উত্তরবঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে সুদ নিয়ে বর্তমানে তুমুল আলোচনা চলছে। সুদ মূলত হলো এক প্রকার মুনাফা। যখন কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির কাছে থেকে নির্ধারিত অতিরিক্ত টাকা দেয়ার শর্তে কিছু পরিমাণ টাকা নিয়ে আসে তখন তাকে সুদ বলে।
ধরুন, রহিম সাহেব ফজল সাহেবের কাছে কিছু টাকা ধার চাইতে গেল। তখন ফজল সাহেব রহিম সাহেবকে বললো যে, আমি ধার দিতে পারবো না। নিলে সুদ হিসেবে নিতে হবে।
যখন রহিম সাহেব রাজি হলো তখন ফজল সাহেব বললো যে, আমি আপনাকে ৫ হাজার টাকা দিচ্ছি। আপনি প্রতি হাজারে আমাকে প্রতি মাসে ২০০ টাকা করে দিবেন। তাহলে ৫ হাজার টাকা নিলে রহিম সাহেবকে প্রতি মাসে ১০০০ টাকা করে লাভ দিতে হবে। আর মূল ৫ হাজার টাকা তো থেকেই যাবে। এটিই হলো মূলত সুদ।
যারা সুদের কারবারি করেন তারা আসলে মানুষকে কখনো টাকা ধার দেন না। যে শ্রেণীর যে মানুষই যাক না কেন তার কাছে নির্ধারিত হারে টাকা দিয়ে থাকেন।
সুদের টাকা নেয়ার পরে সময় মতো দিতে না পারার কারণে অনেক ঘটনাই এখন পর্যন্ত উত্তরবঙ্গে তথা সারাদেশে ঘটেছে। এমনও হয়েছে যে, কৃষক বাবার ছোট মেয়েকে পর্যন্ত ৫০ বছর বয়স্ক ব্যক্তি (সুদকারবারী) বিয়ে করেছেন। শুধুমাত্র টাকা না দেয়ার কারণে।
উত্তরবঙ্গে বর্তমানে ১০০০ টাকা প্রতি মাসে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা করে সুদ দিতে হয়। এটা অবশ্যই উচ্চ হার। গরীব শ্রেণীর মানুষ সুদের টাকা সুদ করতে পারলেও সুদের আসল টাকা আর সুদ করতে পারে না। দেখা যায়, ৫ হাজার টাকা সুদ হিসেবে নিয়ে ৭ হাজার টাকা কেবল সুদই দিয়েছে কিন্তু আসল ৫ হাজার টাকা দেয়ার সামর্থ্য হয়নি।
পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার রায় বাবুর সাথে কথা বলে জানা গেছে যে, তিনি একজন মাঝারী আকারের কৃষক। কয়েক বিঘা জমি চাষ করেন। কিন্তু সংসারে তেমন কোনো আয়ের উৎস না থাকায় তিনি পাশের গ্রামের সুদ কারবারীর কাছে থেকে ২০ হাজার টাকা সুদে নিয়েছিলেন।
এখন পর্যন্ত তিনি সেই টাকার ঘানি টানছেন। মাসে মাসে হাজার কষ্ট হলেও সুদের টাকা দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু অধরা থেকে যাচ্ছে আসল টাকা। কারণ, একসাথে বিশ হাজার টাকা যোগাড় করা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
আবার কৃষক তাইব আলী বললেন যে, বর্তমানে যে হারে সবকিছুর দাম বাড়তি সে হিসেবে ছেলে মেয়ের পড়াশোনা করানো, নিজের সংসার খরচ সব কিছু চালানো খুবই কষ্টের। আর তাই মাঝে মধ্যে মহাজনের কাছে থেকে কিছু টাকা সুদে আনতে হয়। কিন্তু সুদের আনার পরে আরও মহামুশকিলে পড়ি। সুদের টাকা দিতে পারি কোনমতে কিন্তু আসল টাকা আর দিতে পারি না।
অনেক সময় সুদকারবারি তার টাকার জন্য নানারকম অত্যাচার শুরু করে। এরকম কয়েকটি ঘটনা উত্তরবঙ্গে ইতিপূর্বে ঘটেছে এবং তা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন তখন একটু সচেতন হলেও বর্তমানে সেই সচেতনতা স্থবির হয়ে পড়েছে।
সুদকারবারীগণ তাদের সুদের টাকার লাভ ইচ্ছামতো নির্ধারণ করে থাকেন। এখানে কোনো আইন নেই। আর অনেকেই চক্রবৃদ্ধি সুদের কারবার করেন। অর্থাৎ কেউ ৫০০০ টাকা নিয়ে যদি পরের মাসে লাভ বাদ ১০০০ টাকা দিতে না পারে তাহলে পরের মাসে ঐ ১ হাজার সহ মোট ৬০০০ টাকার লাভ দিতে হবে। এভাবে একজন কৃষক বা মধ্যবিত্ত আসলে মারা যায়।
সাধারণ মানুষের জন্য যদি সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ ঋণের ব্যবস্থা করা হতো তাহলে এই সুদ কারবার এতোটা হতো না। মানুষ একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারতো। এখানে সাধারণ মানুষের কোনো দোষ নেই। যখন একজন মানুষ তার একান্ত প্রয়োজনে কোথাও ধার পায় না তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই সুদ কারবারীর কাছে গিয়ে তাকে টাকা নিতে হয়।
কৃষক তাইব আলী আরো বলেন যে, তার গ্রামে আগে মাত্র দুজন মানুষ সুদের কারবারি করতো। এখন সেখানে প্রায় ১০ জন হয়ে গেছে। যার কিছু টাকা আছে সেই সুদ কারবারী করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ শুধু ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তিনি যোগ করেন, যদি সুদ হার কম থাকতো তাহলে হয়তো খানিকটা বাঁচা যেত।
রায় বাবু বলেন যে, সুদ কারবারী যে হারে বেড়ে যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে এটা এক প্রকার জুয়ো খেলা। দিন গেলেই ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষগুলো অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। তিনি দাবি রাখেন যে, সরকার যেন বিষয়টিতে নজর দেয়। এসব সুদ কারবারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।
দেবীগঞ্জ থানার প্রখ্যাত ব্যবসায়ী মোসলেম উদ্দীন বলেন, বিষয়টি সত্যিই মর্মান্তিক। সুদ কারবারীরা তাদের ইচ্ছেমতো সুদের হার নির্ণয় করে থাকেন। এতে করে সাধারণ মানুষ এর জুলুম করা হচ্ছে। আমরাও অনেক সময় প্রতারিত হচ্ছি। সরকারের একটু নজর দেয়া প্রয়োজন।
সুদ ইসলামে হারাম। কিন্তু তারপরেও সুদের কারবার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এটা থামাবে কে? সুদের থাবায় বহু পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তাদের খোঁজ কি কেউ নিচ্ছে?
আরও পড়ুন: করতোয়া নদীর দুই পাশ সবুজে সবুজে ভরে উঠছে।
সরকারের উচিত এসব সুদ কারবারীর তথ্য সংগ্রহ করা। তারপর তাদের একটি নির্দিষ্ট সুদ হার বলে দেয়া। এর বাইরে যেন তারা অতিরিক্ত সুদ হার আদায় করতে না পারে।
অপরপক্ষে সরকার যদি উত্তরবঙ্গের আপামর জন সাধারণের জন্য সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করে দিতে পারে তাহলে হয়তো মানুষগুলো হাফ ছেড়ে বাঁচে। উত্তরবঙ্গের মানুষের একটাই দাবি, সুদমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা চাই, সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই।