনুসারে বণ্টন করা হয়ে থাকে।
এই ফরায়েজ আসলে পবিত্র কুরআনের নির্দেশ এবং আইন, তাই একে কোরানিক আইনও বলা হয়ে থাকে।
তবে এটা বলে রাখা ভাল যে, মৌলিক কোরানিক আইন ছাড়াও আরো কিছু আইনের সাহায্যে আমাদের বর্তমান উত্তরাধিকার আইন পরিচালিত হয়।
উত্তরাধিকার আইন নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক ভুল ভ্রান্তি আছে যার ফলে দেখা যায় আমাদের বাপ দাদার মৃত্যুর পর আমাদের কাছের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যেই মামলা মোকদ্দমা শুরু হয়। সম্পর্ক গুলো নষ্ট হয় যা থেকে বাঁচতে উত্তরাধিকার আইন জানার কোন বিকল্প নেই।
জমি বা সম্পত্তি বণ্টন কি?
ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির সীমানা চিহ্নিত করে যার যার প্রাপ্ত স্বত্ব বুঝে নেবার প্রক্রিয়াটি হচ্ছে “বণ্টন”।
স্থানীয় বা পারিবারিকভাবে বণ্টনের আইনগত ভিত্তি দুর্বল। উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন করার জন্য আইনানুগ পদ্ধতি অবলম্বন করাটাই শ্রেয়।
এ জন্য সকল শরিককে এখতিয়ার সম্পন্ন দেওয়ানী আদালতে একটি মামলা করতে হয় যা বণ্টন মোকদ্দমা বা বাটোয়ারা মামলা বা পার্টিশন স্যুট নামে পরিচিত।
সম্পত্তির শরিক দুই প্রকার। যথা- ১. উত্তরাধিকার সূত্রে শরিক বা কো-শেয়ারার বাই ইনহেরিটেন্স এবং ২. খরিদ সূত্রে শরিক বা কো-শেয়ারার বাই পারচেজ।
বণ্টনের মামলা করার সময় সকল শরিকগণ মামলায় পক্ষভুক্ত হতে হবে। কোন একজন শরিক বাদ থাকলে বণ্টননামা শুদ্ধ হবেনা।
যদি শরিকগণ আপোষ মতে বণ্টন করতে রাজী না হন তাহলে যে কোন শরিক বণ্টনের জন্য আদালতে উক্ত সম্পত্তির বণ্টন চেয়ে মামলা করতে পারেন।
বণ্টন মামলা করার জন্য কি কি প্রয়োজন?
বণ্টন মোকদ্দমা দায়েরের জন্য একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে। পাশাপাশি সম্পত্তির মালিকানা সংশ্লিষ্ট সকল কাগজ পত্র যেমন ভূমি জরিপ খতিয়ান, নামজারী খতিয়ান, মালিকানা দলিল, উত্তরাধিকার সনদ ইত্যাদি সংগ্রহে রাখতে হবে।
মামলা করার জন্য কোর্ট ফি দিতে হয় ১০০ টাকা কিন্তু ছাহাম চাইলে প্রতি ছাহামের জন্য অতিরিক্ত ১০০ টাকা ফি জমা দিতে হয়।
বাটোয়ারা মামলায় সাধারণত প্রত্যেক দাগের জমি সকল সহ-শরীক এর মধ্যে বণ্টিত হয়ে থাকে৷ বাটোয়ারা বা বণ্টন মামলায় ২ বার ২টি ডিক্রী হয়।
প্রাথমিক ডিক্রী: এ ডিক্রীতে হিস্যানুযায়ী বণ্টন আদেশ দেয়া হয়।
চূড়ান্ত ডিক্রী: এ ডিক্রীতে প্রয়োজনে আমিন কমিশন পাঠিয়ে সরেজমিনে সম্পত্তির দখল দেয়া হয় এবং সীমানা পীলার দ্বারা বিভাজন (জমির ভাগ) চিহ্নিত করার মাধ্যমে চূড়ান্ত ডিক্রী প্রচার করা হয় ৷
আদালত প্রয়োজনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োগ করে সম্পত্তির সীমানা চিহ্নিত করে ডিক্রী প্রাপককে সম্পত্তির দখল দেয়ার ব্যবস্থা করে থাকেন।
বণ্টনের শর্ত সমূহ:
বণ্টনের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত জড়িত। যেমন-
১. পরিমাপ করে শরীকদের ভূমির বা জমির সীমানা চিহ্নিতকরণ করতে হবে।
২. বণ্টন তালিকায় প্রত্যেক সহ-মালিকের বরাদ্দকৃত সম্পত্তির উল্লেখ থাকতে হবে।
৩. তালিকায় মালিকানার বিভাজন সকল সহ-মালিক কর্তৃক স্বীকৃত হতে হবে;
৪. বণ্টনের বিবরণ সুস্পষ্ট হতে হবে।
৫. প্রত্যেকটি তালিকা সহ-মালিকবৃন্দ কর্তৃক স্বাক্ষরিত হতে হবে।
৬. যথাযথভাবে স্ট্যাম্প শুল্ক দিয়ে দলিলটি রেজিস্ট্রি করতে হবে।
৭. সহ-শরীকগণ আপোষ বণ্টন করে পরবর্তীতে তাদের কেউ তা না মানলে দেওয়ানী আদালতের মাধ্যমে তা কার্যকর করা য়ায় ৷
বণ্টন এবং বণ্টক দলিল কি?
১৮৯৯ সালের স্ট্যাম্প এক্ট এর ২ (১৫) ধারায় বলা হয়েছে যে, বণ্টন দলিল ও বণ্টক দলিল অর্থ একই। যখন কোন সম্পত্তির সহ-শরিকগণ তাদের সম্পত্তি ব্যক্তিগত মালিকানায় পৃথকভাবে ভাগ করে নেয় বা নিতে সম্মত হয়ে কোন দলিল করে তাকেই বণ্টন বা বণ্টক দলিল বলে।
বণ্টননামা দলিলের রেজিস্ট্রি ফি কত?
রেজিস্ট্রেশন (সংশোধন) আইন ২০০৪ আইনের ১৭ (১) এর ধারার বিধান অনুসারে, বাটোয়ারা বা আপোষ-বণ্টননামা রেজিস্ট্রি করতে হবে, অর্থাৎ রেজিস্ট্রি বাধ্যতামূলক।
সকল সহ-শরিকের মধ্যে জমি হিস্যানুযায়ী (স্ট্যাম্প এর উপর) বণ্টন করে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দাখিল করে বণ্টননামা দলিল রেজিস্ট্রি করা যায়৷
এ দলিল রেজিস্ট্রির জন্য স্ট্যাম্প খরচ লাগবে জমির যে মূল্য লেখা হবে তার ২% হারে ৷ এছাড়া অন্যান্য ফি কবলা দলিল রেজিস্ট্রিতে যেমন লাগে অনুরূপ লাগবে ৷ তবে এই হার সরকার কর্তৃক সময় সময় পরিবর্তনযোগ্য।
বণ্টন হওয়ার পর করণীয় কি?
আদালতের মাধ্যমে বণ্টন হওয়ার পর এবং বণ্টন দলিল রেজিস্ট্রি পর অবশ্যই নিজ নামে নামজারী, জমাভাগ খতিয়ান করে নিতে হবে।
পাশাপাশি খাজনা প্রদান করতে হবে। মনে রাখবেন, নামজারী হচ্ছে সরকারিভাবে সম্পত্তিকে নিজ নামে রেকর্ড করা।
উত্তরাধিকার হতে যারা কখনোই বাদ পড়ে না:
মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে নিচের ৬ জন যদি জীবিত থাকে তবে তারা কোন অবস্থায়ই উত্তরাধিকার হতে বাদ যায় না। যথা- পিতা, মাতা, স্বামী, স্ত্রী, ছেলে এবং মেয়ে।
উত্তরাধিকারী হয়েও সম্পত্তি পাবে না যারা:
জেনে রাখা ভালো, কোন উত্তরাধিকারীকে সাধারণত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায় না। যেমন- ইসলাম ধর্মে ত্যাজ্য করা যায় না, কেউ কেউ মুখ করলেও তার আইনগত কোন ভিত্তি নেই।
তাই ত্যাজ্য করলেও সম্পত্তি পাবে। অন্যদিকে ইসলামে এডাপশন বা পালক পুত্র বলে (আইনগত ভাবে) কিছু নেই তাই তেমন কেউ থেকে থাকলে সে স্বাভাবিক ভাবে সম্পত্তি পাবে না। তাকে বিশেষ ভাবে উইল বা দান করতে হবে।
কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম আছে যখন কেউ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। যেমন, যদি তিনি যার কাছ থেকে সম্পত্তি পাবেন তাকে খুন করেন কিংবা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেন বা বিশেষ বিবাহ আইনে বিবাহ করেন।
আশা করি, পুরো আলোচনাটি আপনাদের ভালো লেগেছে। কোনো কিছু বলার থাকলে কিংবা কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে সদুত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো।
উৎস: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (সামান্য পরিমার্জিত)
আরও পড়ুন: গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশে নেই – কারফিউ জারি শ্রীলঙ্কায়।